ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ১. পরিচিতি ও আলোচিত কারণসমূহ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
১. ৪. আলোচিত দ্বিতীয় কারণ: ইসলামী শিক্ষা (১-১৪ নম্বর কারন)

বিশ্বের ধার্মিক বা অধার্মিক কোনো মুসলিমই উপর্যুক্ত মতামত সঠিক বলে মানতে পারেন না। বরং তারা একে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং বিদ্বেষমূলক মত বলে বিশ্বাস করেন। তাঁরা অনুভব করেন যে, যদি ইসলাম ধর্মই জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী হতো তবে আমরা সকল মুসলিমই আমাদের মধ্যে জঙ্গিবাদের আগ্রহ বা প্রেরণা অনুভব করতাম। মুসলিম পরিবারে বা সমাজে লালিত পালিত সকল ধার্মিক বা অধার্মিক মুসলিমই ইসলাম সম্পর্কে কমবেশি কিছু শিক্ষা পরিবার, প্রতিষ্ঠান বা সমাজ থেকে পেয়েছেন। কিন্তু কখনোই তারা অমুসলিম বা অন্যান্য মতাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতার শিক্ষা পান নি। সকল মুসলিম সমাজেই মুসলিমগণ অমুসলিমদের সাথে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছেন। কাজেই জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম কখনো দায়ী হতে পারে না। সমস্যা থাকলে অন্য কোথাও রয়েছে, ইসলামের মধ্যে নয়। তাঁরা অস্বীকার করেন না যে, কিছু মুসলিম সন্ত্রাসের সাথে জাড়িত।

তবে তারা কখনোই স্বীকার করেন না যে, তাদের ধর্ম তাদের সন্ত্রাসের জন্য দায়ী। বরং এ সকল সন্ত্রাসীর ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি, মানসিক বিক্ষুব্ধতা, সামাজিক অনাচার বা অন্য কোনো কারণ এর পিছনে কার্যকর। এদের অনেকেই মনে করেন যে, জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য মূলত দায়ী ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার। জঙ্গিবাদের বিস্তারে মাদ্রাসা শিক্ষার এ দায়িত্বের প্রকৃতি নির্ণয়ে এ সকল পন্ডিতের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অমুসলিম পান্ডিতগণও ‘ইসলামী শিক্ষাকেই’ মূলত জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য দায়ী করছেন। তবে ‘দায়িত্বের’ প্রকৃতি নির্ণয়ে তাদের মধ্যে এবং তাদের সাথে মুসলিম পন্ডিতদের বিভিন্নতা রয়েছে। কেউ মনে করছেন যেহেতু ইসলামের মধ্যেই জঙ্গিবাদের শিক্ষা রয়েছে, সেহেতু ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রসার মানেই জঙ্গিবাদের প্রসার। যত বেশি কুরআন, হাদীস, ফিক্হ ইত্যাদি ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা প্রসার লাভ করবে, ততই বেশি ‘জিহাদী’ মনোভাব, অন্য ধর্ম ও মতের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব ও মোল্লাতান্ত্রিক (theocratic) স্বৈরাচারী সরকার জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব প্রসার লাভ করবে। এজন্য ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষার প্রসার রোধই জাঙ্গিবাদ দমনের প্রধান উপায়।

অন্য অনেকে মনে করেন যে, ইসলামের মধ্যে মূলত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই, তবে ইসলামী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসাগুলিতে ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথবা এগুলির পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী ইসলামকে জঙ্গিবাদী রূপদানের সহায়ক। অথবা ইসলামী আবেগের অপব্যবহার করে এ সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদেরকে সহজেই জঙ্গিতে রূপান্তরিত করা যায়। কেউ মনে করছেন, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবেই ইসলামের শিক্ষা প্রদান করছে, তবে সম্ভবত শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু ত্রুটি রয়েছে, যে কারণে এগুলি জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয়ে গিয়েছে। এদের মতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারই জঙ্গিবাদ রোধের উপায়।

