নবী (সা.) এর ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি গ্রন্থ প্রণয়নয়ের কারণ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দিন আলবানী (রহ.) ১ টি

আমি যেহেতু এ বিষয়ে পরিপূর্ণ কোন কিতাবের সন্ধান পাইনি, তাই আমি ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পথ অনুসরণে আগ্রহী মুসলিম ভাইদের জন্য এমন একটি কিতাব লিখা নিজের উপর অনিবার্য মনে করলাম, যে কিতাবে তাকবীর থেকে সালাম পর্যন্ত যথাসম্ভব নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাতের পূর্ণ বিবরণী সন্নিবেশিত হবে যাতে করে সত্যিকার অর্থে যারা নবীপ্ৰেমিক তাদের যে কেউ এ কিতাব খানা পেলে সহজভাবে পূর্বোক্ত হাদীছের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারে। (হাদীছটি এরূপ)

صلوا كما رأيتموني أصلي

অর্থঃ “তোমরা আমাকে যেমনভাবে ছলাত পড়তে দেখ ঠিক ঐভাবে ছলাত পড়।” এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমি দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করলাম এবং এ সম্পৰ্কীয় হাদীছ মন্থন করতে শুরু করলাম, হাদীছের বিভিন্ন গ্ৰন্থরাজি থেকে। সে চেষ্টারই ফসল হলো (হে পাঠক) আপনার সামনে উপস্থিত এই কিতাবটি। আমি নিজের উপর শর্ত করে নিয়েছি যে, এতে কেবল ঐ হাদীছগুলিই সন্নিবেশিত করব যেগুলির সূত্র হাদীছ শাস্ত্রের ব্যাকরণ ও মূলনীতি অনুসারে সুসাব্যস্ত। আর যে হাদীছ সূত্রের কোন পর্যায়ে অপরিচিত অথবা দুর্বল রাবী একা পড়ে যায় সে হাদীছ আমি প্ৰত্যাখ্যান করেছি। চাই তা অবস্থা বর্ণনার ক্ষেত্রে হোক অথবা যিকর সংক্রান্ত হোক অথবা ফযীলত বা অন্য কোন বিষয়ে হোক। যেহেতু আমি বিশ্বাস করি যে, সুসাব্যস্ত[1] ছহীহ হাদীছই যঈফ হাদীছ ব্যতীত যথেষ্ট। যঈফ হাদীছ নির্বিবাদে কেবল ধারণা বা অপ্রাধান্যযোগ্য ধারণার উপকারিতা দিতে সক্ষম, আর তা আল্লাহর বাণী অনুযায়ী- (لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا) হক থেকে মোটেও অমুখাপেক্ষী করতে পারে না।[2]

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-

إياكم والظن فإن الظن أكذب الحديث

অর্থঃ তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে চল, কেননা ধারণা হচ্ছে সর্বাধিক মিথ্যা।[3]

তাইতো আল্লাহ পাক আমাদেরকে এর উপর আমল করার জন্য বাধ্য করেননি, বরং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ থেকে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেনঃ

اتقوا الحديث عني إلا ما علمتم

অর্থঃ তোমরা আমার থেকে কেবল যা জান তা ব্যতীত অন্য কিছু বর্ণনা করা থেকে বিরত থাক। আর যখন তিনি যঈফ হাদীছ বৰ্ণনা করতে নিষেধ করলেন তখন এর উপর আমল করতে নিষেধ করবেন। এটাই অতি স্বাভাবিক।

