বিশ্বের সর্বত্রই সাধারণ আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী দলসমূহ জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করছেন এবং নিন্দা করছেন। সাধারণভাবে তাঁরা উপরের তিনটি কারণকে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ বলে স্বীকার করেন না। রবং তাঁরা দাবি করেন যে, ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণেই জঙ্গিবাদের উত্থান। ইসলামকে কলঙ্কিত করতে, ইসলামী দেশগুলির আর্থ-সামাজিক উন্নতি বন্ধ করতে এবং এ সকল দেশে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতেই তারা গোপন অর্থায়নে কিছু মুসলিম যুবককে বিভ্রান্ত করে এরূপ জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা তাদের এ দাবির পক্ষে প্রমাণ নয় বরং যুক্তি পেশ করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, বোমাবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে কখনো দেখা যায় নি। ‘সভ্যতার সংঘাত’ থিওরি আবিষ্কারের পূর্বে বিগত দেড় হাজার বৎসর ধরে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ‘জিহাদ’ নামে এরূপ সন্ত্রাস কখনোই দেখা যায় নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোথাও কোনো মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে বা দলগত ভাবে কাউকে গুপ্ত হত্যা করেছে, কারো বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছে.... ইত্যাদির কোনো নযির আমরা দেখতে পাই না। ‘সভ্যতার সংঘাত’ থিওরি আবিষ্কারের পরে পাশ্চাত্য বিশ্ব নিজ প্রয়োজনেই এ অবস্থা তৈরি করে নিয়েছে।
ক্রুসেড যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন ইউরোপীয় খৃস্টানগণ। ১ম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পতন ও মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ক্রুসেডের সমাপ্তি হয়েছে বলে ধারণা করেছিলেন তারা। বিংশ শতাব্দীর ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষত সেভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পরে তারা হিসাব নিকাশ পাল্টে ফেলেন। তারা ‘সভ্যতার সংঘাতের’ থিওরী উপস্থাপন করেন। তারা ভালভাবেই উপলব্ধি করেন যে, মুসলিম বিশ্বকে তার নিজের গতিতে অগ্রসর হতে দিলে ২১শ শতকের প্রথমার্ধেই মুসলমানগণ ‘বিশ্ব শক্তিতে’ পরিণত হবে। অর্থনৈতিক স্থিতি, প্রযুক্তিগত শক্তি ও সমর শক্তিতে তারা শক্তিশালী হয়ে যাবে এবং তাদের ‘নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর’ কোনো সুযোগ থাকবে না। মুসলিম উম্মাহকে ঠেকাতে হলে তাদেরকে আঘাত করতে হবে।
কিন্তু আঘাত তো কোনো ‘কারণ’ ছাড়া করা যায় না। স্বভাবতই কোনো মুসলিম দেশই পাশ্চাত্যের সাথে কোনো সংঘাতে যেতে রাজি নয়। কিন্তু সংঘাত না হলেও তো কাজ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বিশেষত দুর্বলকে সংঘাতের মধ্যে নামাতে পারলে বিজয় নিশ্চিত থাকে। এজন্যই তাঁরা এ জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছেন। এছাড়া পাশ্চাত্য বিশ্ব আরো একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তা হলো তাদের দেশগুলির নীরব ‘‘ইসলামায়ন’’।
ইসলাম মানুষের জীবন-ধর্ম। ইসলামের সহজ-সরল বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয় সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। মানুষের প্রকৃতির সাথে এ ধর্ম মিশে একাকার হয়ে যায়। মানব প্রকৃতি অতি সহজেই একে গ্রহণ করে। আধুনিক সভ্যতার নৈতিক অবক্ষয়, অশ্লীলতা, বিলাসিতা ও অমানবিকতার মধ্যে নিপতিত পাশ্চাত্য দেশগুলির অনেক মানুষই ইসলাম গ্রহণ করছেন। ইসলাম সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য জানলেই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। অশ্লীলতা, বিলাসিতা ও মাদকতার প্রসারে ইউরোপ-আমেরিকার পরিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে গিয়েছে এবং তথাকার প্রকৃত ‘‘সাদা’’ অধিবাসীদের জনসংখ্যা দ্রুত কমছে। এ সকল দেশ তাদের শিল্প, কারখানা ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে বাইরের অভিবাসী গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ভাবে প্রতিনিয়ত অনেক মুসলিম এ সকল দেশে প্রবেশ ও বসবাস করছেন। এদের সংস্পর্শে এসে এ সকল দেশের মূল অধিবাসীদের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করছেন। এ ভাবে এসকল দেশে নীরব ইসলামায়ন চলছে। এ ইসলামায়ন ঠেকাতে, মুসলিম অভিবাসীদেরকে নাগরিকত্ব না দিতে, বহিস্কার করতে এবং সর্বোপরি মূল অধিবাসীদেরকে ইসলাম থেকে দূরে রাখতে ইসলাম বিরোধী অপপ্রচার ও ইসলামের ‘‘দানবায়ন’’ অতীব জরুরী। আর এজন্য জঙ্গিবাদ ইসূ অতীব কার্যকর বলে মনে করেছেন তারা। বিশেষত খৃস্টীয় দ্বিতীয় মিলেনিয়ামের শুরু থেকে ক্রুসেড যুদ্ধের প্রস্ত্ততি হিসেবে ইসলাম ধর্ম ও রাসুলুল্লাহ (ﷺ)কে দানব রূপে চিত্রিত করার জন্য ইউরোপের চার্চ ও রাষ্ট্রপ্রশাসন ইসলামের বিরুদ্ধে কয়েকশত বৎসর যাবত যে সকল জঘন্য মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে সেগুলির অন্যতম ছিল ইসলামের জিহাদ বিষয়ক নির্দেশনার অপব্যখ্যা। আমরা এ পুস্তকের শেষ দিকে ইসলামের জিহাদ ও বাইবেলীয় জিহাদ বিষয়ক আলোচনায় এ বিষয়ে কিছু দেখতে পাব। এজন্য পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ ইসলামী দেশগুলির নিয়ন্ত্রন ও তাদের দেশগুলির নীরব ইসলামায়ন রোধে জঙ্গিবাদ ইসূকেই সর্বোত্তম বিবেচনা করেন এবং তাদের স্বার্থেই ‘‘জঙ্গিবাদ’’ সৃষ্টি করেন।
