আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, খিলাফতে রাশিদার পর থেকে সকল ইসলামী রাষ্ট্রেই রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী বিধিবিধানের কমবেশি লঙ্ঘন ঘটেছে। শাসক নির্বাচন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের পরামর্শ গ্রহণ, জনগণের নিকট জবাবদিহিতা, মানবাধিকার, আমানত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আইন প্রয়োগ ইত্যাদি অগণিত ইসলামী নির্দেশনা কম বা বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে এসকল রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসকগণ নিজেদেরকেই আইন বা আইনদাতা বলে মনে করেছেন। কুরআনী বিধিবিধান ও আইনকে বেপরোয়াভাবে অবহেলা করেছেন। এমনকি সালাতের সময়ও পদ্ধতিও পরিবর্তন করা হয়েছে।
এ সকল পরিস্থিতিতে সাহাবীগণ কিভাবে সংস্কার, প্রতিবাদ ও দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেছেন তা আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ কুরআন-সুনণাহর নির্দেশনা অনুধাবনে ও পালনে তাঁরা উম্মাতের অনুকরণীয় আদর্শ। মহান আল্লাহ বলেন:
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘‘মুহাজির ও আনসারদিগের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এ মহাসাফল্য।’’[1]
এখানে মুমিনগণকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে: (১) প্রথম অগ্রগামী মুহাজিরগণ ও আনসারগণ এবং (২) তাঁদের পরবর্তীগণ। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, প্রথম ভাগের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তাদের জন্য জান্নাত প্রস্ত্তত করেছেন। আর দ্বিতীয় ভাগের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের পূর্বশত প্রথম শ্রেণীর সাহাবীগণকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করা। এভাবে আমরা দেখছি যে, অগ্রগামী মুহাজির ও আনসারগণের অনুসরণ সফলতার মাপকাঠি। তাদের অনুসরণের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ছিলেন তাদের সমসাময়িক অন্যান্য সাহাবী। এরপর তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ীগণ।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে তাঁর সাহাবীদের জীবন পদ্ধতি ও মতামতের উপর নির্ভর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। এক্ষেত্রে তোমাদের দায়িত্ব আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরবে, কোনো প্রকারেই তার বাইরে যাবে না। আর তোমরা (আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের বাইরে) নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে; কারণ সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদ‘আত এবং সকল বিদ‘আতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।’’[2]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদেরকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মতবিরোধ সম্পর্কে সতর্ক করেন। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, এক্ষেত্রে কোন্ দল সঠিক বলে গণ্য হবে? তিনি বলেন:
ما انا عليه (اليوم) واصحابى
‘‘আমি এবং আমার সাহাবী-সঙ্গীরা বর্তমানে যে মত ও পথের উপর আছি সেই মত ও পথের উপর যারা থাকবে তারাই সুপথপ্রাপ্ত।’’[3] সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী- এ তিন প্রজন্মের মানুষদের ধার্মিকতার প্রশংসা করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। ইমরান ইবনু হুসাইয়িন (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خيرُ أُمَّتِي قَرْنِي (الذى بعثت فيهم) ثُمَّ الذين يَلُونَهُمْ ثمَّ الذين يَلُونَهُمْ
‘‘আমার উম্মতের সবচেয়ে ভালো যুগ আমার যুগ, যে যুগের মানুষের মধ্যে আমি প্রেরিত হয়েছি (অর্থাৎ সাহাবীগণ), আর তাদের পরে সবচেয়ে ভালো তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ (অর্থাৎ তাবিয়ীগন), আর এর পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ (অর্থাৎ তাবি তাবিয়ীগণ)’’।[4]
এ অর্থে আবূ হুরাইরা, বুরাইদা আসলামী, নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে পৃথক পৃথক সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো হাদীসে সাহাবীগণের পরে তিন প্রজন্মের কথা বলা হয়েছে।[5]
এজন্য কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা সঠিক অনুধাবন ও বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে সাহাবীগণের কর্মধারা এবং তৎপরবর্তী তিন প্রজন্মের কর্মধারা বিবেচনা করতে হবে। উমাইয়া যুগে সাহাবীগণ রাষ্ট্র ও সরকারের এরূপ বিচ্যুতি প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু কখনোই তারা এ কারণে ‘রাষ্ট্র’ বা সরকারকে কাফির বা অনৈসলামিক বলে গণ্য করেন নি। বরং তাঁরা সাধ্যমত এদের অন্যায়ের আপত্তি জ্ঞাপন-সহ এদের আনুগত্য বহাল রেখেছেন। এদের পিছনে সালাত আদায় করেছেন এবং এদের নেতৃত্বে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন।
পরবর্তীকালেও কোনো ইমাম, ফকীহ বা আলিম এ কারণে এ সকল রাষ্ট্রকে ‘দারুল হরব’ বা ‘কাফির রাষ্ট্র’ বলে মনে করেন নি। তারা সাধ্যমত সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও সংহতি বজায় রেখেছেন।[6] তাঁরা সর্বদা শান্তিপূর্ণ পন্থায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে উৎসাহ দিতেন এবং জিহাদ বা আদেশ-নিষেধের নামে অস্ত্রধারণ, আইন-লঙ্ঘন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার উস্কানি ইত্যাদি নিষেধ করতেন। এ বিষয়ে তাঁদের অগণিত নির্দেশনা হাদীসগ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়েছে।[7] সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে কখনো কখনো তাঁদের কেউ কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তবে তা রাষ্ট্রকে কাফির মনে করে বা ‘‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য নয় বরং অন্যান্য পারিপার্শিক কারণে তা ঘটেছে।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৪৪; আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/২০০; ইবনু মাজাহ ১/১৫। তিরমিযী বলেন হাদিসটি হাসান সহীহ।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮; মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মুখতারাহ ৭/২৭৮; আলবানী সহীহু সুনানিত তিরমিযী ৬/১৪১ নং ২৬৪১।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৩৫।
[5] ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, বুহুসুন ফী উলূমিল হাদীস, পৃ. ৩০-৩২।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৩৪, ২৬৫৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯; ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩৭৯-৩৮৮।
[7] ইভবু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৭/৫০৮; দানী, আস-সুনানুল ওয়ারিদাতু ২/৩৮৮-৪০৫।