হাদীছটি ছহীহ আখ্যায়িত করেছেন তিরমিযী, আহমাদ ও ইবনু আবী শাইবাহ। শাইখ মুহাম্মাদ সাঈদ আল-হালাবী স্বীয় গ্ৰন্থ “মুসালসালাতে” এটিকে বুখারীর দিকেও সম্পর্কিত করেছেন। যাতে তিনি প্রমাদে পতিত হয়েছেন। পরবর্তীতে আমার নিকট পরিস্ফুটিত হয়েছে যে, হাদীছটি যঈফ। (পূর্বে) ইবনু আবী শাইবাহর সানাদকে ছহীহ প্ৰতিপন্ন করার ব্যাপারে মানাবীর অনুসরণ করেছিলাম। অতঃপর এর সম্পর্কে নিজের পক্ষেই জানা সহজ হয়ে যায় যে, এটি স্পষ্ট দুর্বল আর এটি স্বয়ং তিরমিযী ও অন্যান্যদের সনদ। দেখুন। আমার কিতাব “সিলসিলাতুল আহাদীছছু ছহীহাহ” (হাদীছ নং ১৭৮৩)-এর স্থলাভিষিক্ত ছহীহ হাদীছটি এই

من حدث عني بحدیث یری آنه کذاب فهو احد الکاذبین رواه مسلم وغیره

যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে কোন হাদীছ বৰ্ণনা করে যার সম্পর্কে সে জানে (বা ধারণা করা হয়) যে এটি মিথ্যা সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদীদেরই একজন। এটি মুসলিম ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন। দেখুন। আমার কিতাব সিলসিলাতুল আহাদী ছিয যাঈফাহ এর ভূমিকা (প্রথম খণ্ড)। বরং উক্ত হাদীছ থেকে প্রয়োজন মুক্ত করে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এ বর্ণাটিওঃ

إياكم وكثرة الحديث عني، من قال علي فلا يقولن إلاحقا أوصدقا، فمن قال علي مالم أقل فليتبوأ مقعده من النار (ابن أبي شيبة (٨/٧٦٠) وأحمد وغيرهما، و هو مخرج فی الصحیحة (١٧٥٣)

তোমরা সাবধান হও! আমার থেকে বেশী বেশী হাদীছ বর্ণনা করা থেকে। যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে কথা বলে সে যেন ন্যায় ও সত্য ছাড়া কিছু না বলে, যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে এমন কথা বলে যা আমি বলিনি, তবে সে জাহান্নামে তার স্থান নির্ধারণ করে নেয়। এটি সংকলন করেছেন ইবনু আবী শাইবাহ (৮/৭৬০) আহমাদ ও তারা দু’জন ব্যতীত অন্যান্যরা। আর এটি “আছছহীহা”তেও উদ্ধৃত হয়েছে। (১৭৫৩ নং)

আমি এ গ্রন্থটিকে দু’ ভাগে সাজিয়েছিঃ (১) উপরিভাগ (২) নিম্নভাগ। প্রথমটা কোন কিতাবের মূল বক্তব্যের ন্যায়- তাতে হাদীছের শব্দগুলি ও কিতাবের বিশেষ প্রয়োজনীয় বাক্যগুলি সন্নিবেশিত করেছি, আর এগুলিকে তার মানানসই স্থানে প্রয়োগ করেছি, এমনভাবে তার পারস্পরিক মিল বজায় রেখেছি যে, কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ দেখা যায়। হাদীছের বাক্য ও শব্দ যেভাবে হাদীছের কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে তাকে সেভাবেই সযত্নে সংরক্ষণ করেছি। কখনও একাধিক শব্দ থাকলে কোন একটাকে প্রাধান্য দিয়েছি প্রণয়নের বা অন্য কোন সুবিধার্থে। আবার কখনও এর সাথে ভিন্ন শব্দকে সংযোজন করেছি। এই বলে যে, (অপর শব্দে এমনটি রয়েছে) অথবা (অপর বর্ণনায় এমনটি রয়েছে)। ছাহাবাদের যারা হাদীছগুলি বৰ্ণনা করেছেন তাদের যৎসামান্য ছাড়া কারো নাম উল্লেখ করিনি। এমনিভাবে হাদীছ শাস্ত্রের ইমামদের মধ্যে থেকে এর বর্ণনাকারীদের নামও। অনুসন্ধান ও তত্ত্বান্বেষণের সহজতর দিকে লক্ষ করে।

