খারিজী, বাতিনী ও অন্যান্যদের ভুলভ্রান্তির একটি মৌলিক বিষয় জিহাদ। জিহাদ বিষয়ক ভুলভ্রান্তিগুলির কয়েকটি দিক রয়েছে:
৩. ৭. ১. জিহাদ শব্দের অতি-ব্যবহার
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, জিহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম। আর ইসলামী শরীয়তের পারিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘‘কিতাল’’ বা রাষ্ট্র ও ইসলামী দাওয়াতের নিরাপত্তার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ। আল্লাহর নির্দেশ ও হুকুম-আহকাম পালনের সকল প্রচেষ্টাকেই শাব্দিক অর্থে জিহাদ বলা যায়, কিন্তু আভিধানিক অর্থের অতিব্যবহার পারিভাষিক অর্থের বিকৃতির সুযোগ করে দেয়। যেমন ‘সালাত’-এর আভিধানিক অর্থ প্রার্থনা। যে কোনো প্রার্থনাকেই সালাত বলা যায় এবং কুরাআন-হাদীসে কখনো কখনো তা বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় ‘সালাত’ একটি নির্দিষ্ট ইবাদাতের নাম। সকল প্রার্থনাকেই সালাত বলে নামকরণ করলে তা দ্বিমুখি বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে। প্রথমত কেউ হয়ত যে কোনোভাবে প্রার্থনা করেই ‘সালাত’ কায়েম হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করবেন। দ্বিতীয়ত, কেউ সালাতের ফযীলত বা আহকামের আয়াত ও হাদীসগুলি সকল প্রার্থনার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করবেন।
কেউ যদি নিজের জীবনে দীন পালন, আত্মশুদ্ধির চেষ্টা, ইলম শিক্ষা, হালাল উপার্জন, আল্লাহর পথে দাওয়াত, অত্যাচারীর সামনে সত্য-ভাষণ, হজ্জ পালন বা দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রচেষ্টাকে জিহাদ বলেন তবে তা দূষণীয় নয়, বরং তা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এগুলিকে পারিভাষিক ‘‘জিহাদ’’ মনে করা হলে তা বহুমুখি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে জিহাদের ফযীলত ও আহকামসমূহ এ সকল ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রবণতা দেখা দেবে। কোনো কোনো আধুনিক গবেষক ও চিন্তাবিদ ইসলামী রাজনীতি বা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব বুঝাতে ‘‘জিহাদ’’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘‘জামাআতুল মুসলিমীন’’ এরূপ ব্যবহারকে তাদের বিভ্রান্তির সমর্থনে ব্যবহার করেছে।
‘‘ইসলামী রাজনীতি’’ বা ‘‘ইসলামী আন্দোলন’’-এর মাধ্যমে ‘‘দীন প্রতিষ্ঠা’’ নামে মুমিন যে ইবাদতটি পালন করেন সে ইবাদতটির পারিভাষিক নাম হলো ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ বা ‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’’। এ কর্মকে ‘‘জিহাদ’’ বলায় অসুবিধা নেই। তবে এ কর্মই কুরআন-হাদীস নির্দেশিত পারিভাষিক জিহাদ বা বলে মনে করার মধ্যে রয়েছে সমূহ বিপদ। আমরা বলেছি যে, ইসলামের পরিভাষায় ‘‘জিহাদ’’ অর্থই ‘‘কিতাল’’ বা যুদ্ধ। সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও ইমামগণের ব্যবহারে এবং ফিকহ, তাফসীর বা ইসলামী জ্ঞানের যে কোনো প্রাচীন গ্রন্থে ‘‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ তালাশ করলেই পাঠক তা জানতে পারবেন। বর্তমানে অনেক আধুনিক গবেষক ‘‘ইসলামী রাজনীতি’’ বা ‘‘ইসলামী আন্দোলন’’-কে ‘‘জিহাদ’’ নামে আখ্যায়িত করেন এবং একেই ইসলামী শরীয়তের পারিভাষিক জিহাদ বলে গণ্য করেন। অনেকে পারিভাষিকভাবে ‘‘জিহাদ’’ ও ‘‘কিতাল’’-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। কিতালকে যুদ্ধ এবং জিহাদকে আন্দোলন বলে মনে করেন। এরূপ মতামত গবেষণা বা ব্যাখ্যা হিসেবে কেউ পেশ করতে পারেন। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের পারিভাষা বলে গণ্য করার কারণে এবং রাজনীতি, দাওয়াত, আন্দোলন ইত্যাদিকে সদা-সর্বদা জিহাদ বলে আখ্যায়িত করার কারণে ত্রিমুখি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে:
প্রথমত, দাওয়াত, রাজনীতি, আন্দোলন ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত মানুষ শরীয়ত নিদের্শিত ‘‘জিহাদ’’ ইবাদতটি পালন করছেন বলে ধারণা করছেন এবং হাদীসে ও ফিকহে জিহাদের যে সকল বিধান, সুন্নাত ও আদব বর্ণনা করা হয়েছে তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও পালনীয় বলে মনে করছেন।
