ইসলামী জীবন-ধারা মহিলার সাজ-সজ্জা আবদুল হামীদ ফাইযী ১ টি

মহিলার মাথার কেশ একটি প্রকৃতিগত সৌন্দর্য। সুকেশিনী নারী মুগ্ধ করে তার স্বামীর চক্ষু ও মন। সুতরাং সেই সৌন্দর্যেরও আদব রয়েছে ইসলামে। কেশবিন্যাসে মহিলার সিঁথি হবে মাথার মাঝে। এই অভ্যাসের বিরোধিতা করে সে মাথার এক সাইডে সিঁথি করতে পারে না।[1] সাধারণতঃ বাঁকা সিঁথির এ ফ্যাশন দ্বীনদার মহিলাদের নয়।

আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘‘দুই শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামবাসী হবে যাদেরকে এখনো আমি দেখিনি। তন্মধ্যে প্রথম শ্রেণী হল সেই লোক, যাদের সঙ্গে থাকবে গরুর লেজের মত চাবুক; যার দ্বারা তারা লোকেদেরকে প্রহার করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হল সেই মহিলাদল, যারা কাপড় পরা সত্ত্বেও যেন উলঙ্গ থাকবে, (যারা পাতলা অথবা খোলা লেবাস পরিধান করবে।) এরা (পর পুরুষকে নিজের প্রতি) আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও (তার প্রতি) আকৃষ্ট হবে; তাদের মাথা হবে হিলে যাওয়া উটের কুজের মত। তারা জান্নাত প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধ এত-এত দূরবর্তী স্থান হতে পাওয়া যাবে।’’[2]

উক্ত হাদীসে ‘মাইলাত’ (আকৃষ্টা)র ব্যাখ্যায় অনেকে বলেছেন, যারা মাথার একপাশে বাঁকা সিঁথি কাটে। যা সাধারণতঃ বেশ্যাদের অভ্যাস।[3]

বেণী বা চুঁটি গেঁথে মাথা বাঁধাই উত্তম। খোঁপা বা লোটন মাথার উপরে বাঁধা অবৈধ। পিছন দিকে ঘাড়ের উপর যদি কাপড়ের উপর তার উচ্চতা ও আকার নজরে আসে তবে তাও বৈধ নয়। মহিলার চুল বেশী বা লম্বা আছে -একথা যেন পরপুরুষে আন্দাজ না করতে পারে। যেহেতু নারীর সুকেশ এক সৌন্দর্য; যা কোন প্রকারে বেগানার সামনে প্রকাশ করা হারাম।[4]

অনুরূপ কারণে বৈধ নয় গাডার বা ক্লিপ দিয়ে সমস্ত চুলকে পিছন দিকে টাইট করে গোড়ায় বেঁধে ঘোড়ার লেজের মত উঁচু করে ছেড়ে রাখা।

প্রিয় রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘আমার শেষ যামানার উম্মতের মধ্যে কিছু এমন লোক হবে যারা ঘরের মত জিন্ (মোটর গাড়ি) তে সওয়ার হয়ে মসজিদের দরজায় দরজায় নামবে। (গাড়ি করে নামায পড়তে আসবে।) আর তাদের মহিলারা হবে অর্ধনগ্না; যাদের মাথা কৃশ উটের কুঁজের মত (খোঁপা) হবে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ করো। কারণ, তারা অভিশপ্তা!’’[5] এ ভবিষ্যৎবাণী যে কত সত্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না!

মাথার ঝরে-পরা-কেশ মাটিতে পুঁতে ফেলা উত্তম। যেহেতু বিশেষ করে মহিলার চুল উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ হলে তা যুবকদের মন কাড়ে। পরন্তু ঐ চুল নিয়ে যাদুও করা যায়। তাই যেখানে-সেখানে না ফেলাই উচিত।[6] মহিলার চুল ও কেশদাম অমূল্য সম্পদ, তা বিক্রয় করা বৈধ নয়। মহিলারা পাকা চুলে খেযাব বা কলপ ব্যবহার করতে পারে। তবে কালো রঙের কলপ ব্যবহার হারাম। বাদামী, সোনালী, লালচে প্রভৃতি কলপ দিয়ে রঙাতে পারে। তবে তাতে যেন কোন হিরোইন বা কাফের নারীর অনুকরণ বা বেশধারণ উদ্দেশ্য না হয়।[7]

সতর্কতার বিষয় যে, এক প্রকার মোটা কলপ চুলে দিলে, গোসলের সময় চুলে পানি পৌঁছে না। সুতরাং তা থাকা অবস্থায় ফরয গোসল শুদ্ধ হবে না।

সিঁথিতে সিঁদুর দিতে এই জন্য পারে না যে, সালাফ মহিলাগণ সিঁথিতে রঙ ব্যবহার করেননি। তাছাড়া তাতে বিজাতির অনুকরণ হবে। যেহেতু কোন কোন ধর্মের মহিলাদের ধর্মীয় অভ্যাস ছিল যে, বিবাহের পর সতীত্ব প্রমাণের জন্য প্রথম রমণে সতীচ্ছদ ছিন্ন হওয়ার ফলে ক্ষরিত রক্ত কপালে লাগিয়ে দেখাতো। যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে রক্তের বদলে সিঁদুর প্রচলিত হয়ে যায়। অতএব মুসলিম মহিলার জন্য তা ব্যবহার করা বৈধ নয়।

ইসলামে বিবাহিতা-অবিবাহিতা চেনার কোন উপায় নেই। তা চিনে কোন ফায়দাও নেই। তাছাড়া সে তো অচেনাদের কাছে পর্দার অন্তরালে অবস্থান করবে। অতএব সে সব চিহ্ন দেখার সুযোগই কোথায়?