’ইসলামী জঙ্গিবাদের’ জন্য ‘ইসলাম’-কে দায়ী করলে যেমন মুসলিমগণ হতবাক, বিস্মিত, ব্যথিত বা উত্তেজিত হয়ে এরূপ মতকে বিদ্বেষমূলক বলে মনে করেন, ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসার সাথে জড়িত মানুষরাও এ দ্বিতীয় মতটির বিষয়ে একইরূপ বিস্ময়, ব্যথা বা উত্তেজনা অনুভব করেন। তাঁরা অনুভব করেন যে, যদি ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষাই জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী হতো তবে আমরা মাদ্রাসার সকল ছাত্র শিক্ষক আমাদের মধ্যে জঙ্গিবাদের আগ্রহ বা প্রেরণা অনুভব করতাম। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা কখনোই তা নয়। সন্ত্রাস, হত্যা ও ধ্বংসের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ও বিরোধিতা অনুভব করছেন এ সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা আলিম, ইমাম ও পীর-মাশাইখ।

বিগত প্রায় আড়াই শত বৎসর ধরে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা উপমহাদেশে চালু রয়েছে এবং মূলত একই পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী অনুসরণ করে চলেছে। এছাড়া অনুরূপ পদ্ধতির অগণিত মাদ্রাসা মালয়েশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশে রয়েছে। এগুলি থেকে বের হয়ে আসা অগণিত মানুষ সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করেছেন। ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই তাঁরা সন্ত্রাসের জন্ম দেন নি। তাঁরা অস্বীকার করেন না যে, কিছু মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক এ অপরাধের সাথে জাড়িত। তবে তারা কখনোই বিশ্বাস করেন না যে, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা-ব্যবস্থা তাদের এ অপরাধের জন্য দায়ী। বরং তা তাদের ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি।

এ সকল মাদ্রাসাশিক্ষিত মানুষ উপযুক্ত পান্ডিত-বুদ্ধিজীবীদেরকে ‘ইসলামীশিক্ষা বিদ্বেষী’ বা ‘মাদ্রাসা বিদ্বেষী’ বলে মনে করে থাকেন। তবে আমার কাছে মনে হয় ‘ইসলামী জঙ্গিবাদের’ জন্য ‘ইসলাম ধর্ম’-কে দায়ী করা এবং ‘ইসলামী শিক্ষা’-কে দায়ী করা উভয় মতের পিছনে অজ্ঞতা একটি বড় কারণ। পাশ্চাত্য অমুসলিম পন্ডিতগণ যেমন কোনো কোনো মুসলিমকে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত দেখে সন্ত্রাসীর ধর্মকে দায়ী করছেন, তেমনি অনেকে কোনো কোনো মাদ্রাসা শিক্ষিতকে সন্ত্রাসে লিপ্ত দেখে সন্ত্রাসীর শিক্ষাকে দায়ী করছেন। এ সকল পন্ডিতের অনেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচী ও মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত নন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে তাঁরা জানতে পারেন যে, মাদ্রাসাগুলিতে জঙ্গিবাদীদের আখড়া এবং মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ জঙ্গি কার্যক্রমে লিপ্ত। এথেকে তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষাই মূলত জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তারের জন্য দায়ী। এ বিষয়ে আন্তরিক বক্তব্য দিয়ে একজন লিখেছেন: "It is a fact that some of the Madrasha students have got involved with what is called 'Islamic' militancy.... Though Madrasha education may not be held responsible for these most unwanted activities, yet there are some loopholes and it is time to think about bringing Madrasha education into the mainstream".

‘‘এ কথা বাস্তব সত্য যে, কতিপয় মাদ্রাসা ছাত্র তথাকথিত ‘ইসলামী জঙ্গিবাদে’ সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। যদিও মাদ্রাসা শিক্ষা সম্ভবত এ সকল অতীব নিন্দনীয় কর্মকান্ডের জন্য দায়ী নয়, তবুও মাদ্রাসা শিক্ষায় কিছু ফাঁকফোকর রয়েছে এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় নিয়ে আসার চিন্তা করার এখনই সময়।’’[1]