এ সকল মুসলিম পন্ডিত আফগান জিহাদকে অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেন। সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিবাদে আফগানিস্থানের মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রতিরোধ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা এ সুযোগে এ সকল প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে অস্ত্র, ট্রেনিং, প্রযুক্তি ও সকল প্রকার সাহায্য দিয়ে এগিয়ে নেয়। সারা বিশ্বে এদের পক্ষে প্রচার চালায়। এরপর তারা তাদেরকে উস্কানির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করে। তারা বেপরোয়া হয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন। পরিত্যক্ত ও উত্তেজিত এ সকল মানুষ আবেগ তাড়িত হয়েও অনেক কাজ করতে থাকেন। এছাড়া এ সকল ‘মুজাহিদ’দের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজস্ব অনুচর রয়েছে। যারা এদেরকে ‘সংঘাতের পথে’ যেতে প্ররোচিত করছে। এরা জিহাদ ও কিতাল বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলির অপব্যাখ্যা করে মুসলিম উম্মাহকে ‘প্রিম্যাচিউরড’ সংঘাতের পথে যেতে উস্কানি দিচ্ছে। এভাবে সারা মুসলিম বিশ্বে ‘জিহাদের’ বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
এ সকল গবেষক আরো একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা বলেন যে, খিলাফাতে রাশেদার পর থেকে ইসলামী দেশগুলিতে ক্রমান্বয়ে ধর্মপালনে শিথিলতা, অনাচার, অশ্লীলতা, ইসলাম বিরোধী মতবাদ ও আকীদার প্রসার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর ও গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। রাষ্ট্র, প্রশাসন ও আমীর-ওমরাগণ এ অবক্ষয় রোধের চেষ্টা করেন নি, উপরন্তু অনেক সময় তারা তার প্রসারে সহযোগিতা করেছেন। আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ ও ধার্মিক মানুষেরা সাধ্যমত ‘দাওয়াত’ বা প্রচার ও উপদেশের মাধ্যমে এগুলির সংশোধনের চেষ্টা করেন। তবে তারা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধে নামে বলপ্রয়োগ বা শাস্তি প্রয়োগ করেন নি। সর্বোপরি তারা অনাচার ও অবক্ষয়ের সর্বগ্রাসী প্রসারের জন্য রাষ্ট বা সরকারকে দায়ী করে রাষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন নি বা ‘‘ধার্মিকদের রাষ্ট্র’’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন নি। বরং তারা এ সকল রাষ্ট্র ও সরকার আনুগত্য বজায় রেখেছেন এবং বহির্শত্রুর বিরুদ্ধে এদেরে জিহাদে শরিক হয়েছেন। মূলত এ কারণেই দ্বিতীয় মিলেনিয়ামের ক্রুসেড যুদ্ধে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের আগ্রাসন রোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন মুসলমানরা।
কিন্তু বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেক মুসলিম দীন প্রতিষ্ঠার নামে মুসলিম দেশের স্থিতি নষ্ট করছেন, যাতে বহির্শত্রুর আগ্রাসন প্রতিরোধের ক্ষমতা হারাচ্ছে মুসলিম সমাজ। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন যে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তনে মার্কিন অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ-প্রাপ্ত কতিপয় মুজাহিদ এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘‘মাদ্রাসা’’ থেকে আগত কোনো কোনো ছাত্র ইসলামী আইন বা শরীয়া আইন বাস্তবায়ন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ ইত্যাদি শ্লোগানের ভিত্তিতে এমন কর্মকান্ড পরিচালন করছেন যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ঐক্য, অর্থনৈতিক ও সামারিক প্রবৃদ্ধি কঠিনভাবে ব্যাহত করেছে। এখন যদি আমরা আরেকটি ক্রুসেড কল্পনা করি তাহলে অনুভব করব যে, এরূপ ক্রুসেড প্রতিহত করার ক্ষমতা হারাচ্ছে পাকিস্তান এবং ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়ার মত মানুষও হারাচ্ছে।
‘ইসলামপন্থী’দের এসকল দাবি-দাওয়া ও যুক্তি যতই জোরালো হোক এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এছাড়া এ দাবিও সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সহায়তা করে না। শত্রু তো শত্রুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেই। যদি কেউ সত্যিই ইসলামের শত্রু হন তবে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এজন্য তাঁদের দোষ দেওয়া বা তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা অর্থহীন কর্ম। আমাদের দেখতে হবে কি কারণে মুসলিম যুবকগণ তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন। কারণগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির প্রতিকার না করতে পারলে আমাদের দোষারোপ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাঁদের ষড়যন্ত্র সফলতা লাভ করবে।