আমরা উল্লেখ করেছি যে, বাতিনী শিয়াগণ মূলত কুরআন, হাদীস ও আলিমগণের মতামত কোনোকিছুই মানত না। তাদের একমাত্র দলীল ছিল কথিত ইমাম বা তাদের খলীফাগণের ব্যাখ্যা ও মতামত। খারিজীগণ ও জামাআতুল মুসলিমীন কুরআন ও হাদীসের উপর নির্ভরতার ঘোষণা দেয়। তারা তাদের সকল মতামতের প্রমাণ কুরআন ও হাদীস থেকে পেশ করার চেষ্টা করে। তবে তাদের প্রমাণ পেশের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো পছন্দনির্ভরতা। তারা যে আয়াত বা হাদীসকে নিজেদের পক্ষে বলে মনে করত সেগুলিকে গ্রহণ করত। আর যেগুলি তাদের মতের বিপক্ষে সেগুলিকে মানসূখ বা রহিত বলে অথবা ব্যাখ্যা করে বাতিল করত।
কখনো কুরআন বুঝার জন্য ‘‘শানে নুযূল’’ বা অবতরণের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে অস্বীকার করত। আবার কখনো অবতরণের প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে কোনো আয়াতের সাধারণ নির্দেশনা মানতে অস্বীকার করত। কখনো আধুনিক কোনো গবেষক বা প্রসিদ্ধ আলিমের কোনো কোনো বক্তব্যকে তারা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে তাদের উগ্রতা প্রমাণের চেষ্টা করত। আবার কখনো কোনো আলিমের কথাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করাকে তারা শিরক বলে দাবি করত।
‘নাসখ’ একটি সুপরিচিত ইসলামী পরিভাষা। এর অর্থ রহিত হওয়া। মহান আল্লাহ কুরআন নাযিল করার মাধ্যমে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের অনেক বিধান রহিত করেছেন। এ ছাড়া কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন বিধিবিধান আংশিক বা পুরোপরি রহিত করে অন্য বিধান প্রদান করেছেন। তবে সাধারণভাবে আলিমগণ কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অর্থের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য ‘নাসখ’ পরিভাষা ব্যবহার করেন। অর্থাৎ এ আয়াতের নির্দেশ গ্রহণ করতে হবে অন্য অমুক আয়াতের সাথে সমন্বয় করে। এ দ্বার তারা বুঝান না যে, কুরআনে পঠিত কোনো আয়াতের বিধান বা আদেশ পুরোপুরি বাতিল বা অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। কারণ কুরআনের প্রতিটি আয়াত মুতাওয়াতির বা অগণিত মানুষের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর নিকট সংরক্ষিত। এর কোনো বিধান, বাক্য, অক্ষর বা অর্থকে রহিত দাবি করতে হলে ঠিক অনুরূপ মুতাওয়াতির কোনো নির্দেশনা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে প্রমাণিত হতে হবে। এ ছাড়া কুরাআনের কোনো নির্দেশ রহিত বলে গণ্য করা যায় না।
যেমন কুরআনে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, ধর্মের বিষয়ে জবরদস্তি নেই। আবার আল্লাহ যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কোনো কোনো আলিম বলেছেন যে, যুদ্ধের নির্দেশ দ্বারা জবরদস্তির নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়েছে। কথাটির অর্থ হলো ধর্মের মধ্যে জবরদস্তি নেই বলতে ধর্মীয় স্বাধীনতা বা অধিকার রক্ষার জন্যও যুদ্ধ করা যাবে না এরূপ মর্ম রহিত হয়েছে। এর অর্থ এ নয় যে, আয়াতটির নির্দেশনা রহিত হয়েছে। ইসলাম কখনোই বলপূর্বক ধর্মান্তর বা ধর্মের কারণে কারো নাগরিক অধিকার হরণের অনুমতি দেয় নি। জিহাদ, কিতাল বা যুদ্ধ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য, বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য নয়। রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর যুগে বা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে তো নয়ই, পরবর্তী যুগেও ইসলাম গ্রহণের জন্য বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে নি।
জামাআতুল মুসলিমীন বা সমকালীন খারিজীগণ কুরআনকে তাদের সকল মতের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করলেও তাদের মতের ব্যতিক্রম আয়াত বা নির্দেশনাকে ‘রহিত’ বা মানসূখ বলে দাবি করত। তাদের এরূপ দাবির পক্ষে তারা কুরআন বা হাদীসের কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারত না। তবে কোনো কোনো আলিমের মতকে তারা প্রমাণ হিসেবে পেশ করত। জামাআতুল মুসলিমীন পূর্ববর্তী ইমাম ও আলিমগণের বিষয়ে অত্যন্ত খারাপ মন্তব্য করত এবং দীনের বিষয়ে কোনো আলিমের কথাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করাকে অবৈধ বলে দাবি করত। কিন্তু নাসখ বিষয়ক মতামতের ক্ষেত্রে ও অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজন মত তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন আলিমের মতামত পেশ করত। সর্বোপরি তারা অন্য কোনো আলিমের মতামত গ্রহণকে অপছন্দনীয় মনে করলেও তাদের নিজেদের মত গ্রহণকে অন্যদের জন্য বাধ্যতামূলক বলে মনে করত। দীনের বিষয়ে তাদের বুঝ বা মতামতকেই একমাত্র সত্য দীন বলে বিশ্বাস করত। তাদের পছন্দ নির্ভরতার একটি বিশেষ দিক ছিল, সমকালীন বিভিন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্বের বক্তব্য ও লিখনিকে পছন্দমত দলীল হিসেবে পেশ করা। এ সকল গবেষক ও আলিম সমকালীন সমাজগুলির অবক্ষয় বুঝাতে অনেক সময় এগুলিকে ‘‘জাহিলী’’ বা ‘‘তাগূতী’’ বলেছেন। এদ্বারা তারা এগুলিকে কাফির বলে বুঝান নি। কিন্তু এরা তা বুঝেছে। কেউ কেউ সমাজ পরিবর্তনের কর্মকে ‘‘জিহাদ’’ বলেছেন বা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন। এদ্বারা তারা বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন মাত্র; এ জাতীয় কর্মকে শরীয়তের পারিভাষিক জিহাদ বা শরীয়তের মাপকাঠিতে সবচেয়ে বড় ফরয বলে বুঝান নি। কিন্তু তারা তা বুঝেছে। কোনো কোনো গবেষক ও আলিম আল্লাহকে ইল্লাহ হিসেবে মান্য করার সাথে আল্লাহর আইন মান্য করার বিষয়টি সংযুক্ত করেছেন। এদ্বারা তারা বুঝান নি যে, ইল্লাহ মানেই হুকুম দাতা বা হুকুম না মানলেই কুফরী হয়। কিন্তু এরা তাদের মতপ্রতিষ্ঠায় এদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে। আবার তারা এ সকল আলিমের অন্য অনেক মত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তাদের ভুল ব্যাখ্যার সংশোধনে অন্যান্য আলিমের মতামতও প্রত্যাখ্যান করেছে।
এখানে পছন্দ-নির্ভরতা ছাড়াও তাদের বিভ্রান্তির কারণ ছিল, কোনো আলিম বা গবেষকের বক্তব্যকে আক্ষরিকভাবে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা। মুমিন মূলত কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য আক্ষরিকভাবে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করবেন। সুন্নাতে নববী ও সুন্নাতে সাহাবার আলোকে তা বুঝতে চেষ্টা করবেন। পরবর্তী ইমাম, ফকীহ ও আলিমদের বক্তব্য ও মতামতের সহযোগিতা নিবেন।