নিঃসন্দেহে লেখক ‘‘মাদ্রাসা-বিদ্বেষী’’ নন। তাঁর আন্তরিকতা প্রশংশনীয়। তিনি বলছেন, কতিপয় মাদ্রাসা ছাত্রের ইসলামী জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা ‘‘সম্ভবত’’ দায়ী না হলেও শিক্ষা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দায়ী। তিনি জানেন যে, ‘‘কতিপয়’’ মাদ্রাসা ছাত্রের পাশাপাশি ‘‘অনেক অনেক’’ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রও ‘‘তথাকাথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের’’ সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু লেখক এজন্য ‘‘সাধারণ শিক্ষা’’ ‘‘সম্ভবত’’ দায়ী না হলেও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার ‘‘ফাঁকফোকর’’-কে দায়ী বলে অভিযোগ করছেন না। এর কারণ কী! সম্ভবত এর কারণ হলো মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে তার অজ্ঞতা। তিনি সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় লেখাপড়া শিখেছেন। তিনি জানেন যে, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ‘জঙ্গিবাদ’ শিক্ষা দেওয়া হয় না। কাজেই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা জঙ্গিবাদে জড়িত হচ্ছে তাদের অপকর্মের জন্য তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বা শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁকফোকরকে দায়ী করার কোনো প্রশ্ন তার মনে আসে নি। কিন্তু তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানেন না। ‘‘সম্ভবত’’ তিনি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের বিষয়ে সুধারণা পোষণ করেন। এজন্য তিনি মনে করেন যে, ‘‘সম্ভবত’’ এদের অন্যায়ের জন্য এদের শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী নয়। তবে তিনি অনুমানের উপরেই নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে, এখানে কিছু ফাঁকফোকর রয়েছে। আমরা বুঝতে পারি যে, কোনো অপরাধীর অপরাধের জন্য তার ধর্ম, শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ইত্যাদি সাধারণত দায়ী হয় না। তদুপরি আমি এখানে নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচনা করতে পাঠককে অনুরোধ করছি।

(১) আমাদের সমাজের লক্ষ লক্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক সকলেই আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিভিন্ন সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত। এদের দুর্নীতির জন্য কেউই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেন না। কারণ তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেন তারাও একই শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত। তাঁরা ভাল করেই জানেন যে, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বা এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি শিক্ষা দেওয়া হয় না। কাজেই দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির জন্য তার ব্যক্তিগত লোভ, সামাজিক অনাচার, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ইত্যাদিই দায়ী; তার শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এজন্য কোনো অজ্ঞ বা ‘মাদ্রাসা শিক্ষিত’ মানুষ দুর্নীতির প্রসারের জন্য ‘আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা’ বা ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ দায়ী বলে মন্তব্য করলে বা ডাক্তারদের ‘কসাইসুলভ আচরণের জন্য’ মেডিকেল কলেজগুলি’ দায়ী বলে মন্তব্য করলে শিক্ষিত মানুষেরা তাকে মুর্খ বা নির্বোধ বলেই মনে করবেন। (তবে কতিপয় মাদ্রাসা শিক্ষিত জঙ্গির জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে দায়ী করাকে মুর্খতা বা নির্বুদ্ধিতা বলে গণ্য না করে প্রগতিশীলতা, প্রাজ্ঞতা ও বুদ্ধিজীবিতা বলে মনে করবেন তাদের অনেকেই।)

(২) অনুরূপভাবে আমাদের দেশের অনেকে ‘সর্বহারার রাজত্বের’ নামে সন্ত্রাসকর্মে লিপ্ত। এরা আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে শিক্ষা লাভ করেছেন। কিন্তু কেউই বলবেন না যে, এদের ঘৃণ্য কর্মের জন্য তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দায়ী।

(৩) ভারত, বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে অনেক মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। আবার এদের পাশাপাশি অনেক দেশে অনেক মানুষ চরমপন্থা, সন্ত্রাস, হত্যা বা জঙ্গি কর্মকান্ডের মাধ্যমে একই আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। তারা থানা, হাসপাতাল ইত্যাদি আক্রমন করছেন, হত্যা ও লুটতরাজ করছেন, বিভিন্ন জনপদ আক্রমন করে গণহত্যা বা গণ-লুটপাট করছেন। এ সকল ‘‘মার্কবাদী’’, ‘‘মাওবাদী’’, ‘‘সমাজতন্ত্রী’’ বা ‘‘সাম্যবাদী’’-দের অপরাধের জন্য কখনো কেউ তাদের ধর্ম বা আদর্শকে দায়ী করেন না। এমনকি এদের কর্মকান্ডে মূলধারার ‘‘সাম্যবাদী’’, ‘‘সমাজতন্ত্রী’’, ‘‘মার্কবাদী’’ বা ‘‘মাওবাদী’’-গণ লজ্জিত হন না বা তাদেরকে কেউ দায়ীও করেন না।

