জামাআতুল মুসলিমীনও প্রাচীন খারিজীদের মত দাবি করে যে, মুসলিম দাবিদার যদি ইসলামের কোনো অনুসাশন লঙ্ঘন করে তবে সে কাফির হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ্য করি যে, তারা মূলত রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকেই কাফির বলেন। বড় ফরয ও ছোট ফরযে তত্ত্ব দিয়ে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বড় ফরয বলে দাবি করে সে অযুহাতে ছোট ফরয নাম দিয়ে তারা অনেক ফরয ইবাদত বর্জন করত এবং হারাম কর্মে লিপ্ত হতো, যেগুলি কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টতই পাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ পাপের কারণে তারা অনেক আলিম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বকে কাফির-মুরতাদ ফতওয়া প্রদান করে তাদের হত্যা করেছে। যেমন ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ’’ বা ‘‘তাগূতী’’ সরকারকে সহযোগিতা করে বা মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে কাফির হয়ে গিয়েছেন বলে দাবি করে তারা সুপ্রসিদ্ধ আলিম ও গবেষক ড. যাহাবীকে হত্যা করে।
খারিজীগণ ‘‘হুকম’’ বা বিধান প্রদানকে তাদের মতবাদের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করে। তারা তাদের মতবাদ প্রমাণের জন্য (إن الحكم إلا لله) অর্থাৎ ‘‘হুকুম কেবলমাত্র আল্লাহরই জন্য’’- কুরআনের এ বাণীটিকেই মূলত পেশ করে। এ বাণীর ভিত্তিতে কখনো তারা (لا حاكم إلا لله) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হাকিম (হুকমদাতা, আইনদাতা বা ফয়সালাকারী) নেই’’ কথাটিকে (لا اله الا الله) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইল্লাহ (মাবূদ বা উপাস্য) নেই’’ কথাটির মত তাওহীদ ও ঈমানের মূল ভিত্তি হিসাবে গণ্য করেছে। কখনো তারা (لا اله الا الله) আল্লাহ ছাড়া কোনো ইল্লাহ নেই’’ কালিমাটির অর্থ করেছে ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হাকিম বা হুকুমদাতা নেই’’। অর্থাৎ তার ইল্লাহ মানেই ‘‘হাকিম’’ বা ‘‘হুকুমদাতা’’ বলে দাবি করেছে।
এভাবে তারা দাবি করত যে, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম দানের অধিকার নেই এ কথা বিশ্বাস করাই ঈমান। আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম দেওয়ার অধিকার প্রদান করা বা কারো বিধান মানাই কুফর। আর পাপ মানেই তো আল্লাহ ছাড়া অন্যের হুকুম মানা। কারণ মানুষ শয়তান, নিজ প্রবৃত্তি বা অন্য কারো হুকুমেই আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। তাদের এ সকল দাবি সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রন। এজন্য এ বিষয়ে আলী (রা) বলতেন:
(كلمة حق أريد بها الباطل)
‘‘একটি সত্য কথাকে বাতিল অর্থে পেশ করা হচ্ছে’’।[1]
বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদের রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের দুটি দিক আমাদের ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করা প্রয়োজন। তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত (প্রতিপালনের একত্ব) ও তাওহীদুল উলূহিয়্যাত (ইবাদতের একত্ব) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে।[2] এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, আল্লাহর তাওহীদের দুটি দিক রয়েছে: রবব বা প্রতিপালক হিসেবে তার একত্ব এবং ইল্লাহ বা উপাস্য হিসেবে তার একত্ব। রবব বা প্রতিপলক হিসেবে তার একত্বের মধ্যে রয়েছে তাঁর মহান গুণাবলির একত্ব।
উক্ত গ্রন্থে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ‘‘রবব’’ বলা যায়, কিন্তু ‘‘ইল্লাহ’’ বলা যায় না। ‘ইল্লাহ’ অর্থ উপাস্য বা মাবূদ। যাকে উপাসনা, আরাধনা বা অলৌকিকভাবে ভক্তি করা হয় তাকেই ইল্লাহ বলা হয়। এজন্য আরবের মানুষেরা সূর্যকে ‘ইলাহাহ’ বলত। এছাড়া কুরআনে মুর্তি ও প্রতিমাসমূহকে ইল্লাহ বলা হয়েছে। মুশরিকগণ এগুলির আনুগত্য করত না বা এগুলিকে হুকুমদাতা, আইনদাতা বা বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করত না। বরং এগুলিকে আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গলে বিশেষ ক্ষমতা বা সুপারিশের মালিক বলে বিশ্বাস করে সাজদা, প্রণতি, মানত, প্রার্থনা ইত্যাদি কর্মের মাধ্যমে এগুলির ইবাদত, বন্দনা বা পূজা করত।