আর দ্বিতীয়াংশটি প্রথমটির ভাষ্যের মত। এতে উপরিভাগে উল্লিখিত হাদীছসমূহের উদ্ধৃতি দিয়েছি, হাদীছের সব ক'টি শব্দ ও সূত্র পথকে উল্লেখ করেছি, তার সূত্র এবং সহযোগী হাদীছের ব্যাপারে ভাল, মন্দ, বিশুদ্ধ, অশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মন্তব্য ব্যক্ত করেছি, এসব কিছু হাদীছ শাস্ত্রের মূলনীতির আলোকে সম্পাদিত হয়েছে। আর প্রায়ই (হাদীছের) কোন কোন সূত্রপথে এমন সব শব্দ ও বর্ধিত অতিরিক্ত কথা পাওয়া যায় বা অন্য সূত্রপথে মিলে না, এমতাবস্থায় এই শব্দ ও অতিরিক্ত কথাগুলিকে উপরিভাগের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখা সম্ভব হলে তা জড়িয়ে দিয়েছি।

এবং লম্বালম্বি দু'টো ব্র্যাকেটের মাঝে স্থাপন করে এ কাজের প্রতি ইঙ্গিত করেছি এভাবে তাতে মূল হাদীছের একক সংকলকের নাম উল্লেখ করিনি। আর এটা ঐ অবস্থার কথা যখন হাদীছের বর্ণনার উৎস শুধু একজন ছাহাবী। অন্যথায় এটাকে স্বতন্ত্র আরেক প্রকার হাদীছ হিসাবে উল্লেখ করেছি। যেমনটি আপনি ছলাতের শুরুতে পঠিতব্য দু'আগুলির ব্যাপারে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখতে পাবেন। এটা একটা কঠিন ও উত্তম কাজ যা এমনভাবে অন্য কিতাবে আপনি পাবেন না। তাই ঐ আল্লাহর জন্যে সব প্রশংসা যার অনুগ্রহে পুণ্যকৰ্মসমূহ সম্পাদিত হয়।

তারপর আমাদের সংকলিত হাদীছ সম্পর্কে উলামাদের মতামত এবং তাদের দলীল উল্লেখ পূর্বক তার পর্যালোচনা ও পক্ষ বিপক্ষামূলক আলোচনা করব। অতঃপর এই প্রক্রিয়ায় উপরে উল্লেখকৃত সঠিক কথা উদ্ধার করবো। কখনও এমন কিছু মাসআলার অবতারণা করবো যে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন হাদীছ নাই, বরং তা কেবল গবেষণালব্ধ মাসআলা যা আমার এই কিতাবের বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।

কিতাবটির নামকরণ করলামঃ “নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি, তাকবীর থেকে সালাম পর্যন্ত যেন আপনি তা দেখছেন”। আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন একে তার সম্মানিত চেহারার জন্য নিরংকুশভাবে মনোনীত করেন এবং এর মাধ্যমে আমার মু’মিন ভাইদেরকে উপকৃত করেন, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা (প্রার্থনা) মঞ্জুরকারী।

[1] সুসাব্যস্ত হাদীছ বলতে মুহাদ্দিছগণের নিকট ছহীহ এবং হাসান হাদীছের উভয় প্রকার যথা নিজগুণে ছহীহ ও পরের গুণে ছহীহ এবং নিজগুণে হাসান ও পরের গুণে হাসান সবকে বুঝায়।

[2] সূরা আন-নাজম ২৮ আয়াত।

[3] বুখারী ও মুসলিম, এটা আমার কিতাব “গায়াতুল মারাম ফী তাখরীজি আহাদীসুল হালাল ওয়াল হারাম” এ উদ্ধৃত হয়েছে হাদীছ নং ৪১২।