(৪) মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন প্রশাসন ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান জীবন ও সম্পদ হারিয়েছেন। তারা নির্বিচার বোমা মেরে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের ‘গণহত্যাযজ্ঞে’ লিপ্ত হয়েছেন এবং সম্পদ ধ্বংস করেছেন এবং এরপর কয়েকশত কুর্দীকে হত্যার অপরাধে তারা সাদ্দাম হোসেনের বিচার করছেন। ইরাকী, আরব, মুসলিম ও বিশ্বের যে কোনো দেশ ও ধর্মের শান্তিকামী মানুষের দৃষ্টিতে এ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মানবতার বিরুদ্ধে কঠিনতম অপরাধ। এখানে একজন বিক্ষুদ্ধ ইরাকী, আরব বা মুসলমান এ অপরাধের জন্য ‘খৃস্টধর্ম’, ‘গণতন্ত্র’ বা ‘আমেরিকান সভ্যতা’-কে দায়ী করে মন্তব্য করতে পারেন; কারণ প্রেসিডেন্ট বুশ ও তার সহকর্মীবৃন্দ ‘বিশ্বাসী ও ধর্মপরায়ণ খৃস্টান, আমেরিকান সভ্যতার সন্তান ও গণতন্ত্রের ধারক-বাহক’। কিন্তু কোনো খৃস্টান, আমেরিকান, গণতন্ত্রপ্রেমিক বা কোনো একজন প্রাজ্ঞ পন্ডিত এ মতের সাথে একমত হবেন না। তারা একে অজ্ঞতা প্রসূত প্রলাপ বলেই মনে করবেন। কারণ তারা জানেন যে, খৃস্টধর্ম, গণতন্ত্র বা আমেরিকান সভ্যতা কোনোটির এরূপ হত্যাযজ্ঞ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও লুটতরাজ শিক্ষা দেয় না বা সমর্থন করে না। মার্কিন প্রশাসন যা করছেন তা বর্তমান নেতৃবৃন্দের অন্যায়, এজন্য তাদের ধর্ম, আদর্শ বা সভ্যতা দায়ী নয়।

(৫) ইসলামী শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়টিও একই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করা মানুষদের দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করলে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৎ ও নীতিবান ছাত্রদের কাছে তা পাগলামি বলে মনে হয়, তেমনিভাবে মাদ্রাসা শিক্ষিত কতিপয় মানুষের সন্ত্রাসের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে দায়ী করলেও মাদ্রসা শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত সাধারণ মানুষদের কাছে পাগলামি বলেই মনে হয়।

(৬) বর্তমান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সম্পৃক্তির মূল বিষয়টিও বিবেচ্য। আমরা দেখেছি যে, সন্ত্রাসে লিপ্ত ব্যক্তি নিজের ধর্ম বা আদর্শকে ব্যবহার করেন। দেশপ্রেম ও গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে মানুষের দেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিক অনুভূতির অপব্যবহার (exploit) করা হয়। এভাবেই আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রেমিক ও মানবাধিকারবাদী মানুষেরা প্রেসিডেন্ট বুশকে ম্যান্ডেট দিয়েছেন আত্মরক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইরাকের নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের মধ্যে হত্যাযজ্ঞ চালানোর।

স্বভাবতই ইসলামের নামে সন্ত্রাসে ইসলামী অনুভুতিকে ব্যবহার (exploit) করা হয়েছে ও হচ্ছে। এতে কোনো কোনো ইসলামপ্রেমিক সরল মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। মাদ্রাসায় পড়া কোনো মানুষ এরূপ প্রতারণার শিকার হতে পারেন না এরূপ দাবি কেউই করেন না। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রাসে যেমন গণতন্ত্র-প্রেমিকরা প্রতারিত হচ্ছেন, সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের নামে সন্ত্রাসে যেমন সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রীর প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি ইসলামের নামে সন্ত্রাসে ইসলাম প্রেমিক মাদ্রাসা ছাত্ররা বেশি প্রতারিত হবে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা এর বিপরীত। জঙ্গিরা হয়ত তাদের কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য নিজেরা কোনো ‘মাদ্রাসা’ বা ‘মসজিদ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলি বা মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষেরা দলে দলে এ সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যোগদান করেছেন। বাংলাদেশে ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ নামক জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিতের সংখ্যা খুবই কম, শতকরা ৫ ভাগও নয়, বাকী ৯৫ ভাগ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার উন্মেষ থেকে আজ পযন্ত জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে যেসকল মানুষ অভিযুক্ত হয়েছেন বা শাস্তি পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। ২৪১টি মামলায় আটক ৫০৬ জঙ্গির পরিচয় বিশে­ষণ করে মাত্র ৩/৪ শতাংশ মাদ্রাসায় পড়া বলে জানা যায়। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে জঙ্গি কর্মকান্ডের অভিযোগে অভিযুক্তদের তালিকা দেখলেও আমরা একই সত্য অনুধাবন করি।

