হতাশা মানুষকে মরিয়া (ফবংঢ়বৎধঃব) করে তোলে। এতে মানুষ উগ্রতায় নিপতিত হয়। মুমিন সমকালীন পরিস্থিতি দেখে ইসলামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে এরূপ মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন। ইসলাম বিপন্ন বলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। পোপের নির্দেশে ও অনুপ্রেরণায় ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ, ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও বিনা-হিসাবে জান্নাত গমনের উন্মাদনা নিয়ে সমগ্র ইউরোপ একত্রিত হয়ে ১০৯৫ খৃ/৪৮৮ হি থেকে প্রায় ২ শত বৎসর বর্বর ক্রুসেড যুদ্ধ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে। পঙ্গপালের মত মিলিয়ন মিলিয়ন ধর্মযোদ্ধা ক্রুশ উচিয়ে মুসলিম দেশগুলিতে ঝাপিয়ে পড়েছে, নারী, পুরুষ ও শিশু-সহ লক্ষলক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং একের পর এক মুসলিম দেশ দখল করে নিয়েছে। ক্রুসেডারগণ দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, কয়েক বছরের মধ্যেই তারা মক্কা ও মদীনা দখল করে ইসলামকে চিরতরে নির্মুল করবেন। সমাজ সচেতন মুসলিম ও ‘দায়ী’গণ অনেকেই ভেবেছেন, ইসলাম বুঝি বিপন্ন। কিন্তু ইসলাম বিপন্ন হয় নি। পাপ, অনাচার, জুলুম, দলাদলি ও হানাহানিতে লিপ্ত মুসলিমগণ শাস্তি পেলেও ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। মুসলিমদের ঐক্য ও প্রস্ত্ততি ছিল না। তার পরও মুসলিমগণ আগ্রাসী ক্রুসেডারদের সকল মুসলিম ভূমি থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। উপরন্তু ক্রুসেড যুদ্ধের পরে এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমান্বয়ে মুসলিমগণ পূর্ব ইউরোপের প্রায় অর্ধাংশ অধিকার করতে সক্ষম হন। ক্রুসেডারগণ চেয়েছিলেন ইসলামকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুছে দিতে। কিন্তু এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ইউরোপে স্থায়ীভাবে তার আসন গেড়েছে।
ক্রুসেড যুদ্ধের পরেই পূর্ব থেকে তাতার আক্রমন শুরু হয়েছে। অকল্পনীয় বর্বর সে আক্রমনের সামনে একের পর এক মুসলিম দেশের পতন হয়েছে। লক্ষলক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ধ্বংস হয়েছে সম্পদ ও মানব ঐতিহ্য। মুসলিমগণ ভেবেছেন, ইসলাম বুঝি শেষ। কিন্তু পাপ, অনাচার ও বিচ্ছিন্নতায় আকণ্ঠ লিপ্ত মুসলিম সমাজের মানুষেরা শাস্তি পেলেও ইসলাম শেষ হয় নি। যে সময়ে তাতারদের হাতে ইরান, ইরাক, সিরিয়া অন্যান্য দেশের মুসলিমগণ নিহত হচ্ছেন, সে সময়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের অগণিত মানুষ ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আগমন করছেন। সর্বোপরি যে বর্বর তাতার জাতি অমানবিক আক্রোশে মুসলিম দেশগুলি ধ্বংস করেছে, মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং সারা বিশ্বে ইসলামী বিজয়ের ঝান্ডাকে এগিয়ে নিতে থাকে। মানব ইতিহাসের এ এক অলৌকিক বিষয়। একটি বিজয়ী জাতি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটি বিজিত জাতির ধর্ম গ্রহণ করে সে ধর্মের বিজয় তরান্বিত করতে লাগল!
