তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি মুমিন জীবনের মূলভিত্তি। যে ব্যক্তি আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করে আল্লাহ তার সকল বিষয় সমাধান করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا، وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ- ‘যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার মুক্তির পথ বের করে দেন এবং এমন সূত্রে তাকে রিযিক দেন যার কল্পনা সে করেনি’ (তালাক ২-৩)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُوْنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেরূপ ভয় করা উচিৎ। আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ কর না’ (আলে ইমরান ১০২)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে। আর তাঁকে যে ভয় করবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন, তার রিযিকের ব্যবস্থা করবেন এবং তাকে মর্যাদা দান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সেই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ- ‘আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হতে ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি জান্নাত’ (আর-রহমান ৪৬)।
তাক্বওয়া মুমিনের একমাত্র সম্বল। যা মানুষকে সম্মানিত করে। তাক্বওয়াশীলদেরকেই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) সবচেয়ে সম্মানিত বলেছেন। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ-
‘হে মানুষ সকল! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানি সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরহেযগার। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত’ (হুজুরাত ১৩)। এখানে আল্লাহ তা‘আলা পরহেযগার মানুষকেই সবচেয়ে বড় সম্মানিত মানুষ বলে উল্লেখ করেছেন। অত্র আয়াতে একথাও বলা হয়েছে যে, বংশ মর্যাদা সম্মানিত হওয়ার মাধ্যম নয় এবং নারী বা পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়াও সম্মানিত হওয়ার মাধ্যম নয়। মানুষ কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে ইহাকাল ও পরকালে সম্মান লাভ করতে পারে।
আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন, فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘তোমরা আল্লাহকে যথা সম্ভব ভয় কর’ (তাগাবুন ১৬)। অত্র আয়াতে আল্লাহ মানুষকে তার সাধ্য অনুযায়ী পরহেযগারিতা অবলম্বন করার জন্য আদেশ করেছেন।
অন্যত্র তিনি আরো বলেন, يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلاً سَدِيْدًا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’ (আহযাব ৭০)। এ আয়াতে আল্লাহ মানুষকে পরহেযগারিতা অবলম্বন করতে বলেন এবং সত্য কথা বলতে আদেশ করেন।
অপর এক আয়াতে পরহেযগারিতা অবলম্বনের উপকারিতা তুলে ধরে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করে চল, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার মানদন্ড দান করবেন। তোমাদের পাপ মিটিয়ে দিবেন। আর তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। কারণ আল্লাহ বড় অনুগ্রহশীল’ (আনফাল ২৯)।
অত্র আয়াতে চারটি জিনিসের কথা বলেছেন- (১) পরহেযগার হতে বলেছেন (২) বিনিময়ে আল্লাহ মানদন্ড দিবেন (৩) পাপ মিটিয়ে দিবেন (৪) ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহভীতি বা তাকওয়া মানুষকে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করে চলার মানসিকতা তৈরী করে দেয়। আর তাকওয়া মানুষের জীবিকার গ্যারান্টি হতে পারে।
মানুষ তার বংশ মর্যাদা দ্বারা সম্মান লাভ করতে পারে না। কেবল তাক্বওয়া দ্বারা ইয্যত-সম্মান লাভ করতে পারে।
আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا ‘যে লোক আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ সহজ ও সুবিধাজনক করে দেন’ (তালাক্ব ৪)। অত্র আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা পরহেযগারিতা অবলম্বন করে আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا ‘যে লোক পরহেযগারিতা অবলম্বন করে আল্লাহ তার পাপ মিটিয়ে দেন এবং তাকে বড় প্রতিদান প্রদান করেন’ (তালাক্ব ৫)। অত্র আয়াতে তাকওয়া অবলম্বন করার দু’টি বড় ফলাফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (১) তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহ মানুষের পাপ মিটিয়ে দেন। (২) আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারীকে বড় প্রতিদান দেন। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَتَزَوَّدُوْا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُوْنِ يَا أُوْلِي الْأَلْبَابِ- ‘আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। আর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া। হে জ্ঞানী মানুষ! তোমরা আমাকে ভয় কর’ (বাক্বারাহ ১৯৭)। অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াকে সবচেয়ে উত্তম পাথেয় বলেছেন। আর আল্লাহ জ্ঞানী ব্যক্তিকে সম্বোধন করে বলেন, তোমরা আমার ব্যাপারে তাক্বওয়া অবলম্বন কর। অন্যত্র তিনি বলেন, وَاعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ ‘আর জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাক্বওয়াশীল মানুষের সাথে থাকেন’ (বাক্বারাহ ১৯৪)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَإِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাকওয়াশীল ব্যক্তিদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৭৬)। উপরোক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সুখে-শান্তিতে ও নিরাপদে জীবন যাপন করার জন্য তাকওয়াই হচ্ছে বড় মাধ্যম।
এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ أَكْرَمُ النَّاسِ قَالَ أَتْقَاهُمْ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হল, মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু’ (বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৬৯)।
এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ ‘যার কর্ম তাকে পিছে সরিয়েছে, তার বংশ মর্যাদা তাকে আগে বাড়াতে পারবে না’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪)।
নবী কারীম (ছাঃ) যুদ্ধের প্রধান সেনাপতিকে তাকওয়াশীল হওয়ার জন্য আদেশ করতেন-
عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا أَمَّرَ أَمِيْرًا عَلَى جَيْشٍ أَوْ سَرِيَّةٍ أَوْصَاهُ فِيْ خَاصَّتِهِ بِتَقْوَى اللهِ وَمَنْ مَعَهُ مِنْ الْمُسْلِمِيْنَ خَيْرًا-
সুলায়মান ইবনে বুরায়দা (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন তার পিতা বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন কোন সৈন্যদলের আমীর নির্ধারণ করতেন, তখন তাকে বিশেষভাবে আল্লাহকে ভয় করার তথা তাক্বওয়া অবলম্বন করার জন্য আদেশ করতেন। আর সাধারণ মুসলিম যোদ্ধাদেরকে কল্যাণের উপদেশ দিতেন’ (মুসলিম, বুলূগুল মারাম হা/১২৬৮)।