(৭) সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষয়। এরূপ সংবাদ, গণমাধ্যমীয় গবেষণা-প্রবন্ধ ও পর্যালোচনার উপর নির্ভর করে আমেরিকার জনগণ নিশ্চিত বিশ্বাস করেছিল যে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রয়েছে, যা আমেরিকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি। আর এজন্যই তারা একবাক্যে প্রেসিডেন্ট বুশকে ইরাক যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছিলেন। আজ লক্ষ লক্ষ মানব সন্তানের রক্ত ঝরানো এবং অমূল্য মানবীয় সম্পদের ধ্বংসলীলার পরে সবাই জানতে পারলেন ও স্বীকার করলেন যে, এরূপ কোনো অস্ত্র কোনোকালেই সেখানে ছিল না। সংবাদ মাধ্যমের কারণেই এখনো সবাই জানলেন না যে, এরূপ অস্ত্র থাকলেও কোনো দিনই ইরাক আমেরিকার স্বাধীনতা বা নিরাপত্তার হুমকি হতে পারত না। শুধু ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষার জন্যই এ গণহত্যা। সংবাদ মাধ্যমের কারণেই এশিয়ার সুনামি মহা সংবাদে পরিণত হয়, কিন্তু ফালুজার গণহত্যা ও মহাধ্বংস কোনো সংবাদই হয় না।

এজন্য গণমাধ্যমের সংবাদ বা তথ্যের উপর নির্ভর করা তো দূরের কথা, সুপ্রশিক্ষিত ‘ইন্টেলিজেন্সী’র সুনিশ্চিত রিপোর্টের উপর নির্ভর করাও কঠিন। এ সকল তথ্যের বাইরে বাস্তব অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের দেশের আনাচে কানাচে অগণিত মাদ্রাসা ছড়িয়ে রয়েছে। এ সকল মাদ্রাসার কর্মকান্ড সবকিছুই সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এগুলির ছাত্র শিক্ষক সকলেই সমাজের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। এদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসীর অস্তিত্ব আমরা পাই না। মাদ্রাসা শিক্ষিত যে সকল মানুষ জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয়েছেন বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি তাদের আনুপাতিক হার স্কুল-শিক্ষিত মানুষদের চেয়ে অনেক অনেক কম।

কেউ বলতে পারেন যে, যদিও জঙ্গি কর্মকান্ডে সাধারণ শিক্ষিতদের সম্পৃক্ততা বেশি, তবে এরা মাদ্রাসা শিক্ষিতদের প্রচারণার শিকার। যদি সম্পৃক্তদের মধ্যে অন্তত ৫০% মাদ্রাসা শিক্ষিত হতো তাহলেও হয়ত বলা যেত যে, অবশিষ্ট ৫০% তাদের প্রচারণার শিকার। কিন্তু আমরা দেখছি যে, প্রকৃত অবস্থা তার বিপরীত। বস্ত্তত জঙ্গি কর্মকান্ডে লিপ্ত ৫% মাদ্রাসা শিক্ষিতই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ‘‘মুফতী’’ ও গুরুদের প্রচারণার শিকার। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত অনেক মানুষ ইসলামী গবেষণা ও কর্ম শুরু করে আবেগী ও ‘‘বোমা-ফাটানো’’ বৈপ­বিক তত্ত্ব আবিষ্কার করতে শুরু করেন। গতানুগতিক আলিমদেরকে এরা অযোগ্য, দালাল ও দুর্বল ঈমান বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের ক্ষুরধার যুক্তি ও আধুনিক তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য অনেক মাদ্রাসা শিক্ষিতকেও আকৃষ্ট করে। জঙ্গি কর্মকান্ডের পিছনে এদের অবদানই বেশি। সাধারণ শিক্ষিত ও মাদ্রাসা শিক্ষিত সকলেই এদের দ্বারা প্রভাবিত।

