আল্লাহর পুরস্কার ও শাস্তির বিষয়টি ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ বিষয়ে বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের উপর করুণাকারী ও ন্যায়বিচারক। তিনি মেহেরবানি করে অনেক সময় বান্দার প্রাপ্য সাওয়াবের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করেন। কখনো তিনি ন্যায়বিচার হিসেবে পাপের শাস্তি প্রদান করেন। কখনো মেহেরবানি করে পাপ ক্ষমা করেন।’’

কুরআন-হাদীসে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে:

(১) মহান আল্লাহ পাপের শাস্তি দিবেন এবং পুণ্যের পুরস্কার দিবেন। তিনি পাপ পরিমাণে শাস্তি দিবেন। তবে পুরস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ইচ্ছা করলে বান্দাকে তার কর্মের চেয়ে বহুগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করবেন।

(২) শিরক ছাড়া যে কোনো পাপ আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন।

(৩) আল্লাহ কাউকে জুলুম করবেন না; তবে তিনি ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত করুণা করবেন। শাস্তি তাঁর ইনসাফ এবং পুরস্কার তাঁর করুণা।

এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। কয়েকটি আয়াত দেখুন:


وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ


‘‘আল্লাহর জন্যই যা আছে আসমানসমূহে এবং যা আছে যমীনে। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা আযাব দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’’[1]


إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ


‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।’’[2]


مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلا يُجْزَى إِلا مِثْلَهَا وَهُمْ لا يُظْلَمُونَ


‘‘যে সৎকাজ এনেছে, তার জন্য তার দশ গুণ। আর যে অসৎকাজ এনেছে, তাকে কর্ম-পরিমাণই প্রতিদান দেওয়া হবে এবং তাদেরকে যুলুম করা হবে না।’’[3]


وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ


‘‘আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বহুগুণ বৃদ্ধি করেন।’’[4]

হাদীস শরীফে এ বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এ বিষয়গুলো সবই মহান আল্লাহর মর্যাদার সাথে এবং মানবীয় বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু মুতাযিলীগণ ও সমমনা কিছু ফিরকা যুক্তি ও বুদ্ধির নামে দাবি করেন যে, মহান আল্লাহ পাপীকে ক্ষমা করতে পারেন না; কারণ তা ইনসাফের পরিপন্থী। মু’তাযিলাগণ নিজদেরকে ‘আহলুল আদলি ওয়াত তাওহীদ’ (أهل العدل والتوحيد) অর্থাৎ ন্যায়বিচার ও একত্বের অনুসারী বলতেন। তাদের আকীদার অন্যতম (১) আদল (العدل) বা ন্যায়বিচার ও (২) ইনফাযুল ওঈদ (إنفاذ الوعيد) বা শাস্তির অঙ্গীকার বাস্তবায়ন।[5] এজন্য তারা দাবি করেন যে, কোনো মুমিন কবীরা গোনাহ করে তাওবা ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। এ ব্যক্তি কাফিরের মতই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। এ বিশ্বাসকে তারা ‘শাস্তির অঙ্গীকার বাস্তবায়ন’ বলে আখ্যায়িত করতেন। কারণ আল্লাহ পাপীদের শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন। এরপর যদি তিনি ক্ষমা করেন তবে তা ন্যায়বিচার ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পরিপন্থী হয়। আল্লাহর ন্যায়বিচারের যুক্তিতে তারা ‘ক্ষমা’ ও ‘শাফা‘আত’ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের সকল নির্দেশনা বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে অস্বীকার করেন।

আমরা আগেই দেখেছি যে, তাদের সকল বিভ্রান্তির মূল নিজেদের তথাকথিত ‘বুদ্ধি-বিবেক’ বা দর্শন দিয়ে ওহীর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য বিচার ও ছাঁটাই করা। এ মত প্রমাণ করতে তারা কুরআন ও হাদীসের অগণিত দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বাতিল করেন। মহান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘‘শিরক ছাড়া অন্য যে কোনো পাপ তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন।’’ আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বারবার বলেছেন যে, তাওবা করলে শিরক ক্ষমা করবেন তিনি।[6] কাজেই এ আয়াতের দ্ব্যর্থহীন অর্থ যে, তিনি অন্যান্য পাপ তাওবা ছাড়াও ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন। মুতাযিলাগণ বিভিন্নভাবে এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করেন।

