এরপর আখিরাত বিষয়ক আকীদা প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে সৃষ্ট অবস্থায় রয়েছে (পূর্বেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।) জান্নাত ও জাহান্নাম কখনোই বিলুপ্ত হবে না। আয়তলোচনা হূরগণ কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। মহান আল্লাহর অনন্ত-চিরস্থায়ী শাস্তি ও পুরস্কার কখনোই বিলুপ্ত হবে না।’’

জান্নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘‘বাগান’’। আখিরাতে নেককার মুমিনগণের জন্য যে মহা-নিয়ামতপূর্ণ আবাসস্থল আল্লাহ তৈরি করে রেখেছেন তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘‘জান্নাত’’ বলা হয়। জান্নাতের বিভিন্ন স্তর, পর্যায় ও নাম রয়েছে। ফার্সী ভাষায় জান্নাতকে ‘‘বেহেশত’’ বলা হয়, যা বাংলা ভাষায় বহুল-ব্যবহৃত।

জাহান্নাম শব্দের মূল অর্থ ‘‘গভীরগর্ত কূপ’’। মহান আল্লাহ আখিরাতে অবিশ্বাসী ও পাপীদের শাস্তির জন্য যে অগ্নিময় আবাস তৈরি করেছেন তাকে কুরআন-হাদীসে ‘‘জাহান্নাম’’ বলা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ইমাম আযম (রাহ) আরবীতে ‘‘জাহান্নাম’’ শব্দটি ব্যবহার করেন নি। তিনি (النار) বা অগ্নি শব্দ ব্যবহার করেছেন। জাহান্নামকে কুরআন ও হাদীসে অনেক সময় ‘‘নার’’ ব ‘‘অগ্নি’’ (নরক) বলা হয়েছে। বাংলায় ‘‘অগ্নি’’ বা ‘‘নার’’ বললে অনেকেরই বুঝতে অসুবিধা বলে আমরা সুপরিচিত ‘জাহান্নাম’ শব্দ বা ফারসী ‘দোযখ’ শব্দ ব্যবহার করেছি।

আখিরাতে বিশ্বাসের মূল বিষয় জান্নাত ও জাহান্নামের বিশ্বাস। শেষ বিচারের পরে বান্দারা জান্নাত বা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। জান্নাতীগণ অনন্তকাল জান্নাতে অবস্থান করবেন এবং আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করবেন। জাহান্নামীগণের মধ্যে যারা মুমিন তারা এক পর্যায়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। জাহান্নামের অবশিষ্ট বাসিন্দারা অনন্তকাল জাহান্নামে অবস্থান ও শাস্তিভোগ করবেন।

কুরআন ও হাদীসে উভয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো সকল মুমিনের জানা। তবে কিছু বিভ্রান্ত সম্প্রদায় এ বিষয়েও নানাবিধ বিভ্রান্তি প্রচার করেছে। উদ্ভট যুক্তি বা বিজ্ঞানের নামে তারা জান্নাত ও জাহান্নাম বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো ব্যাখ্যা ও রূপক অর্থের নামে বাতিল করেছে। তাদের বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর দাবির অন্যতম: (১) জান্নাত ও জাহান্নাম কিয়ামাতে সৃষ্টি করা হবে, বর্তমানে তা বিদ্যমান নয় এবং (২) জান্নাত ও জাহান্নাম অনন্তকালস্থায়ী নয়, বরং সেগুলো এক সময় বিলীন হয়ে যাবে।

যেহেতু তাদের এ সকল বক্তব্য কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী এজন্য ইমাম আবূ হানীফা সেগুলো খন্ডন করে উপরের কথাগুলো বলেছেন। তিনি দুটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন: (১) জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্ট অবস্থায় বিদ্যমান এবং (২) উভয়টিই অনন্তকাল স্থায়ী। কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য বিষয়দুটি প্রমাণ করে। মহান আল্লাহ আদমকে সৃষ্টির পর তাঁকে বলেন:


يَا آَدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ


‘‘হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর।’’[1]

কুরআনের ব্যবহার ও আরবী ব্যাকরণ নিশ্চিত করে যে, এখানে জান্নাত বলতে সুপরিচিত জান্নাতকেই বুঝানো হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, আদম সৃষ্টির পূর্বেই জান্নাত সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:


وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ


‘‘এবং তোমরা ভয় কর আগুনকে যা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্ততকৃত।’’[2]


وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ


‘‘এবং দ্রুত ধাবিত হও তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষের মাগফিরাতের দিকে এবং জান্নাতের দিকে যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীগণের জন্য প্রস্ত্ততকৃত হয়েছে।’’[3]

এ অর্থে আরো আয়াত বিদ্যমান। এগুলো প্রমাণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম পূর্ব থেকেই প্রস্ত্ততকৃত ও সৃষ্ট। মিরাজ বিষয়ক হাদীসগুলো ও অন্যান্য অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন, তাঁর সামনে সেগুলোকে পেশ করা হয়েছে, তিনি সেগুলোর মধ্যকার অনেক নিয়ামত ও শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। এ অর্থের হাদীসগুলি মুতাওয়াতির বা বহু সাহাবী থেকে বহু সনদে বর্ণিত।

অনুরূপভাবে কুরআনে বারবার বলা হয়েছে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম অনন্তকাল স্থায়ী থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন:


وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا


‘‘আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে, যেগুলির তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ, সেখানে তারা চিরস্থায়ী থাকবে অনন্তকাল।’’[4]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:


وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا


‘‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, তথায় তারা চিরস্থায়ী থাকবে অনন্তকাল।’’[5]

এ ছাড়া আরো অনেক আয়াতে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীগণ কখনোই সেখান থেকে বহিস্কৃত হবেন না, কখনোই মৃত্যু তাদেরকে স্পর্শ করবে না, জান্নাতের নিয়ামত কখনোই কর্তিত বা শেষ হবে না, জাহান্নামের শাস্তিও শেষ হবে না। অগণিত হাদীসেও এ কথা বলা হয়েছে।

[1] সূরা (২) বাকারা: ৩৫ আয়াত ও সূরা (৭) আরাফ: ১৯ আয়াত।

[2] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৩১ আয়াত।

[3] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৩৩ আয়াত।

[4] সূরা (৪) নিসা: ৫৭ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৪) নিসা: ১২২ আয়াত; সূরা (৫) মায়িদা ১১৯ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ২২ ও ১০০ আয়াত; সূরা (৬৪) তাগাবুন: ৯ আয়াত; সূরা (৬৫) তালাক: ১১ আয়াত; সূরা (৯৮) বাইয়িনা: ৮ আয়াত।

[5] সূরা (৭২) জিন্ন: ২৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩) নিসা: ১৬৮-১৬৯ আয়াত; সূরা (৩৩) আহযাব: ৬৪-৬৬ আয়াত।