কুরআনের যে সকল আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে এরা মানুষদের প্রতারিত করে সেগুলির প্রকৃত অর্থ বা প্রেক্ষাপট কোনো কোনো মাদ্রাসা-শিক্ষিতের জানা থাকে এবং এরা এ সকল বিষয়ে আলিমদেরকে প্রশ্ন করতে চেষ্টা করে। এজন্য মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের চেয়ে সাধারণ-শিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের প্রভাবিত ও প্রতারিত করা এদের জন্য সহজতর। এজন্যই জঙ্গি কর্মকান্ডে সাধারণ শিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের সম্পৃক্তি বেশি।

বাংলাদেশে বিগত কয়েক বৎসরে জঙ্গিবাদ বিরোধী অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। অনেক মানুষ আটক করা হয়েছে ও অনেক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত মাদ্রাসা থেকে অস্ত্র উদ্ধার বা গ্রেফতারের একটি রেকর্ডও নেই। ডাকাত বা সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনী বা পুলিশের পোশাক ব্যবহার করলে যেমন সেনাবাহিনী বা পুলিশবাহিনীকে দায়ী করা যায় না, তেমনি কোনো সন্ত্রাসী কোনো স্থানে মসজিদ বা মাদ্রাসা নামে কোনো একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অস্ত্র রাখলে বা মাদক ব্যবসা করলে সেজন্য মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায় না। বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িতদের তো কোনোরূপ ক্ষমতা বা অধিকার নেই যে, মাদ্রাসা নামে যা কিছু প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে তা তদারকি করবেন।

(৮) জঙ্গিবাদের সাথে মাদ্রাসাকে সম্পৃক্ত করে যারা আমাদের দেশে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন তাদের বড় দুর্বলতা বাছবিচার ছাড়াই পাশ্চাত্য বা বিদেশী পন্ডিতদের মতামত আওড়ান। প্রকৃত বিষয় হলো ‘‘জঙ্গি’’ তৈরির বিশেষ উদ্দেশ্যেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বস্ত্তত রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পাকিস্তান সরকার সর্বদা ইসলামী অনুভূতির অপব্যবহার করেছে। কাশ্মির জিহাদ ও অন্যান্য ইস্যুতে সরকার, সেনাবাহিনী বা এগুলির অঙ্গসংস্থা অনেক আলিম ও মাদ্রাসাকে ব্যবহার করেছে। তাদেরকে অস্ত্র প্রদান করা হয়েছে এবং ময়দানে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই এক্ষেত্রে জিহাদের প্রেরণা ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমরা দেখব যে, ইসলামে জিহাদ বৈধ হওয়ার একটি শর্ত হলো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে জিহাদ পরিচালিত হওয়া। এজন্য স্বভাবতই মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ এরূপ জিহাদে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আর একবার যারা অস্ত্রের ভাষা আয়ত্ব করেন তার সবসময়েই অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে চান।

১৯৭৯ খৃস্টাব্দে আফগানিস্তানে সোভিয়েট আগ্রাসন ও আলিমদের নেতৃত্বে আফগান জনগণের প্রতিরোধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুর্বণ সুযোগ এনে দেয়। আফগান প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে অর্থ ও অস্ত্র দেওয়া ছাড়াও সারা বিশ্ব থেকে মুজাহিদ সংগ্রহ, অর্থায়ন ও অস্ত্রায়নের কাজ যুক্তরাষ্ট্র ভালভাবেই করে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশ থেকে ধার্মিক মানুষদের বা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এদের তত্ত্বাবধানে অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সমর্থনপুষ্ট এ সকল ‘‘মুজাহিদ’’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনের পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে ‘‘জঙ্গি’’ বলে পরিগণিত হলেন। যুক্তরাষ্ট্র যতদিন এদের মুজাহিদ, প্রতিরোধ-যোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা বলেছে ততদিন আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও এদেরকে তাই বলেছেন। আবার যখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র এদেরকে জঙ্গি বলতে শুরু করল আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও তা বলতে শুরু করলেন। সর্বোপরি মার্কিনীদের তালে তালে সকল দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জঙ্গি তৎপরতার সাথে যুক্ত করলেন।

