উপরের মতটির সম্পূরক বা কাছাকাছি একটি মত হলো, সমকালীন বিশ্বের সকল অশাস্তি, যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অন্যতম কারণ ফিলিস্তিনে ইস্রায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, মধ্যপ্রাচ্যের তেল, মুসলিম দেশগুলির সম্পদ ও ভৌগলিক অবস্থান ও ইউরোপআমেরিকার উগ্র ধর্মভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী নব্য রক্ষণশীল (neoconservatives) বা নিওকনদের আবির্ভাব ও আধিপত্য। পবিত্র বাইবেল থেকে জানা যায় যে, ফিলিস্তিনে ইহূদীদের অবস্থান বিশ্বে অশান্তির অন্যতম কারণ। বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে আল্লাহ ইস্রায়েল-সন্তানগণকে আল্লাহর বিধান পালন ও মানবজাতির কল্যাণের বিনিময়ে ফিলিস্তিনে তাদের বাসস্থান প্রদানের ওয়াদা করেন। কিন্তু পুরোহিতদের বিকৃতির কারণে তারা এ ওয়াদাকে তাদের জাতিগত সম্পদ বলে গণ্য করে এবং আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। ইস্রায়েল-সন্তানগণ খৃস্টপূর্ব ১২৮৫ সালের দিকে মূসা (আঃ)-এর নেতৃত্বে মিসর থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। প্রায় আড়াইশত বৎসর বিভিন্ন স্থানে বসবাসের পর খৃস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে তালুতের এবং এরপর দাউদের (আঃ) নেতৃত্বে তারা ফিলিস্তিনে ইহূদী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। দাউদ (আঃ) ও সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্বকালের প্রায় ৬৫ বৎসর এ রাজ্য ভালভাবে চলে। সুলাইমানের (আঃ) ইন্তেকালের পরে তাঁর রাজত্ব দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। পরবর্তী প্রায় তিনশত বৎসরের ইতিহাস হলো রাজত্বের উভয় অংশের পারস্পরিক এবং পার্শবর্তী রাজ্যগুলির সাথে তাদের অভাবনীয়- অবর্ণনীয় রক্তারক্তি ও হানাহানির ইতিহাস।
খৃস্টপূর্ব ৬০৬ থেকে ৫৮৭ সালের মধ্যে ব্যাবিলনের শাসক নেবুকাদনেজার কয়েকবার আক্রমনের মাধ্যমে জেরুজালেম সম্পূর্ণ ধ্বংস করেন এবং ইস্রায়েলীয়দেরকে বন্দী করে ব্যাবিলনে নিয়ে যান। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে তারা মুক্তি লাভ করে এবং জেরুজালেমে ফিরে আসে। পরবর্তী প্রায় ৫০০ বৎসর ইস্রায়েলীরা গ্রীক, সিরিয় বা রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে জেরুজালেমে বসবাস করে। সর্বশেষ ১৩৬ খৃস্টাব্দে রোমান সম্রাট হার্ডিয়ান (Hadrian :১১৭-১৩৮) জেরুজালেম ও মসজিদে আকসা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। তিনি ইহূদীদেরকে ফিলিস্তিন থেকে চিরতরে বিতাড়িত করেন। অধিকাংশ ইহূদীকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যান। তিনি ইহূদীদের জন্য জেরুজালেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। শুধু বৎসরে নির্ধারিত একদিন ক্রন্দন করার জন্য আগমনের অনুমতি ছিল তাদের। এ হলো জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনে ইহূদীদের প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাস শুধু রক্তের ইতিহাস। ইহূদীগণ যতদিন জেরুজালেমে ছিল ততদিন এতদাঞ্চলের কোনো মানুষই শান্তিতে থাকতে পারে নি। তারা নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও রক্তারক্তি করেছে, নবী-রাসূলগণকে হত্যা করেছে, পার্শবর্তী দেশগুলিতে রক্তারক্তি ও হানাহানি রফতানি করেছে এবং পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করেছে। ইহূদী-খৃস্টানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বাইবেল থেকে তাদের প্রতারণা, জবরদখল, গণহত্যা, গণধ্বংসযজ্ঞ, অনাচার ও ধর্মদ্রোহিতার ইতিহাস বিস্তারিতভাবো জানা যায়। ইস্রায়েলীয়দের রক্তারক্তি ও হানাহানি এতই অস্বাভাবিক ছিল যে, পার্শবর্তী রাজাগণ তাদের রাজ্য দখল করার পরে একাধিকবার তাদেরকে এলাকা থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়ন করেছেন। বিশ্বের ইতিহাসে জয়পরাজয়ের অনেক ঘটনা রয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বিতাড়নের এরূপ ঘটনা তেমন দেখা যায় না।
খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় দু হাজার বৎসর ইহূদীগণ ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করেছে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে ইউরোপ ও আমেরিকার সহায়তায় হাজার হাজার বৎসর ধরে ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আররদেরকে হত্যা ও বিতাড়ন করে ফিলিস্তিনে আবার ইস্রায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাইবেলের বর্ণনা প্রমাণ করে যে, ফিলিস্তিনে ইহূদীদের প্রথম অবস্থানের প্রায় হাজার বছরে কখনোই তারা পার্শবর্তী কোনো দেশের মানুষদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি। এথেকে বুঝা যায় যে, ফিলিস্তিনে ইস্রায়েলীয়দের অবস্থান এতদাঞ্চলের অশান্তির মূল কারণ। যতদিন তারা তথায় থাকবে ততদিন কোনোভাবেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ তাদের অনাচার, অত্যাচার ও দুবার জেরুজালেম ধ্বংস ও তাদের বিতাড়নের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন:
عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَنْ يَرْحَمَكُمْ وَإِنْ عُدْتُمْ عُدْنَا
‘‘আশা করা যায় যে, তোমাদের রব তোমাদেরকে করুণা করবেন। আর যদি তোমরা প্রত্যাবর্তন কর তবে আমিও প্রত্যাবর্তন করব’’[1]
এ থেকে বুঝা যায় যে, ১৩৬ খৃস্টাব্দে দ্বিতীয় বিতাড়নের পরে, অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর পরে পুনরায় একবার তাদেরকে জেরুজালেমে বসবাসের সুযোগ আল্লাহ দিতে পারেন এবং জেরুজালেমে ফেরার পরে যদি তারা আবার তাদের আগের স্বভাব ও কর্মে ফিরে যায় তাহলে আল্লাহও আবার তাদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করাবেন। কুরআনের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ তাদেরকে আরেকবার করুণা করেছেন। কিন্তু তারা আবারো তাদের পূর্বের স্বভাব ও কর্মে ফিরে গিয়েছে। কাজেই অশাস্তি চলতে থাকবে এবং বিতাড়নের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী থেকেও তা জানা যায়।
আমরা আগেই বলেছি, ফিলিস্তিনে ইহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করেছে। এর সাথে মিলিত হয়েছে নব্য রক্ষণশীলদের ধর্মচিন্তা। ইউরোপে এবং বিশেষ করে আমেরিকায় খৃস্টধমীয় মৌলবাদিতা ও রক্ষণশীলতা ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। যারা খৃস্টধর্মের ইতিহাস জানেন তারা নিশ্চিত জানেন যে, খৃস্টধর্মীয় রক্ষণশীলতার অর্থই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। ইতিহাসের পাঠকগণ জানেন, গ্রীক ও রোমানগণ সর্বদা অন্যান্য মানবগোষ্ঠীকে বর্বর বলে চিত্রিত করেছে এবং একমাত্র তাদের সভ্যতাকেই উন্নত সভ্যতা বলে চিত্রিত করেছে। গ্রীক ও রোমান সভ্যতার উত্তরসূরী ইউরোপ-আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের মানুষেরা এ উন্নাসিকতার উত্তরাধিকার লাভ করেছেন। তারা সর্বদা তাদের সহনশীলতা, উদারতা, পরমতসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ (Pluralism) নিয়ে গর্ব ও গৌরব করেন। তাদের এ বহুত্ববাদ বড় অদ্ভুত! আমেরিকান, বৃটিশ, আইরিশ বা অন্য কোনো দেশের খৃস্টধর্মের অনুসারী কোনো সন্ত্রাসীকে ‘‘খৃস্টান সন্ত্রাসী’’ বললে তারা আহত হন এবং এরূপ বলাকে অসহিষ্ণুতা বলে মনে করেন; কারণ এতে ধর্মপ্রাণ সৎ খৃস্টানগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোনো সন্ত্রাসীকে ‘‘মুসলিম সন্ত্রাসী’’ বলতে অসুবিধা আছে বলে তারা মনে করেন না। উপরন্তু ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করলেও কোনোরূপ অসহিষ্ণুতা হয় বলে তারা মনে করেন না, বরং এরূপ কথার প্রতিবাদই অসহিষ্ণুতা!