হুকুম বা নির্দেশ প্রদান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের অংশ। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ‘আল্লাহর মত হাকিম’ হতে পারেন না, কিন্তু হাকিম হতে পারেন। কিন্তু কেউ আল্লাহর মত বা আল্লাহর চেয়ে নিম্নমানের মাবূদ হতে পারে না। কুরআন কারীমে অনেক স্থানে বলা হয়েছে যে, ‘‘হুকুম শুধু আল্লাহরই’’[3] এবং একমাত্র আল্লাহকেই ‘‘হাকিম’’ বা ‘‘হাকাম’’ বা হুকুমদাতা বা ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[4] আবার অনেক স্থানে আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে হুকুম, নির্দেশ, বিধান ও ফয়সালা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং মানুষকে হাকিম বা হাকাম অর্থাৎ হুকুমদাতা, বিধানদাতা বা ফয়সালাদাতা হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি নবী-রাসূলগণকে ‘‘হুকম’’ বা বিধান ও রায় প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছেন।[5]
আল্লাহ বলেন:
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا
‘‘আর তোমরা যদি তাদের (স্বামী-স্ত্রীর) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন হুকুমদাতা (বিচারক) এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন হুকুমদাতা (বিচারক) পাঠাও। যদি তারা মিমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।’’[6]
এখানে মহান আল্লাহ মানুষের মধ্য থেকে বিধানদাতা নিয়োগের নির্দেশ প্রদান করেছেন, যারা নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের আলোকে এ বিষয়ে বিধান প্রদান করবেন। এছাড়া অন্যান্য স্থানে জাগতিক বিষয়াদিতে মানুষদেরকে বিধান প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[7]
এভাবে আমরা দেখছি যে, ‘‘হাকিম’’ বা ‘‘হাকাম’’ মহান আল্লাহর পবিত্র গুণবাচক নামসমূহের অন্যতম। এগুলি তাঁর রুবূবিয়্যাতের গুণাবলির অন্যতম। তবে ইল্লাহ অর্থ ‘হাকিম’ বা ‘বিধানদাতা’ নয়। ইল্লাহ অর্থ মাবূদ। আমরা একটু পরে ইবাদত ও আনুগত্যের পার্থক্য আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। ইবাদত বিষয়ক শিরক-কুফর আর হুকুম বিষয়ক শিরক-কুফর এক নয়। হুকুম বিষয়ক শিরক-কুফর সম্পর্কে আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি।[8]
ইসলামে আল্লাহ ছাড়া কাউকে কোনোভাবে ইবাদত করার বা ইবাদত গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় নি। আল্লাহর পক্ষ থেকে, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে, অধস্তন হিসেবে বা অন্য কোনোভাবে কেউ ইবাদত পেতে পারে না বা মাবূদ হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে বা নিজের স্বকীয়তার সাথে অন্য কেউ ‘‘হাকিম’’ হতে পারে বা হুকুম দিতে পারে। মানুষকে হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান, রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাইতুল মালের সম্পদে শাসকের যথেচ্ছ অধিকার প্রদান ইত্যাদি কুরআন বিরোধী বা ‘মানব রচিত’ আইনের কারণে খারিজীগণ আলী (রা), মু‘আবিয়া (রা) ও পরবর্তী শাসকদেরকে কাফির বলেছে। অনুরূপভাবে শুকরী ও তার অনুসারীরা উপনিবেশ-উত্তর মুসলিম দেশগুলির শাসকদেরকে ‘ইসলাম-বিরোধী’ আইন প্রচলনের জন্য কাফির বলে ঘোষণা করে। মিশরের সকল প্রসিদ্ধ আলিম এদের এ সকল কথার বিভ্রান্তি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীন সংগঠনের নেতা হাসান হুদাইবী। তাদের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:[9]
প্রথমত: মানুষের জন্য আইন রচনা নিষিদ্ধ নয়। আল্লাহর দীন সকল যুগের সকল দেশের সকল মানুষের জন্য। এজন্য এর মধ্যে ব্যাপক প্রশস্ততা দান করেছেন আল্লাহ। সুনির্দিষ্ট কিছু বিধিবিধান ও মূলনীতি ছাড়া বাকি সকল ক্ষেত্রে দেশ, জাতি ও যুগের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় আইনকানুন ও বিধিবিধান তৈরির সুযোগ ও নির্দেশ আল্লাহ মানুষদেরকে প্রদান করেছেন।