(৯) কেন ইউ-টার্ন করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাথীরা? প্রথমত তাদের প্রয়োজন মিটে যাওয়ার কারণে। দ্বিতীয়ত তাদের পরবর্তী প্রয়োজন মেটানোর জন্য। তাদের প্রথম প্রয়োজন ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া ও সোভিয়েট ইউনিয়নকে পরাজিত করা। ‘‘মুজাহিদ’’-দের মাধ্যমে সে প্রয়োজন মেটানোর পরে মুজাহিদরা জঙ্গিতে পরিণত হলেন। তাদের পরবর্তী প্রয়োজন ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করা। সোভিয়েট ইউনিয়ন, সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী প্রচারাভিযান ও যুদ্ধাভিযান চালিয়ে তার পতন ঘটানোর পরে যুক্তরাষ্ট্র ‘‘ইসলাম’’-কে ‘‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’’ সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করে। তবে সর্বদা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের বক্তব্য অতি সুন্দর ভাষায় ব্যক্ত করেন। ‘‘ইসলাম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের’’ প্রধন শত্রু একথা না বলে তারা বলেন ‘‘ইসলাম পাশ্চাত্য সভ্যতা, গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের’’ প্রধান শত্রু, একসময় যেমন সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েট ইউনিয়ন ছিল ‘‘পাশ্চাত্য সভ্যতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের’’ অর্থাৎ ‘‘সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসানের’’ প্রধান শত্রু। তারা দেখলেন যে, ইসলামকে ‘দানব’-রূপে চিত্রিত করার জন্য তাদের তৈরি এ সকল ‘‘মুজাহিদ’’-কে জঙ্গিতে রূপান্তরি করা খুবই কার্যকর পদক্ষেপ।

(১০) যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কোরিয়া, জার্মাানী ও অন্যান্য দেশ দখল করে, সেদেশে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে তথায়অবস্থানের ও আধিপত্য করার সুযোগ পেয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করে এ সকল দেশে গণতন্ত্র ও জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে এ সকল দেশে তাদের অবস্থান ও আধিপত্য চিরস্থায়ী করতে পারবে বলে ধারণা করেছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে নি। গণতন্ত্র, জাতীয় সরকার, আধুনিক জীবনযাত্রা, পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি কোনো কিছুর বিনিময়েই এ সকল দেশের জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের ও তার সহযোগীদের অবস্থান ও আধিপত্য মেনে নিতে রাজি হচ্ছেন না। বাহ্যত এর একটিই কারণ; তা হলে ‘‘ইসলাম’’। ইসলামী অনুভূতি, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আবেগ বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত এ সকল দেশে এবং বিশ্বের অন্য কোনো মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের অবস্থান ও আধিপত্য নিরাপদ নয়। আর ইসালামী বিশ্বাস, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আবেগ নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করতে ‘‘মাদ্রাসা’’ শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই।

(১১) সাম্রাজ্যবাদীরা খুব ভালভাবে লক্ষ্য করেছেন, যে কোনো দেশে তাদের আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে সবেচেয়ে বেশি সোচ্চার সাম্যবাদী বা ‘‘বামপন্থী’’ এবং ‘‘ইসলামপন্থী’’-গণ। আর ‘‘ইসলামপন্থী’’-দেরকে নির্মুল বা দুর্বল করতে ‘‘জঙ্গিবাদ’’ ও ‘‘মাদ্রাসাশিক্ষা’’ বিরোধী প্রচারণা অত্যন্ত কার্যকর। মাদ্রাসা শিক্ষায় ‘‘জঙ্গি’’ তৈরি না হলেও ‘‘ধার্মিক মুসলিম’’ তৈরি হয়। এরা আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইরাক, ইরান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য সকল দেশের তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ ইত্যাদির ইজারা বা দখল নিতে এবং এ সকল দেশে আধিপত্য বিস্তার করতে প্রধান বাধা এ সকল ধার্মিক মানুষ। এদের আধিক্য তাদের উদ্দেশ্য সাধনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং এদের দুর্বলতা ও স্বল্পতা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের পথ খুলে দেবে। ধার্মিক মানুষদেরকে সাধারণ মানুষদের চোখে হেয় করতে এবং ধার্মিক মানুষ তৈরির পথ রোধ করতে মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্যই তারা জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যদিও তাদের জানা থাকার কথা যে, তাদের তৈরি মাদ্রাসাগুলি এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিতগণ ছাড়া কোনো মাদ্রাসা থেকে জঙ্গি তৈরি হয় না।