এ বহুত্ববাদের কারণে ইসলাম বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে বক্তব্য, কার্টুন, সিনেমা, সাহিত্য ইত্যাদিকে বাকস্বাধীনতা বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ‘এন্টি সেমিটিযম’ (Anti-Semitism) আইনের নামে ইহূদী জাতি ও ধর্ম বিষয়ক ঐতিহাসিক গবেষণা ও মতপ্রকাশ নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় করা হয়েছে, ব্লাসফেমি (Blasphemy) আইনের মাধ্যমে খৃস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে বক্তব্য নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় করা হয়েছে।
এ বহুত্বের শর্ত merge বা একীভূত হওয়া। যে বিষয়কে তারা ‘তাদের নিজস্ব’ বলে গণ্য করবেন তা বিনা বাক্যে মেনে নিয়ে তার মধ্যে একীভূত হলেই কেবল তাদের বহুত্ববাদের কল্যাণ লাভ করা যাবে। আর এর বিপরীত মত, কর্ম, কৃষ্টি বা সভ্যতাকে তারা ‘‘সভ্যতার’’ জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হন। এজন্য যখন তারা ‘‘খৃস্টধর্ম’’-কে তাদের নিজস্ব বলে গণ্য করেছেন তখন ইহূদী ও মুসলিমদের আইন করে দমন, নির্মূল বা ধর্মান্তর করেছেন। অনুরূপভাবে ‘‘খৃস্টধর্ম’’ বিরোধী মতামত প্রকাশকারী সাহিত্যিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও চিন্তাবিদদের দমন ও নির্মূল করেছেন। একই কারণে প্রটেস্ট্যান্টগণ ক্যাথলিকদেরকে এবং ক্যাথলিকগণ প্রটেস্ট্যান্টদেরকে দমন, নির্মূল বা ধর্মান্তর করেছেন। এরূপ বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ ধার্মিক নিও-কনদের আধিপত্য আবার সেই পুরাতন জবরদস্তি, ধর্মান্তর ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কথা মনে করায়।
আর সাম্রাজ্যবাদীদের ধর্ম ও সাম্রাজ্যবাদ হাত ধরাধরি করে চলে। যেখানেই সাম্রাজ্যবাদীরা উপনিবেশ করেছে সেখানেই তারা নানা কৌশলে ধর্মান্তর করতে চেষ্টা করেছে। এখনো এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি মিশনারি আগ্রাসনের প্রস্ত্ততির সংবাদ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তথায় মার্কিন ও বৃটিশ সৈন্যরা এবং তাদের ছত্রছায়ায় অন্যান্য প্রচারক সরাসরি অথবা ‘‘সেবার’’ নামে ধর্মান্তরের বহুমুখি চেষ্টা চালাচেছন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপজাতি ও সংখ্যালঘুদেরকে বিভিন্ন প্রলোভনে খৃস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের তেল নিয়ন্ত্রণ, খৃস্টীয় ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে বিশ্বের ইহূদীদেরকে ফিলিস্তিন-জেরুজালেমে একত্রিত করে যীশুখৃস্টের পুনরাগমনের প্রেক্ষাপট তৈরি এবং মুসলিম দেশগুলিকে অস্থিতিশীল করে তাদের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে একদিকে ফিলিস্তিন, ইরাক ও অন্যান্য দেশে নির্বিচারে নারী, পুরুষ ও শিশুরেদেক গণহারে হত্যা করা হচ্ছে, এ সকল মানবতা-বিরোধী অপরাধের সরব সমর্থনের পাশাপাশি এগুলির বিরুদ্ধে সকল কণ্ঠকে নীরব করে দেওয়া হচ্ছে। বিক্ষুদ্ধ কেউ সন্ত্রাসের পথ বেছে নিলে তাকে ‘‘ইসলামী জঙ্গি’’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বিনা প্রমাণে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনাকে ইসলামী জঙ্গিদের কর্মকান্ড বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ যুবকদের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে তাদেরকে ডেকে এনে অস্ত্র, ট্রেনিং ও সমর্থন দিয়ে জঙ্গি তৈরি করা হচ্ছে। এরপর আর জঙ্গিবাদের অভিযোগে তাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।