ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ৩. বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৪. রাষ্ট্রীয় ফরয বনাম ব্যক্তিগত ফরয

ইসলম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এজন্য কুরআন ও হাদীসে মানব জীবনের সকল দিকের বিধিবিধান বিদ্যমান। কোনো বিধান ব্যক্তিগতভাবে পালনীয়, কোনো বিধান সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। প্রত্যেক বিধান পালনের জন্য নির্ধারিত শর্তাদি রয়েছে। কুরআনে ‘সালাত’ প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার কুরআনে ‘চোরের হাত কাটার’, ‘ব্যভিচারীর বেত্রাঘাতের’ ও জিহাদ বা কিতালের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ইবাদতটি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। অন্য কেউ পালন না করলেও মুমিনকে ব্যক্তিগভাবে পালন করতেই হবে। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ নির্দেশটি ‘রাষ্ট্রীয় ভাবে’ পালনীয়। কখনোই একজন মুমিন তা ব্যক্তিগতভাবে বা দলগতভাবে পালন করতে পারেন না।
এখানে লক্ষণীয় যে, কোনো ইবাদতের শর্তাবলি কুরআনে একত্রে বা একস্থানে উল্লেখ করা হয় নি। এছাড়া অধিকাংশ ইবাদতের সকল শর্ত কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। কুরআন ও হাদীসের সামগ্রিক বিধান বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সামগ্রিক জীবন ও এ সকল নির্দেশ পালনে তাঁর রীতি-পদ্ধতি থেকেই সেগুলির শর্ত ও পদ্ধতি বুঝতে হবে। তা নাহলে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। মহান আল্লাহ বলেন:


أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ


‘‘সূর্য হেলে পড়ার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে।’’[1]
এ নির্দেশের উপর নির্ভর করে যদি কেউ সূর্যাস্তের সময় সালাতে রত হন তবে তিনি নিজে যতই দাবি করুন, মূলত তা ইসলামী ইবাদাত বলে গণ্য হবে না, বরং তা পাপ ও হারাম কর্ম বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদীস শরীফে ‘সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাত্রি পর্যন্ত’ সময়ের মধ্যে সালাত আদায়ের বৈধ ও অবৈধ সময় চিহ্নিত করেছেন এবং সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় অবৈধ করেছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষার বাইরে মনগড়াভাবে কুরআন কারীমের অর্থ বা ব্যাখ্যা করা আমাদেরকে ইবাদতের নামে পাপের মধ্যে লিপ্ত করে। অনুরূপভাবে কুরআনে ‘শাস্তি’ ও ‘কিতালের’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআন-হাদীসে এ ইবাদত পালনের অনেক শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ যদি সেগুলি পূরণ না করে হত্যা, রক্তপাত ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হয়ে এগুলি জিহাদ বলে দাবি করেন, তবে তা কখনোই ইসলামী ইবাদাত বলে গণ্য হবে না, বরং তা হবে কঠিন পাপ ও হারাম কর্ম।

শর্ত পূরণ ছাড়া সালাত পালনের চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর পাপ শর্ত পূরণ ছাড়া শাস্তি, বিচার বা হত্যায় লিপ্ত হওয়া। সালাত ও বিচার-হত্যার মধ্যে পার্থক্য হলো, সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় করলে উক্ত ব্যক্তি গোনাহগার হলেও, তাতে কোনো বান্দার হক নষ্ট হবে না। কিন্তু বিচার, শাস্তি ও কিতালের সাথে ‘বান্দার’ হক জাড়িত। কারো ভীতি প্রদর্শন, রক্তপাত বা সম্পদ নষ্ট করা কঠিনতম কবীরা গোনাহ, যা সংশি­ষ্ট ব্যক্তির ক্ষমা ছাড়া আল্লাহ ক্ষমা করেন না। কোনো মানুষকে হত্যার বিষয়ে সামান্য সহযোগিতা বা চোখের ইশারাও ভয়ঙ্কর পাপ বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই রাষ্ট্রীয় অবকাঠামের মধ্যে আইনানুগ বিচারের বাইরে বা রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশে শত্রুবাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে ঘোষিত ও আইনানুগ যুদ্ধের বাইরে যদি কেউ হত্যা, আঘাত, ভয় প্রদর্শন, সম্পদ-ধ্বংস ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হন, তবে ইবাদত কবুল না হওয়া এবং গোনাহগার হওয়া ছাড়াও তিনি বান্দার হক্ক নষ্ট করার ভয়ঙ্করতম পাপে লিপ্ত হবেন।

[1] সূরা: ১৭ বানী ইসরাঈল, ৭৮ আয়াত।