অনুরূপভাবে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে মুসলিম দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ককে পরাজিত করে ক্রুসেডারগণ ভেবেছিলেন যে, ইসলামের রাজনৈতিক পরিচিতি মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে এবং অচিরেই মিশনারি কর্ম ও ধর্মান্তরের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মও বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে চিন্তা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীন মুসলিম দেশগুলিতে পুনরায় ইসলামী জাগরণ ও ইসলমী জীবনব্যবস্থার দিকে ফিরে যাওয়ার আহবান জোরদার হতে থাকে। এ দাবী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হৃদয় স্পর্শ করে। তখনই এ দাওয়াতকে ‘‘উগ্রতা’’-র পথে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন ও অন্যান্য ইসলামী দাওয়াতী কর্মকান্ডকে জামাল আব্দুন নাসির ক্ষমতায় আরোহণের জন্য ব্যবহার করেন। এরপর অতর্কিত নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে এ সকল দাওয়াতী কর্মকান্ডকে উগ্রতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এতে জনপ্রিয় দাওয়াত জনবিচ্ছিন্ন উগ্রতায় পর্যবসিত হতে থাকে। যখন দাওয়াতের নেতৃবৃন্দ একে মধ্যপন্থায় আনতে চেষ্টা করেন, তখন আবার ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ ধরনের উগ্র দল সৃষ্টি করে আলিম, আল্লাহর পথে দাওয়াতদানকারী ও ধার্মিক মানুষদেরকে এবং ইসলামী জাগরণকে জনগণের কাছে ঘৃণ্য ও জনবিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চলে।
১৯৮৮-১৯৯২ সালে আলজেরিয়ায় ইসলামী দাওয়াত জনপ্রিয়তা লাভ করে। জাতীয় নির্বাচনে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইসলামপন্থীদেরকে উগ্রতার পথে ঠেলে দেওয়া হয়। আবেগতাড়িত হয়ে তারা অস্ত্র ও সহিংসতার পথে পা বাড়ায়। আর এর ফলে জনপ্রিয় একটি আন্দোলন জনবিচ্ছিন্ন ও জনধিকৃত সন্ত্রাসে রূপান্তরিত হয়। এভাবে সর্বদা জনপ্রিয় দীনী দাওয়াতকে উগ্রতার মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্নন ও জনধিকৃত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রয়োজেন উগ্রতার প্রচারকদের রোপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহর পথে আহবানকারীদের সতর্ক হতে হবে।
জামাআতুল মুসলিমীনের কর্মকান্ড থেকে মিসর ও ইস্রায়েল সরকার সকল সুবিধা গ্রহণ করেছেন, কিন্তু দীনী দাওয়াত নির্বিচার নিপীড়ন ও নির্যাতন ছাড়া কিছুই পায়নি। ৯/১১ বা ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলা থেকে আমেরিকার নব্য-রক্ষণশীলগণ ও যায়নবাদী ইহদীগণ সকল প্রকার সুবিধা লাভ করেছেন, কিন্তু মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনুরূপ ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ বা ‘‘৯/১১’’ তৈরির চেষ্টা বারংবারই করা হবে। এর ক্ষপ্পরে যেন আবেগী যুবকগণ না পড়েন তা নিশ্চিত করতে দীন প্রতিষ্ঠা বা দীনী দাওয়াতের সুন্নাত-সম্মত পদ্ধতি এবং বিভ্রান্তির উৎসগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
কোনো অবস্থাতেই হতাশ হওয়া বা দ্রুত ফল লাভের চেষ্টা করা মুমিনের কর্ম নয়। মুমিনের দায়িত্ব কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে নিজের দায়িত্ব পালন করা। কোনো মুসলিম রাষ্ট্র জিহাদের শর্ত পূরণ করে জিহাদের আহবান করলে সম্ভব হলে সে জিহাদে শরীক হওয়া। আর সর্বাবস্থায় কুরআন ও সুন্নাতের নির্দেশানুসারে সাহাবীগণ ও পরবর্তীগণের কর্মধারার আলোকে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, ও বিনম্রতার সাথে দীনের দাওয়াত এগিয়ে নেওয়া।
ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা দেখি যে, সুন্নাতের আলোকে সাহাবীগণের পন্থাই ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের সঠিক পন্থা। অন্যায় পরিবর্তনের আবেগ, দ্রুত ফল লাভের উদ্দীপনা বা অন্যায়ের প্রতি অপ্রতিরোধ্য ঘৃণা ইত্যাদির কারণে আবেগী হয়ে যারা সন্ত্রাস, সহিংসতা বা যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছেন তারা ইসলামের কোনো কল্যাণ করতে পারেন নি। খারিজীগণ, বাতিনীগণ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের অনুসারীদের অনেক গরম ও আবেগী কথা বলেছেন এবং অনেক ‘পরিবর্তনের’ স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু তারা স্বল্প সময়ের কিছু ফিতনা ছাড়া কিছুই করতে পারেন নি। পক্ষান্তরে মধ্যপন্থা অনুসারী আলিমগণ বিদ্রোহ, উগ্রতা, শক্তিপ্রয়োগ, জোরপূর্বক সরকার পরিবর্তন ইত্যাদি পরিহার করে শান্তি-পূর্ণভাবে জনগণ ও সরকারকে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের মাধ্যমে যুগে যুগে মুসলিম সমাজের অবক্ষয় রোধ করেছেন।