দ্বিতীয়ত: ‘মানব রচিত’ সকল আইনই ইসলাম বিরোধী নয়। মুসলিম দেশগুলিতে কিছু ঔপননেবশিক আইন-কানুন রয়েছে যেগুলি ইসলাম বিরোধী, এছাড়া অধিকাংশ আইন ও বিচারপদ্ধতি ইসলাম সম্মত।
তৃতীয়ত: আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান মত ফয়সালা না করাকে কুফরী বলা হলেও কুরআনে আল্লাহর বিধানের বিপরীত ফয়সালাকারীকেও মুমিন বলা হয়েছে। সাহাবীগণ ও মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ বলেন যে, যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামী বিধানানুসারে বিচার করা অপ্রয়োজনীয় অথবা ইসলামী আইনকে অচল বা বাতিল মনে করেন তবে তিনি কাফির বলে গণ্য হবেন। পক্ষান্তরে তিনি যদি ইসলামের নির্দেশকে সঠিক জেনেও অজ্ঞতা, ভয়, লোভ, বাধ্যবাধকতা বা অনুরূপ কোনো জাগতিক কারণে ইসলাম বিরোধী ফয়সালা দেন তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে না। যেমন, মদ ইসলামে হারাম ও মদপান প্রমাণিত হলে বেত্রাঘাতের বিধান দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি ইসলামের বিধান জানার পরেও মদ বৈধ মনে করেন অথবা মদপানের জন্য শাস্তি প্রদানকে আপত্তিকর বা অমানবিক মনে করেন তবে তিনি কাফির বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ মদের অবৈধতা বিশ্বাস করেন এবং মদপানের জন্য শাস্তি দেওয়াই সঠিক বলে মনে করেন, কিন্তু প্রচলিত আইনে সুযোগ না থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মদপানকারীকে শাস্তি দিতে অপারগ হন, অথবা জাগতিক কোনো প্রাপ্তি, লোভ বা স্বার্থের জন্য শাস্তি না দেন তবে তিনি পাপী বলে গণ্য হবেন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। কেউ যদি ইসলামের বিধানকে অচল, আপত্তিকর বা অমানবিক মনে করে তা রহিত করে আইন প্রণয়ন করে তবে তা কুফরী। অথবা কেউ যদি মনে করেন যে, আল্লাহ যে বিধানই প্রদান করুন না কেন, আমাদের অধিকার আছে আল্লাহর হারামকে হালাল করা বা হালালকে হারাম করা, তবে তিনিও কাফির বলে গণ্য হবেন। আর যদি কেউ ইসলামের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে, বা ইসলামের বিধানকে সঠিক বিশ্বাস করা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রচলিত ইসলাম বিরোধী আইনগুলি ব্যক্তিগত বা দলগত অসুবিধা বা স্বার্থে পরিবর্তন না করেন তবে তিনি পাপী বলে গণ্য হবেন।
চতুর্থত: আধুনিক বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ- যেমন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির মধে ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়াদি রয়েছে। আবার এ সকল মতবাদের মধ্যে ইসলাম সমর্থিত অনেক বিষয় আছে। অজ্ঞতা ও আবেগের কারণে আধুনিক রাজনৈতিক মতবাদকে ‘‘কুফরী’’ বলার একটি উদাহরণ ‘‘গণতন্ত্র’’-কে কুফরী মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা। ইসলাম ও গণতন্ত্র উভয় বিষয়ের প্রগাঢ় অজ্ঞতাই এরূপ মতপ্রকাশের কারণ। গণতন্ত্রের প্রয়োগ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন রকম হলেও গণতন্ত্রের মূল প্রেরণা ইসলামের। গণতন্ত্র ইসলামের শূরা বা পরামর্শ ব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগের একটি পথ। তবে ইসলামের নির্দেশ বাতিল বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা গণপ্রতিনিধিদের আছে বলে বিশ্বাস করা কুফর। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, ইসলাম যে রাষ্ট্রব্যবস্থা দিয়েছে তাকে আধুনিক পরিভাষায় ‘‘গণতান্ত্রিক’’ বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আল্লাহ মানবজাতিকে জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন পরিচয়ের জন্য। জাতির প্রতি প্রেম, দায়িত্ববোধ ও জাতীয় পরিচয়ের গৌরব অর্থে জাতীয়তাবাদ ইসলমের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। মানুষ পিতামাতাকে যেমন ভালবাসে, তেমনি ভালবাসে নিজের দেশ ও জাতিকে। পিতামাতা বা দেশজাতির প্রতি ভালবাসা