(১২) নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত যে কোনো গবেষণা প্রমাণ করবে যে, জঙ্গিবাদের সাথে এদেশের কওমী বা আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষদের সম্পৃক্তি খুবই কম। এছাড়া অন্যান্য সকল দুনীতি ও অপরাধের সাথে এদের সম্পৃক্তি একেবারেই কম। যৌতুক, মাদকতা, মাদক পাচার, চুরি-ডাকাতি, খুন-সন্ত্রাস ইত্যাদি সকল অপরাধে জড়িত মানুষদের বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করলেই তা জানতে পারবেন। দেশের জনসংখ্যার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের আনুপাতিক হার সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তবে গত কয়েক বৎসরের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ও দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের আনুপাতিক হারের পাশাপাশি কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের যোগ করলে সাধারণভাবে অনুমান করা যায় যে, শিক্ষিত বা স্বাক্ষর মানুষদের মধ্যে কমবেশি ১৫% মানুষ মাদ্রাসা শিক্ষিত। কিন্তু উপরের যে কোনো অপরাধে জড়িতদের মধ্যে ২% বা ১% ভাগ মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষও পাওয়া যাবে না বলেই প্রতীয়মান হয়।

(১৩) মাদ্রাসা শিক্ষার ধর্মীয় ও নৈতিক ভিত্তির কারণে এ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে দুর্নীতি, অপরাধ, মাদকতা, মাদক পাচার ও অন্যান্য সকল অপরাধের প্রতি ঘৃণা ও আপত্তি বিদ্যমান থাকে। এজন্য তাদের অধিকাংশ এ সকল অপরাধ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি এ সকল অপরাধ বিরোধী মানসিকতা তৈরিতে সহায়তা করেন। এ ছাড়া স্বভাবতই তারা অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ব্যভিচার, জুয়া, মদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। যে কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের দৃষ্টিতে এগুলি দেশগড়ার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে যারা বাণিজ্যিক বা অন্য কোনো স্বার্থে এ সকল অপরাধ বা অনাচারের প্রসার কামনা করেন তাদের দৃষ্টিতে মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষেরা তাদের প্রধান বাধা।

(১৪) বস্ত্তত ইসলামী শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার সম্প্রসারণই জঙ্গি দমনের অন্যতম উপায়। কারণ সঠিক ইসলামী জ্ঞান থাকলে তাকে ইসলামের নামে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুসারে যতগুলি ‘‘জঙ্গি’’ দলের তালিকা করা হয়েছে, যত ‘‘জঙ্গি’’ গ্রেফতার করা হয়েছে বা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে একবার তাকলেই যে কেউ নিশ্চিত হবেন যে, এদের অধিকাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। উপরন্তু এদের অধিকাংশই মাদ্রাসা শিক্ষিত বা আলিমগণের ঘোর বিরোধী। তারা আলিমদেরকে দালাল, আপোষকামী ও অজ্ঞ বলে প্রচার করে এবং তাদের অনুসারীদেরকে আলিমদের সাথে মিশতে নিষেধ করে। শুধু তাদের মতের সাথে যে আলিমের মত মিলে যায় তার প্রশংসা করে। এদের ধর্মীয় আবেগের সাথে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে এদের মধ্যে উগ্রতা জন্ম নিয়েছে বা বপন করা হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে যারা অল্প কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়েছে। এদেরও আবেগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু জ্ঞান অর্জিত হয় নি।

সঠিক ইসলামী জ্ঞান না থাকাই জঙ্গিবাদের ক্ষপ্পরে পড়ার মূল কারণ। বস্ত্তত ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের জন্মগত সহজাত অনুভূতি। সন্তানের প্রতি স্নেহ, পিতামাতার প্রতি ভালবাসা, সম্পদের মোহ, আত্মপ্রেম ইত্যাদির মতই ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের সহজাত অনুভূতি। এ সকল অনুভূতিকে নির্মূল করা যায় না। একে সঠিক খাতে প্রবাহিত করাই মানবতার কল্যাণের একমাত্র পথ। ইসলাম সম্পর্কে আবেগ ও ভালবাসার পাশাপাশি সঠিক জ্ঞান না থাকলে সহজেই একজন মানুষকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব।

[1] Letter of a reader, The Daily Independent 14/1/2006.