দ্বিতীয়ত, প্রচলিত রাজনীতি, আন্দোলন বা দলবদ্ধ দাওয়াতের সাথে সংশিষ্ট না হয়ে যারা ব্যক্তিগতভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে ওয়ায, লিখনী, শিক্ষাদান ইত্যাদি পদ্ধতিতে ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ বা ‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের’’ ইবাদতটি পালন করছেন তারা শরীয়তের পারিভাষিক ‘‘জিহাদ’’ নামক ইবাদতটি পালন করছেন না বলে মনে করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত, প্রচলিত রাজনীতি, আন্দোলন বা দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে শরীয়তের পারিভাষিক জিহাদ বলে বিশ্বাস করে এ জন্য বলপ্রয়োগ, অস্ত্রধারণ ও অনুরূপ বিধানকে বৈধ বলে মনে করা হচ্ছে। আমি ‘‘এহইয়াউস সুনান’’ গ্রন্থে এ সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1]
বিশেষত তৃতীয় বিভ্রান্তিটি উগ্রতার জন্ম দিচ্ছে। যে সকল আলিম বা গবেষক এ সকল কর্মকে জিহাদ নামে আখ্যায়িত করছেন তাঁরা মূলত এগুলির গুরুত্ব বুঝাতে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আভিধানিক অর্থে তা করছেন। কোনো আলিম যখন দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, আন্দোলন, রাজনীতি, মিছিল ইত্যাদিকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেন, তখন তিনি বুঝান না যে, এ কর্মের জন্য অস্ত্র ধারণ করা যাবে, অথবা এর বিরোধীদেরকে আঘাত করা যাবে। কিন্তু তিনি না বুঝালেও শ্রোতা, পাঠক বা সংশিষ্ট অনেকেই তা বুঝছেন। জামাআতুল মুসলিমীন ও উগ্রতায় লিপ্ত অন্যান্য মানুষের লিখনি ও বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, সমকালীন আলিম ও গবেষকদের এ সকল বক্তব্য থেকে তারা এরূপই বুঝেছেন। এ সকল বক্তব্য থেকে তারা বুঝেছেন যে, মানুষদেরকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হলো জিহাদ। আর জিহাদ হলে তো মারামারি, অন্ত্রধারণ, যুদ্ধ ও হত্যা হবেই। বস্ত্তত, উগ্রতার ভিত্তি দুটি বিষয়ের উপর:
প্রথমত, জিহাদই ইসলাম প্রচার বা প্রতিষ্ঠার পথ বলে দাবি করা।
দ্বিতীয়ত, জিহাদের জন্য অস্ত্রধারণ, হত্যা, মৃত্যুবরণ ইত্যাদিকে বৈধ বা আবশ্যকীয় বলে দাবি করা।
কুরআন-হাদীস ও ইসলামের ইতিহাস থেকে দ্বিতীয় বিষয়টি প্রমাণ করা তাঁদের জন্য খুবই সহজ বিষয়। এজন্য তাঁদের বিভ্রান্তির মূল উৎস প্রথম বিষয়ের মধ্যে নিহিত। আমরা দেখেছি যে, পারিভাষিক ‘জিহাদ’ কখনোই ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়। জিহাদ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও নাগরিক ও দীনী দাওয়াতের নিরাপত্তা রক্ষার মাধ্যম। কিন্তু জিহাদ শব্দের অতি-ব্যবহারে ফলে অনেকের মনেই বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, জিহাদই দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ বা একমাত্র পথ এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করা সকলের জন্য ফরয।
জঙ্গিদের প্রচারকর্ম এতে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তারা কিছু সরলপ্রাণ আবেগী যুবককে সহজেই একথা বুঝাতে পারছে যে, জিহাদই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রথম ফরয, জিহাদ ছাড়া ইসলাম কায়েম হবে না। আর জিহাদ মানেই তো অস্ত্র, যুদ্ধ ও হত্যা, কাজেই এখনই আমাদের সে কাজে নেমে পড়তে হবে। এভাবেই গুরুত্বারোপের জন্য একটি পরিভাষার আভিধানিক অর্থের অতিব্যহার বিভিন্ন বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করছে।
পক্ষান্তরে দীন প্রতিষ্ঠার এ সকল কর্মকে ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ নামে আখ্যায়িত করলে একদিকে যেমন সঠিক ইসলামী পরিভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে উপর্যুক্ত ত্রিবিধ অস্পষ্টতা বা বিভ্রান্তির পথ রুদ্ধ হবে, তেমনি অন্যদিকে এ সকল ইবাদত পালনের সঠিক সুন্নাত ও ইসলামী আদব জানা সহজ হবে। কারণ দীন প্রতিষ্ঠার এ সকল কর্মকে সর্বদা জিহাদ বলে আখ্যায়িত করার ফলে আগ্রহী মুমিন এ সকল কর্মের ইসলামী নির্দেশনা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)ও সাহাবীগণের সুন্নাত ও ইসলামী আদব জানার জন্য হাদীস ও ফিকহের ‘‘জিহাদ’’ অধ্যায় অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেন, ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ বা ‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’’ অধ্যায় অধ্যয়নের কথা তার মনে আসে না।
আমরা আশা করি যে, দীনী দাওয়াতের এ সকল ময়দানে যারা কর্মরত এবং এ সকল বিষয়ে যারা গবেষণা করছেন, তারা এ সকল কর্মকান্ডের পারিভাষিক পরিচয় নিশ্চিত করবেন। এগুলিকে ‘‘ন্যয়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’’ বা ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ নামে আখ্যায়িত করলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী দাওয়াতের আবেগ ও জযবাকে বিপথগামী করার বা সহিংসতায় পর্যবসিত করার একটি বড় পথ রুদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়। মহান আল্লাহই ভাল জানেন এবং তিনিই তাওফীক দাতা।