হজ ফরয ও উমরা ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ

হজ-উমরা সহীহ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই মুসলিম ও জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। আর তার ওপর হজ-উমরা আবশ্যক হওয়ার জন্য তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক ও সামর্থবান হতে হবে। মহিলা হলে হজের সফরে তার সাথে মাহরাম থাকতে হবে। নিচে এর বিবরণ তুলে ধরা হল :

হজ ও উমরা সহীহ হওয়ার শর্ত :

১. মুসলিম হওয়া।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَاۚ ﴾ [التوبة: ٢٨]

‘হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মুশরিকরা নাপাক, সুতরাং তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয় তাদের এ বছরের পর।’[1] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡهُمۡ نَفَقَٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ﴾ [التوبة: ٥٤]

‘আর তাদের দান কবুল থেকে একমাত্র বাধা এই ছিল যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে।’[2] আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ বকর সিদ্দীক রা. আমাকে বিদায় হজের পূর্বের বছর, যে হজে তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের আমীর নিযুক্ত করেছিলেন- এমন এক দলের সদস্য করে পাঠালেন যারা কুরবানীর দিন মিনায় ঘোষণা দিচ্ছিল,

لاَ يَحُجُّ بَعْدَ الْعَامِ مُشْرِكٌ وَلاَ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ.

‘এবছরের পর আর কোন মুশিরক হজ করবে না এবং কোন উলঙ্গ ব্যক্তি বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফ করবে না।’[3] বুঝা গেল, এতে যেকোনো ইবাদত সহীহ ও কবুল হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া পূর্বশর্ত।

২. আকল বা বিবেকসম্পন্ন হওয়া।

তাই বিবেকশূন্য ব্যক্তির ওপর হজ-উমরা জরুরী নয়। কারণ সে ইসলামের বিধি-বিধান জানা এবং আল্লাহর আদেশ বুঝার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং সে দায়িত্ব পালনে অক্ষম। তাই আল্লাহর নির্দেশ পালনে সে আদিষ্ট নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يُرْفَع الْقَلَم عَنْ الصَّغِير وَعَنْ الْمَجْنُون وَعَنْ النَّائِم».

‘বাচ্চা, পাগল ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ওপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়।’[4] যদি কেউ ইহরাম বাঁধার পূর্বেই বেহুঁশ বা অজ্ঞান হয়, তার জন্য বেহুঁশ অবস্থায় ইহরাম বাঁধার অবকাশ নেই। কেননা, হজে বা উমরা আদায়ের জন্য নিয়ত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি সে ইহরাম বাঁধার পর বেহুঁশ হয় তাহলে তার ইহরাম শুদ্ধ হবে। বেহুঁশ হওয়ার কারণে তার ইহরামের কোন ক্ষতি হবে না। এমতাবস্থায় তার সফরসঙ্গীদের উচিত তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া, সে যেন সময়মত আরাফাতে অবস্থান করতে পারে।

হজ ও উমরা আবশ্যক হওয়ার শর্ত :

১. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চা-যদিও সে বুঝার মত বা ভালো-মন্দ পার্থক্য করার মত জ্ঞান রাখে- তার জন্য হজ-উমরা আবশ্যক নয়। কেননা তার জ্ঞান ও শক্তি এখনো পূর্ণতা পায়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلاَثَةٍ :- وَفِيهِ - وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَشِبَّ. وَفِى رِوَايَةِ: وَعَنِ الصَّبِىِّ حَتَّى يَحْتَلِمَ».

‘তিনজন থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে : (তন্মধ্যে) শিশু থেকে, যতক্ষণ না সে যৌবনে উপনীত হয়।’[5] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘এবং শিশু থেকে যতক্ষণ না সে বালেগ হয়।’[6]

তবে বাচ্চারা যদি হজ বা উমরা আদায় করে, তবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘একজন মহিলা একটি শিশুকে উঁচু ধরে জানতে চাইল, ‘হে আল্লাহর রাসূল, এর জন্য কি হজ রয়েছে?’ তিনি বললেন,

«نَعَمْ ، وَلكِ أجْر».

