ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ৩. বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৮. ৬. রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বনাম কুফ্রীর প্রতি সন্তুষ্টি

‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’-এর নেতৃবৃন্দ বলেন, এ সকল দেশের নাগরিকবৃন্দ যেহেতু আল্লাহর আইন অমান্যকারী রাষ্ট্রের ও সরকারের সাথে সহযোগিতা করেন, রাষ্ট্রের নির্বাচনে অংশ নিয়ে এসকল কাফিরদেরকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেন এবং এদের অধীনে চাকরী করেন, সেহেতু এ সকল দেশের সকল নাগরিকই কাফির বলে গণ্য। এখানে তারা পাপীর সাথে সহযোগিতা ও পাপে সহযোগিতার মধ্যে পার্থক্য না করে দুটি বিষয়কে এক পর্যায়ের বলে দাবি করেছেন। এরপর পাপের সহযোগিতার অভিযোগে সাধারণ মুসলিম জনসাধারণকে কাফির বলে দাবি করেছেন। তাদের বিভ্রান্তি অনুধাবন করতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি লক্ষণীয়:

(ক) কুরআন-হাদীসে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব বা অন্তরঙ্গ ভালবাসার বন্ধন তৈরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। কয়েকটি আয়াত দেখুন:

لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً

‘‘মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণ ব্যতীত কাফিরদিগকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর।’’[1]


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ


‘‘হে মু’মিনগণ, তোমরা ইয়াহূদী ও খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে।’’[2]


لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ


‘‘তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায় যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধচারীদেরকে, হোক না এ বিরুদ্ধচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা বা তাদের জ্ঞাতি গোত্র।’’[3]

আরো অনেক আয়াতে এ বিষয়ে তাকিদ দেওয়া হয়েছে। এ সকল আয়াতের আলোকে প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব, তার হৃদয় ও কর্মকে নিয়ন্ত্রন করা, যেন কাফির সম্প্রদায়ের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা হৃদয়ে স্থান না পায় এবং ভালবাসা প্রকাশক কোনো কর্ম যেন সে না করে। তবে একথা সুস্পষ্ট যে, ভালবাসা মূলত হৃদয়ের কর্ম। কাজেই কারো কোনো কর্মকেই নিশ্চিতরূপে ‘কুফরীর প্রতি বা কাফিরের প্রতি ভালবাসা’ বলে নিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করা যায় না, যতক্ষণ না তার সস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হয়। এজন্য শুধু কাফিরদের সাথে সুসম্পর্ক, সহযেগিতা বা এরূপ কোনো কাজের ভিত্তিতে কাউকে কাফির বলা যায় না। ইসলামের প্রধান শত্রু মক্কাবাসীদের কাছে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর মক্কা আক্রমনের গোপন তথ্য ফাঁস করে হাতিব (রা) পত্র লিখেছিলেন। তার কর্ম নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও তার রাসূলের শত্রুদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশক। কিন্তু শুধু কর্মের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে কাফির বলে ঘোষণা দেন নি। বরং তার কর্মের উদ্দেশ জানতে চেয়েছেন এবং তার ওযর কবুল করেছেন। এমনকি তাকে তাওবা করার নির্দেশও দেন নি।[4]

(খ) জাগতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা কখনোই ‘ভালবাসা’ বা বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ কাফিরদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। তাদের অধীনে চাকরী করেছেন। ইউসূফ (আঃ) মিসরের মুর্তি-পূজারী ফির‘আউনের দেশে তারই রাজত্বে তারই অধীনে চাকরী করেছেন।

(গ) পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশগুলির শাসক, প্রশাসক বা সরকারকে ইহূদী, খৃস্টান বা মুশরিকদের মত কাফির মনে করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। এদের কারো কর্ম কঠিন পাপ বা কুফরী হলেও, এদের সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা কুফরী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই কাফির বলা যায় না। এরূপ সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বহাল রাখা এবং ইসলামবিরোধী নয় এরূপ বিষয়ে তার আনুগত্য করাই ইসলামের নির্দেশ। উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,


إنه يُسْتَعْملُ عليكُم أمراءُ فتَعْرِفونَ وتُنْكِرونَ فمن كرهَ فقد برئ ومن أنكرَ فقد سلمَ ولكن من رضىَ وتابعَ قالوا : يا رسولَ اللهِ ! ألا نقاتلهم ؟ قال : لا ما صلّوا


‘‘অচিরেই তোমাদের উপর অনেক শাসক প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় ও অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে এ সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না।)’’ সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বলেন, ‘‘না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।’’[5]

যদি কোনো নাগরিক তার সরকারের অন্যায় সমর্থন করেন, অন্যায়ের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সরকারের অনুসরণ করেন তবে তিনি তার সরকারের পাপের ভাগী হবেন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা, চাকরী, কর্ম বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের কারণে কোনো নাগরিক পাপী হবে না। আউফ ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,


ألا مَن وُلِّي عليه والٍ، فرآه يأتي شيئًا من معصيةِ الله، فليَكرَه ما يأتي من معصيةِ الله، ولا ينزعَنَّ يدًا من طاعة


‘‘তোমরা হুশিয়ার! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক বা প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না।’’[6]
অন্য বর্ণনায়:


إذا رأيتُم مِن وُلاتِكم شيئًا تَكْرَهُونَه ، فاكْرَهوا عمَلَه ولا تنْزِعوا يدًا مِن طاعَةٍ


‘‘যখন তোমরা তোমাদের শাসক-প্রশাসকগণ থেকে এমন কিছু দেখবে যা তোমরা অপছন্দ কর, তখন তোমরা তার কর্মকে অপছন্দ করবে, কিন্তু তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিবে না।’’[7]

[1] সূরা আল-ইমরান, ২৮ আয়াত।

[2] সূরা মায়িদা, ৫১ আয়াত।

[3] সূরা মুজাদালা, ২২ আয়াত।

[4] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৯৫; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৪১।

[5] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৮০, ১৪৮১।

[6] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৮২।

[7] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৮১।