মহিলাদের মাথার চুল নেড়া করা হারাম। অবশ্য সৌন্দর্যের জন্য সামনের বা পিছনের কিছু চুল ছাঁটা অবৈধ নয়। তবে তা কোন হিরোইন বা কাফের মহিলাদের অনুকরণ করে তাদের মত অথবা পুরুষদের মত করে ছেঁটে ‘ডিয়ানা-কাট’, ‘লায়ন-কাট’, ‘র‌্যাট-কাট’, ‘সাধনা-কাট’, ‘হিপ্পি-কাট’ ইত্যাদি অবৈধ।[8]

তাছাড়া সুদীর্ঘ কেশদাম সুকেশিনীর এক মনোলোভা সৌন্দর্য, যা ছেঁটে নষ্ট না করাই উত্তম।[9]

স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে - অর্থের অপচয় না হলে - মেশিন দ্বারা চুল কুঁচকানো বা থাক্থাক্ করা বৈধ।[10] তবে তা কোন পুরুষ সেলুনে অবশ্যই নয়। মহিলা সেলুনে মহিলার নিকট এসব বৈধ।[11]

কেশ বেশী দেখাবার উদ্দেশ্যে কৃত্রিম চুল বা পরচুলা (টেসেল) অথবা বস্ত্রখন্ড বা তুলোর বল আদি ব্যবহার হারাম, স্বামী চাইলেও তা মাথায় লাগানো যাবে না। প্রিয় রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘যে নারী তার মাথায় এমন চুল বাড়তি লাগায় যা তার মাথার নয়, সে তার মাথায় জালিয়াতি সংযোগ করে।’’[12]

হুমাইদ বিন আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি মুআবিয়া (রাঃ) এর হজ্জের বছরে মিম্বরের উপর তাঁকে বলতে শুনেছেন। তিনি এক প্রহরীর হাত থেকে এক গোছা পরচুলা নিয়ে বললেন, ‘হে মদীনাবাসী! কোথায় তোমাদের উলামাগণ? আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর মুখে শুনেছি, তিনি এ জিনিস ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন, ‘‘বনী ইসরাঈল তখনই ধ্বংস হল যখনই তাদের মেয়েরা এই (পরচুলা) ব্যবহার শুরু করল।’’[13]

ইবনুল মুসাইয়িব (রাঃ) কর্তৃক এক বর্ণনায় আছে যে, হযরত মুআবিয়া মদীনায় এসে আমাদের মাঝে ভাষণ দিলেন। আর (তারই মাঝে) এক গোছা পরচুলা বের করে বললেন, ‘ইয়াহুদীরা ছাড়া অন্য কোন (মুসলিম) ব্যক্তি এ জিনিস ব্যবহার করে বলে আমার ধারণা ছিল না। আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর নিকট এই (পরচুলা ব্যবহারের) খবর পৌঁছলে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন, ‘জালিয়াতি!’[14]

যে মেয়েরা মাথায় পরচুলা লাগিয়ে বড় খোঁপা প্রদর্শন করে আল্লাহ রসূল (ﷺ) তাদের উপর অভিসম্পাত করেছেন।[15]

একজন মহিলা রাসুল (ﷺ) কে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার মেয়ের হাম হয়েছিল। যার ফলে তার মাথার চুল (অনেক) ঝরে গেছে। আর তার বিয়েও দিয়েছি। অতএব তার মাথায় পরচুলা লাগাতে পারি কি?’ রসূল (ﷺ) বললেন, ‘‘পরচুলা যে লাগিয়ে দেয় এবং যার লাগিয়ে দেওয়া হয় এমন উভয় মহিলাকেই আল্লাহ অভিশাপ করেছেন।’’

অন্য এক বর্ণনায় আছে, হযরত আসমা বলেন, ‘যে অপরের মাথায় পরচুলা বেঁধে দেয় এবং যে নিজের মাথায় তা বাঁধে, এমন উভয় মহিলাকেই রাসুল (ﷺ) অভিশাপ করেছেন।’[16]

অবশ্য কোন মহিলার মাথায় যদি আদৌ চুল না থাকে, তবে ঐ ত্রুটি ঢাকার জন্য তার পক্ষে পরচুলা ব্যবহার বৈধ।[17]

[1]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮২৭

[2]. মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/২১২৮

[3]. শারহুন নওবী দ্রঃ

[4]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮৩০, ফাতাওয়াল মারআহ ৯৪পৃঃ

[5]. আহমাদ ২/২২৩, ইবনে হিববান, ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/২৬৮৩

[6]. ফাতাওয়াল মারআহ ৯৯পৃঃ

[7]. আল-ফাতাওয়াল মুহিম্মাহ, লিনিসাইল উম্মাহ ২৫পৃঃ, তামবীহাতুল মু’মিনাত, সালেহ আল ফাউযান ৩০পৃঃ

[8]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮২৬-৮৩১, ফাতাওয়াল মারআহ ১০৭-১১১পৃঃ

[9]. ফাতাওয়াল মারআতিল মুসলিমাহ ২/৫১২-৫১৫

[10]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮২৯

[11]. আল-ফাতাওয়াল মুহিম্মাহ, লিনিসাইল উম্মাহ ১৩পৃঃ, রাখুঃ ১০৩পৃঃ

[12]. সহীহুল জা’মে হা/২৭০৫

[13]. মালেক, বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৩৪৬৮, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/২১২৭, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ

[14]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৫৯৩৮

[15]. সহীহুল জা’মে হা/৫১০৪

[16]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৫৯৪১, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/২১২২, ইবনে মাজাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/১৯৮৮

[17]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮৩৬, ফাতাওয়াল মারআহ ৮৩পৃঃ