‘হ্যাঁ, আর সওয়াব হবে তোমার।’[7]

প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো শিশুও ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ সব বিষয় থেকে দূরে থাকবে। তবে তার ইচ্ছাকৃত ভুলগুলোকে অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবে গণ্য করা হবে। ভুলের কারণে তার ওপর কিংবা তার অভিভাবকের ওপর ফিদ্য়া ওয়াজিব হবে না। এ-হজ তার জন্য নফল হবে। সামর্থবান হলে বালেগ হওয়ার পর তাকে ফরয হজ করতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَيُّما صَبِيٍّ حَجَّ ثُمَّ بَلَغَ الْحِنْثَ فَعَلَيْهِ أَنْ يَحُجَّ حِجَّةٌ أُخْرَى».

‘কোন বাচ্চা যদি হজ করে, অতঃপর সে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়, তবে পরবর্তীকালে সামর্থবান হলে তাকে আরেকটি হজ করতে হবে।’[8]

অনেক ফিকহবিদ বলেন, ‘শিশু যদি বালেগ হওয়ার আগে ইহরাম বাঁধে এবং ইহরাম অবস্থায় বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে আরাফায় অবস্থান করে, তাহলে তার ফরয হজ আদায় হয়ে যাবে।’

২. সামর্থবান হওয়া।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧ ﴾ [ال عمران: ٩٧]

‘এবং সামর্থবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বাইতুল্লাহ্‌র হজ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।’[9]

আপনার কোন ঋণ থেকে থাকলে হজ করার পূর্বেই তা পরিশোধ করে নিন। যাকাত, কাফফারা ও মানত ইত্যাদি পরিশোধ না করে থাকলে তাও আদায় করে নিন। কেননা এগুলো আল্লাহর ঋণ। মানুষের ঋণও পরিশোধ করে নিন। মনে রাখবেন, যাবতীয় ঋণ পরিশোধ ও হজের সফরকালীন সময়ে পরিবারের ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা করে হজের কার্যাদি সম্পন্ন করার মত অর্থ-কড়ি বা সামর্থ যদি আপনার থাকে তাহলে হজে যেতে আপনি আর্থিকভাবে সামর্থবান। আপনার ওপর হজ ফরয। তবে আপনি যদি এমন ধরনের বড় ব্যবসায়ী হন, বিভিন্ন প্রয়োজনে যার বড় ধরনের ঋণ করতেই হয়, তাহলে আপনার গোটা ঋণের ব্যাপারে একটা আলাদা অসিয়ত নামা তৈরি করুন। আপনার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী যারা হবেন তাদেরকে এ বিষয়ে দায়িত্ব অর্পণ করে যান।

আপনি হালাল রিযিক উপার্জন করে হজে যাওয়ার মতো টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করুন। কখনো হারাম টাকায় হজ করার পরিকল্পনা করবেন না। যদি এমন হয় যে, আপনার সমগ্র সম্পদই হারাম, তাহলে আপনি তওবা করুন। হারাম পথ বর্জন করে হালাল পথে সম্পদ উপার্জন শুরু করুন। আর কোনদিন হারাম পথে যাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করুন।

আপনি যদি দৈহিকভাবে সুস্থ হোন। অর্থাৎ শারীরিক দুর্বলতা, বার্ধক্য বা দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে হজের সফর বা হজের রুকন আদায় করতে অক্ষম না হোন, তাহলে আপনি হজে যেতে শারীরিকভাবে সামর্থবান বিবেচিত হবেন।

আপনি যদি আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থবান হোন, তাহলে আপনার ওপর সশরীরে হজ করা ফরয। আর যদি আর্থিকভাবে সামর্থবান কিন্তু শারীরিকভাবে সামর্থবান না হোন, তাহলে আপনি প্রতিনিধি নির্ধারণ করবেন, যিনি আপনার পক্ষ থেকে হজ ও উমরা আদায় করবেন। ‘বদলী হজ’ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা আসছে।

৩. হজের সফরে মহিলার সাথে মাহরাম পুরুষ থাকা।

ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আহমদ রহ.-এর মতে সফরের দূরত্বে গিয়ে হজ করতে হলে মাহরাম সাথে থাকা শর্ত। যে মহিলার মাহরাম নেই তার ওপর হজ ফরয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لاَ تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلاَّ مَعَ ذِي مَحْرَمٍ ، وَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهَا رَجُلٌ إِلاَّ وَمَعَهَا مَحْرَمٌ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أَخْرُجَ فِي جَيْشِ كَذَا وَكَذَا وَامْرَأَتِي تُرِيدُ الْحَجَّ فَقَالَ اخْرُجْ مَعَهَا».

