লোকমান হেকিম স্বীয় ছেলেকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে বলেন,
يَا بُنَيَّ لاَ تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ-
‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক কর না, নিঃসন্দেহে শিরক মারাত্মক অপরাধ’ (লোক্বমান ১৩)।
يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلاَةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوْفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلىَ مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُوْرِ، وَلاَ تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلاَ تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ-
‘হে বৎস! ছালাত ক্বায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে বাধা প্রদান কর এবং বিপদাপদে ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। (হে বৎস!) অহংকার বশে তুমি মানুষকে ভ্রুকুঞ্চিত কর না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে চল না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (লোক্বমান ১৭-১৮)। অতএব প্রত্যেক গৃহকর্তার জন্য যরূরী হল স্বীয় পরিবারের সদস্যদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া এবং আল্লাহর ভয় দেখানো।
আল্লাহ অন্যত্র বলেন, يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُسَارِعُوْنَ فِي الْخَيْرَاتِ وَأُولَئِكَ مِنَ الصَّالِحِيْنَ ‘তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে। তারা ভাল কাজের আদেশ করে, মন্দ কাজের নিষেধ করে এবং কল্যাণকর কাজে তারা দ্রুত অগ্রসর হয়। তারাই সৎলোক ও সফল মানুষ’ (আলে ইমরান ১১৪)।
এর বিপরীত কাজ হচ্ছে মুনাফিকদের। আল্লাহ বলেন, الْمُنَافِقُوْنَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُوْنَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَيَقْبِضُوْنَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ ‘মুনাফিক পুরুষ মুনাফিক নারী তারা পরস্পর এক খিয়ালের মানুষ। তারা মন্দ কাজের আদেশ করে, ভাল কাজের নিষেধ করে এবং কল্যাণকর কাজ হতে নিজেদের হাত গুটিয়ে রাখে। এরা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদের ভুলে গেছেন। এরাই মুনাফিক নিঃসন্দেহ তারা ফাসিক’ (তওবা ৬৭)।
عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ قَالَ خَطَبَنَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ النَّحَرِ ... قَالَ ألاَ هَلْ بَلَّغْتُ قَالُوْا نَعَمْ قَالَ اللهُمَّ اشْهَدْ فّلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ-
আবু বাকরা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) কুরবানীর দিন আমাদের সামনে বক্তব্য পেশ করলেন। ... তিনি এক পর্যায়ে বললেন, আমি কি (আমার উপর অর্পিত রিসালাত) পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিত ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ (আপনি পৌঁছে দিয়েছেন)। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো। (অতঃপর তিনি বললেন) উপস্থিত যারা আছে তারা যেন অনুপস্থিতদের নিকট এ দাওয়াত পৌঁছে দেয়’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৬৫৯; বাংলা মিশকাত ৫ম খন্ড, হা/২৫৪১ ‘হজ্জ’ অধ্যায়)।
وَفِيْ رِوَايَةٍ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنْتُمْ تَسْأَلُوْنَ عَنِّيْ فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُوْنَ؟ قَالُوْا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ اللهُمَّ اشْهَدْ اللهُمَّ اشْهَدْ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ-
অন্য বর্ণনায় রয়েছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমার দাওয়াত পৌঁছানো সম্পর্কে তোমাদেরকে একদিন জিজ্ঞেস করা হবে। সেদিন তোমরা কি বলবে? ছাহাবীগণ বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, নিশ্চয়ই আপনি দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন, আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন, আপনি মানুষকে উপদেশ দান করেছেন। রাসূল (ছাঃ) তখন শাহাদত অঙ্গুলি আকাশের দিকে উঠিয়ে ইশারা করে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো (আমি তোমার পয়গাম মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছি)’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫; বাংলা মিশকাত ৫ম খন্ড, হা/২৪৪০ ‘হজ্জ’ অধ্যায়)।
হাদীছদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় রিসালাতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। অতএব আমাদেরকেও যথাযথভাবে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে।
আমরা যদি দাওয়াত পৌঁছাতে অলসতা করি তবে আমাদেরকেও ক্বিয়ামতের মাঠে জবাবদিহি করতে হবে। হাদীছে এসেছে-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَلاَ حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِدًا فَلْيَتَبَوَّأ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার একটি কথাও জানা থাকলে অন্যের নিকট পৌঁছে দাও। আর বনী ইসরাঈলের কাহিনীও প্রয়োজনে বর্ণনা কর, এতে কোন দোষ নেই। তবে যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করবে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে করে নেয়’ (বুখারী, মিশকাত হা/১৯৮; বাংলা মিশকাত ২য় খন্ড, হা/১৮৮ ‘ইলম’ অধ্যায়)।
অত্র হাদীছে আমাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য কঠোরভাবে আদেশ করা হয়েছে এবং মানুষকে সতর্ক করার জন্য বনী ইসরাঈলের সঠিক কাহিনীও বর্ণনা করতে বলা হয়েছে, যেন মানুষ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدِ الْخُدْرِي عَنِ النَّبِّيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرُهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيْمَانِ.
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের যে কেউ কোন অপছন্দনীয় (কথা বা কর্ম) দেখলে সে যেন বলপূর্বক হাত দ্বারা বাধা প্রদান করে। (হাত দ্বারা বাধা প্রদান) সম্ভব না হ’লে যেন কথার মাধ্যমে বাধা প্রদান করে। এটাও সম্ভব না হ’লে সে যেন অন্তর থেকে ঘৃণা করে। আর এটিই হচ্ছে দুর্বল ঈমান’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৩৭; বাংলা মিশকাত ৯ম খন্ড, হা/৪৯১০ ‘ভাল কাজের আদেশ প্রসঙ্গ’ অধ্যায়)।
এখানে দাওয়াতের তিনটি পদ্ধতি বা পর্যায় উল্লেখ করা হয়েছে এবং সম্ভবপর যে কোন একটি পথ অবলম্বনের জোরালো তাকীদ করা হয়েছে।
বলাবাহুল্য এক শ্রেণীর আলেম পেশা হিসাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে দাওয়াত প্রদান করছেন। সরকারী, আধা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণীর আলেম ছাত্র পড়ানোকে যথেষ্ট মনে করছেন। অথচ সর্বপ্রকার দাওয়াতের চেষ্টা ব্যতীত বিচারের মাঠে সফলতা লাভ সম্ভব নয়।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানকে প্রত্যেক দিন ইবাদত করতে হবে। তখন সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি বলল, আপনি যা আদেশ করেছেন তার মধ্যে এটা সবচেয়ে বেশী। নবী কারীম (ছাঃ) বললেন, ভাল কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজের নিষেধ করা ইবাদত। দুর্বল মানুষকে বাহনে উঠিয়ে নেওয়া ইবাদত। রাসত্মা হতে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে দেওয়া ইবাদত। আর ছালাতের জন্য তুমি যেসব পদক্ষেপ রাখবে তা ইবাদত (তারগীব হা/৩২৯৭)।
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدِ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ حَق عِنْدَ سُلْطَانٍ أَوْ أَمِيْرٍ جَائرٍ.
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নবী কারীম (ছাঃ) বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম জিহাদ হচ্ছে স্বৈরাচারী বাদশাহ অথবা স্বৈরাচারী আমীরের নিকট হক কথা বলা (তারগীব হা/৩২৯৯)।