তাতারীদের আক্রমণের খবর যখন সিরিয়ায় পৌছল, তখন সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তাতারীদের ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে মুসলিমগণ আগেই অবহিত ছিল। তাই তাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আশপাশের সকল এলাকা ছেড়ে লোকেরা রাজধানী দামেস্কের দিকে চলে আসতে লাগল। দামেস্কের লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে খবর আসলো যে, মিশরের বাদশাহ প্রচুর সেনাবাহিনীসহ দামেস্কের মুসলিমদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসছেন। এই খবর শুনে নগরীতে প্রাণের সাড়া জাগল। মুসলিমগণ নতুন উদ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে লাগল।
৬৯৯ হিজরীর ২৭ রবীউল আওয়াল মাসে তাতারী সম্রাট কাজানের সাথে মিশরের সুলতানের সংঘর্ষ হলো। অনেক চেষ্টা করেও এবং অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেও মুসলিমরা শেষ রক্ষা করতে পারলোনা। মুসলিমরা হেরে গেল। মিশরের সুলতান পরাজিত সেনাবাহিনী নিয়ে কায়রোর পথে রওয়ানা হলেন।
এবার দামেস্কবাসীরা পড়লো মহাসংকটে। তাতারী সম্রাট সেনাদলসহ এবার বিজয়ী বেশে নগরে প্রবেশ করবে। তাতারী বিভীষিকার কথা চিন্তা করে বড় বড় আলেম ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা শহর ত্যাগ করতে লাগল। এর আগেই শহরের বিচারক, পরিচিত আলেম-উলামা, সরকারী অফিসার, বড় বড় ব্যবসায়ী এমনকি দামেস্কের গভর্ণর নিজের শহরের মায়া ত্যাগ করে মিশরের পথে পাড়ি জমালেন। জনগণের এক অংশও তাতারীদের হত্যাকান্ডের ভয়ে দামেস্ক ছেড়ে দিল। এখন কেবল সাধারণ জনগণের একটি অংশই দামেস্কে রয়ে গেল।
এদিকে কাজানের সেনাদল দামেস্কে প্রবেশের সময় ঘনিয়ে আসছিল। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং শহরের নেতৃস্থানীয় লোকেরা বসে একটা সিদ্বান্ত গ্রহণ করলেন। তারা সিদ্বান্ত নিলেন, ইমাম ইবনে তাইমীয়ার নেতৃত্বে নগরবাসীদের একটি প্রতিনিধি দল কাজানের নিকট যাবে। তারা নগরবাসীদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার একটি ফরমান লিখে আনবে।
এ উদ্দেশ্যে তাতারী সম্রাট কাজানের সামনে দলবল নিয়ে উপস্থিত হলেন ইসলামের অগ্রদূত ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। কাজানের সম্মুখে ইমাম কুরআন-হাদীছের উদ্ধৃতি দিয়ে ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে এবং যুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নির্ভয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং কাজানের কাছাকাছি হচ্ছিলেন। তাঁর আওয়াজ ধীরে ধীরে উঁচু ও গুরুগম্ভীর হচ্ছিল। কুরআনের আয়াত ও হাদীছ শুনাতে শুনাতে তিনি কাজানের নিকটে, আরো নিকটে চলে যাচ্ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পরাক্রমশালী কাজান এতে মোটেই বিরক্তিবোধ করছিলেন না। বরং তিনি কান লাগিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। ইতিমধ্যেই কাজান ইমামের ভাষণে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে গেলেন। ইমামের ভাষণ কাজানকে অনুবাদ করে শুনানো হলে তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এই আলেমটি কে? আমি এমন সাহসী ও দৃঢ় সংকল্প লোক আজকের পূর্বে আর কখনো দেখিনি। ইতিপূর্বে আমাকে অন্য কেউ এমন প্রভাবিত করতে পারেনি।