‘কোন মহিলা যেন মাহরাম ছাড়া সফর না করে আর কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে মাহরাম থাকা ছাড়া তার কাছে না যায়।’এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি অমুক অমুক যুদ্ধে যাবার ইচ্ছা করেছি। এদিকে আমার স্ত্রী হজের ইচ্ছা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে যাও।’[10]

ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لا تَحُجَّنَّ امْرَأةٌ إِلا وَمَعَهَا ذُوْ مَحْرَمٍ».

‘কোন মহিলা যেন মাহরাম ছাড়া কখনো হজ না করে।’[11]

মহিলার মাহরাম

যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া স্থায়ীভাবে হারাম, তারাই শরীয়তের পরিভাষায় মাহরাম। মাহরাম কয়েক ধরনের হয়ে থাকে।

এক. বংশগত মাহরাম।

বংশগত মাহরাম মোট সাত প্রকার :

মহিলার পিতৃকূল : যেমন পিতা, দাদা, নানা, পর-দাদা, পর-নানা এবং তদুর্ধ পিতৃপুরুষ।

মহিলার ছেলে-সন্তান : যেমন পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যার পুত্র ও তাদের অধস্তন পুরুষ।

মহিলার ভাই : সহোদর তথা আপন ভাই বা বৈপিত্রেয় ভাই অথবা বৈমাত্রেয় ভাই।

মহিলার চাচা : আপন চাচা বা বৈপিত্রেয় চাচা অথবা বৈমাত্রেয় চাচা। অথবা পিতা বা মাতার চাচা।

মহিলার মামা : আপন মামা বা বৈপিত্রেয় মামা অথবা বৈমাত্রেয় মামা। অথবা পিতা বা মাতার মামা।

মহিলার ভাইয়ের ছেলে : ভাইয়ের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের কন্যাদের ছেলে ও তাদের অধস্তন পুরুষ।

মহিলার বোনের ছেলে : বোনের ছেলে, বোনের ছেলের ছেলে, বোনের ছেলের কন্যাদের ছেলে ও তাদের অধস্তন পুরুষ।

দুই. দুগ্ধপানজনিত মাহরাম।

দুগ্ধপানজনিত মাহরামও বংশগত মাহরামের ন্যায় সাত প্রকার, যার বিবরণ ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিন. বৈবাহিক সম্পর্কজাত মাহরাম।

বৈবাহিক সম্পর্কজাত মাহরাম পাঁচ ধরনের :

  1. স্বামী।
  2. স্বামীর পুত্র, তার পুত্রের পুত্র, কন্যার পুত্র এবং তাদের অধস্তন পুরুষ।
  3. স্বামীর পিতা, দাদা, নানা এবং তদূর্ধ্ব পুরুষ।
  4. কন্যার স্বামী, পুত্রসন্তানের মেয়ের স্বামী, কন্যাসন্তানের মেয়ের স্বামী এবং তাদের অধস্তন কন্যাদের স্বামী।
  5. মায়ের স্বামী এবং দাদী বা নানীর স্বামী।

মাহরাম বিষয়ক শর্ত

মাহরাম পুরুষ অবশ্যই মুসলিম, বিবেকবান ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। কেননা, মাহরাম সাথে নেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে হজের কার্যাদি সম্পাদনে মহিলার সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মাহরাম যদি অমুসলিম হয় অথবা ভালো-মন্দ বিচার-ক্ষমতা না রাখে অথবা বালক কিংবা শিশু হয় কিংবা পাগল হয়, তবে তার দ্বারা মহিলার সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।

যদি কোন মহিলা মাহরাম ছাড়া হজ করে, তাহলে তা আদায় হবে বটে। কিন্তু মাহরাম ছাড়া সফরের কারণে সে গুনাহগার হবে। কেননা মহিলাদের সাথে মাহরাম থাকা হজ ফরয হওয়ার শর্ত। আদায় হওয়ার শর্ত নয়।

[1]. তাওবা : ২৮।

[2]. তাওবা : ৫৪।

[3]. বুখারী : ১/৩৬৯।

[4]. ইবন মাজাহ্‌ : ২৪০২।

[5]. তিরমিযী : ৩২৪১।

[6]. আবু দাউদ : ৩০৪৪।

[7]. মুসলিম : ২/৪৭৯।

[8]. আল-আওসাত : ২৫৭২; মাজমাউজ যাওয়ায়েদ : ৩/৬০২।

[9]. আলে ইমরান : ৯৭।

[10]. বুখারী : ১৮৬২।

[11]. দারা কুতনী : ২/৩০।