আল্লাহ, তাঁর রাসূল (ﷺ) ও ইসলামের প্রতি ভালবাসার অন্তরায় নয়। তবে যদি যদি কেউ পিতামাতা বা দেশজাতির ভালবাসা ও পরিচয়কে আল্লাহ, তাঁর রাসূল (ﷺ) ও ইসলামের প্রতি ভালবাসা ও ইসলামী পরিচয়ের চেয়ে বড় মনে করে তবে তা তার ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মরিপেক্ষতার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, ধর্মকে সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ন্যায়বিচার, প্রশাসন, অর্থ ও রাষ্ট্রসংশিষ্ট ধর্মীয় বিধানগুলি বাতিল, অচল বা প্রয়োগঅযোগ্য বলে বিশ্বাস করা। প্রথম বিষয়টি ইসলাম নির্দেশিত ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও দ্বিতীয় বিষয়টি ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ও কুফর।
এভাবে আমরা দেখছি যে, বিভিন্ন আধুনিক রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় মতবাদের মধ্যে ভাল ও মন্দ রয়েছে। এগুলির মধ্যে বিদ্যমান ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী বিষয়াদির সমালোচনা করা মুমিনের দায়িত্ব। কিন্তু এগুলির কারণে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাফির বলা মুমিনের জন্য ভয়ঙ্কর বিষয়। মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ ইতিহাসে এ ধরনের মতবাদের চেয়েও সুস্পষ্ট কুফরী মতবাদে বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তি বা ফিরকাকেও সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও মূলধারার আলিমগণ কাফির বলে গণ্য করেন নি। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করে হলেও কাউকে মুমিন বলা সুযোগ রয়েছে বা ব্যাখ্যা করে হলেও তার কুফরী কথা বা মতকে কুফরী নয় বলে গণ্য করার সুযোগ রয়েছে ততক্ষণ তারা কাউকে কাফির বলেন নি।[10]
সকল ক্ষেত্রে যিনি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন, তার ইসলাম বিরোধী কাজের কারণে তাকে কাফির বলা যায় না। তিনি যদি এমন কাজ করেন, কথা বলেন বা মত গ্রহণ করেন যা কুফরী হতে পারে আবার পাপও হতে পারে, তবে কাজটিকে পাপ বলেই মনে করতে হবে, কুফরী মনে করা যাবে না, যতক্ষণ না তিনি নিজে স্পষ্টভাবে তার কুফরীর কথা ঘোষণা করবেন। এমনকি তার ‘মুনাফিকী’ বা মিথ্যাচার বুঝা গেলেও সেই বুঝ দ্বারা তার সম্পর্কে বিধান প্রদান করা যাবে না, বরং তার বাহ্যিক কথার উপরেই নির্ভর করতে হবে।[11]
সর্বোপরি, রাষ্ট্র, সরকার, শাসক, বিচারক বা কোনো ব্যক্তিকে কাফির বলা বা তার কর্মকে কুফরী বলা এক কথা আর তাকে শাস্তি দেওয়া, বিচার করা বা কোনোভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া অন্য কথা। দুএর মধ্যে আসমান ও যমিনের দূরত্ব। একমাত্র রাষ্ট্র ছাড়া কেউ বিচার করতে পারে না বা শাস্তি দিতে পারে না। রাষ্ট্র তার এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে ব্যক্তি বা দল সে জন্য রাষ্ট্রকে আহবান করবে, দাবি করবে ও পরিবর্তনের চেষ্টা করবে, কিন্তু কখনোই আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না।
[2] কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৮২-১১৪, ৩৬৬-৫১৭।
[3] সূরা (৬) আনআম: আয়াত ৫৭; সূরা (১২) ইউসুফ: আয়াত ৪০ ও ৬৭; সূরা (২৮) কাসাস: ৭০ ও ৮৮।
[4] সূরা (৬) আনআম: আয়াত ১১৪।
[5] সূরা আল ইমরান ৭৯ আয়াত; সূরা আনআম ৮৯; সূরা মারইয়াম: ১২ আয়াত; সূরা জাসিয়াহ: ১৬ আয়াত।
[6] সূরা (৪) নিসা: আয়াত ৩৫।
[7] সূরা (৫) মায়িদা: ৯৫ আয়াত।
[8] কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৮২-১১৪, ৩৬৬-৫১৭।
[9] ড. হাসান হুদাইবি, দুআতুন লা কুদাত; সালিম বাহনসাবী, আল-হুকুম ওয়া কাদিয়্যাতু তাকফীরিল মুসলিম ও মুহাম্মাদ সুরুর ইবন নাইফ যানুল আবিদীন, আল-হুকুম বিগাইরি মা আনযালাল্লাহ ওয়া আহলুল গুলূ। ড. নাসির ইবনু আব্দুল কারীম আল-আকল, আল-খাওারিজ, পৃ: ১৩২-১৪১, ড. আহমদ মুহাম্মাদ জলি, দিরাসাতুন আনিল ফিরাক, পৃ. ১০৮-১৪৯।
[10] কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃ. ৫৯৭-৫৯৮।
[11] বিস্তারিত দেখুন: ইসলামী আকিদা, পৃ. ৫১৭-৫২২।