লোকেরা ইবনে তাইমীয়া সম্পর্কে কাজানকে জানালো এবং ইমামের ইলম ও কার্যাবলী সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলো।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া কাজানকে সেদিন বলেছিলেন, হে কাজান! আপনি নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করেন। আমি জানতে পেরেছি, আপনার সাথে রয়েছেন কাযী, শাইখ, মুআয্যিন এবং ইমামগণ। এসব সত্ত্বেও আপনি মুসলিমদের উপর আক্রমণ করেছেন, তাদেরকে হত্যা করেছেন, তাদের নারীদেরকে বন্দী করেছেন এবং মুসলিমদের মালামাল লুণ্ঠন করেছেন। অথচ আপনার পিতা ও দাদা কাফের হওয়া সত্ত্বেও এ ধরণের কাজ করতে ইতস্ততঃ করতেন। তারা নিজেদের ওয়াদা-অঙ্গীকার পালন করেছেন। আর আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আপনি আল্লাহর বান্দাদের উপর মারাত্মক যুলুম করেছেন।
সে সময় ইমামের সাথে ছিলেন প্রধান বিচারপতি নাজমুদ্দীন আবুল আববাস। তিনি লিখেছেন, ইবনে তাইমীয়া যখন কাজানের সাথে কথা শেষ করলেন, তখন তাঁর ও সাথীদের সামনে খাবার রাখা হলো। সবাই খেতে লাগলেন। কিন্তু ইমাম হাত গুটিয়ে নিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, এ খাবার হালাল নয়। কারণ গরীব মুসলিমদের থেকে লুট করা ছাগল ও ভেড়ার মাংস সংগ্রহ করা হয়েছে এবং মযলুম মানুষের কাছ থেকে জোর করে কাঠ সংগ্রহ করে তা পাকানো হয়েছে।
অতঃপর কাজান ইমামকে দুআ করার আবেদন করলেন। ইমাম দু’আ করতে লাগলেন। দু’আতে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এই যুদ্ধের পিছনে কাজানের উদ্দেশ্য যদি হয় তোমার দ্বীনকে সাহায্য করা, তোমার কালেমাকে বুলন্দ করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা, তাহলে তুমি তাঁকে সাহায্য করো। আর যদি দুনিয়ার রাজত্ব লাভ এবং লোভ-লালসা চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তুমিই তাকে ধ্বংস করো। আশ্চর্যের বিষয় হলো ইমাম দুআ’ করছিলেন, আর কাযান আমীন আমীন বলে যাচ্ছিলেন।
কাযী আবুল আববাস নাজমুদ্দীন বলেন, ইমাম যখন কাযানের সামনে বক্তৃতা করছিলেন, তখন আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং নিজেদের জামা-কাপড় গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। কি জানি কখন ইমামের উপর জল্লাদের তরবারী ঝলসে উঠবে এবং তার রক্তে আমাদের বস্ত্র রঞ্জিত হবে। কাযী নিযাম উদ্দীন আরো বলেন, কাযানের দরবার থেকে বের হয়ে এসে আমরা ইমামকে বললাম, আমরা আপনার সাথে যাবোনা। আপনি তো আমাদেরকে প্রায় মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আপনার কারণে আমাদের উপর বিরাট মসীবত চলে আসার উপক্রম হয়েছিল। ইমাম তখন ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, বরং আমিই তোমাদের সাথে যাবোনা। অতঃপর আমরা সকলেই তাঁকে রেখে চলে আসলাম। ইমাম একাই রওয়ানা দিলেন। রওয়ানা দেয়ার সময় কাযান আবার দুআ করার আবেদন করলেন। ইমাম পূর্বের দুআর পুনরাবৃত্তি করলেন।
ইমামকে একাকী চলতে দেখে স্বয়ং কাযান একদল সৈন্য পাঠিয়ে ইমামের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। ইমামের একাকীত্বের খবর শুনে শহরের একদল লোক বের হয়ে এসে ইমামকে সঙ্গ দেয়ার কথাও জানা যায়। কাযী নাজমুদ্দীন আবুল আববাস বলেন, ইমাম নিরাপদে দামেস্কে ফিরে এলেন। ঐদিকে আমাদের অবস্থা এতই শোচনীয় হলো যে, রাস্তায় একদল লুটেরা বাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করলো এবং সর্বস্ব খুইয়ে নিল। আমরা একদম উলঙ্গ হয়ে শহরে ফিরলাম।
অত্যন্ত মর্যাদার সাথে ইমাম তাতারীর দরবার থেকে ফিরে আসলেন এবং নগরবাসীর জন্য নিরাপত্তার পরোয়ানা লিখিয়ে আনলেন। তাতারীরা যাদেরকে বন্দী করেছিল, তাদেরকেও ছাড়িয়ে আনলেন। তাতারীদের বর্বরতার কাহিনী তিনি যেমন শুনেছিলেন, তেমনি নিজ চোখেও তাদের তান্ডব দেখেছিলেন। তারপরও তিনি একটুও বিচলিত হননি। তাতারী সম্রাটের মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে এবং তাতারী সেনাদের মধ্যে অবাধে চলাফেরা করতে তিনি একটুও ভীতি অনুভব করেন নি। তিনি বলতেন, যার অন্তরে রোগ আছে সেই কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ভয় করতে পারে।