নব্য মুতাযিলীদের কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। তবে তিনি কাউকে ক্ষমা করলে জাহান্নামে প্রবেশের আগেই ক্ষমা করবেন। পাপের কারণে কোনো মানুষ একবার জাহান্নামে প্রবেশ করলে আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। কারণ, কুরআনে কোথাও বলা হয় নি যে, জাহান্নামে প্রবেশের পরে কেউ আবার বেরিয়ে আসবে।’ আর যেহেতু বিষয়টি কুরআনে নেই সেহেতু এ বিষয়ক হাদীসগুলো তারা অস্বীকার করেন।

বস্ত্তত তারা মহান আল্লাহর ক্ষমা করার ক্ষমতাও সংকুচিত করতে চান। আল্লাহ সুস্পষ্ট বলেছেন যে, তিনি শিরক ছাড়া অন্যান্য পাপ তাওবা ছাড়াই ক্ষমা করতে পারেন। অর্থাৎ বান্দাকে কোনোরূপ শাস্তি না দিয়েই তিনি ক্ষমা করতে পারেন। তাহলে জাহান্নামে কিছুদিন শাস্তি ভোগের পর ক্ষমা করা তো আরো স্বাভাবিক, বিবেকসঙ্গত ও যৌক্তিক বিষয়। পাশাপাশি অগণিত মুতাওয়াতির হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, জাহান্নামে প্রবেশের পরে শাস্তি শেষ হওয়ায়, শাফাআতের কারণে বা আল্লাহ নিজ করুণায় অনেক জাহান্নামীকে জান্নাত প্রদান করবেন।

বস্ত্তত মুতাযিলীগণ যুক্তির নামে অযৌক্তিকভাবে মহান আল্লাহকে অতি সাধারণ একজন জাগতিক শাসকের চেয়েও অক্ষম বলে কল্পনা করে। পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসনের অংশ অপরাধের শাস্তির বিধানের পাশাপাশি শাসককে ক্ষমার অধিকার দেওয়া। শাস্তিভোগ শুরুর আগে এবং কিছু শাস্তি ভোগের পরে উভয় অবস্থাতেই শাসক ক্ষমা করতে পারেন। শাসকের ক্ষমা করার অধিকারকে কেউই আইনের শাসনের পরিপন্থী বলে গণ্য করেন না। বরং এরূপ ক্ষমার অধিকার আইন ও ইনসাফেরই অংশ।

সর্বোপরি তারা আল্লাহর ইনসাফের নামে আল্লাহর বে-ইনসাফির দাবি করেন। কারণ ‘ঈমান’ বান্দার সর্বোচ্চ ইবাদত। বান্দার অন্য পাপের কারণে যদি এ ইবাদত সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয় তাহলে তা বে-ইনসাফী বলে গণ্য হবে। কারণ এতে সবচেয়ে বড় পুণ্য ও পাপ: ঈমান ও কুফরের কোনো বিচার করা হয় না, শুধু অন্যান্য পাপ ও পুন্যের বিচার করা হয়। জাগতিক বিচারেও একই অপরাধে দু প্রকার শাস্তি হতে পারে। অপরাধীর মানসিকতা, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আচরণ, অপরাধে অংশগ্রহণের প্রকৃতি ইত্যাদি বিচার করে বিচারক শাস্তি প্রদান করেন। কাজেই আল্লাহ কাফির পাপী এবং মুমিন পাপীকে সমান বিচার করবেন এবং পাপী মুমিনের ঈমানের কোনোই মূল্যয়ন করবেন না বলে দাবি করলে তাতে আল্লাহর ইনসাফের দাবি করা হয় না, বরং বে-ইনসাফির দাবি করা হয়।

এজন্য আহলুস সুন্নাত এ বিষয়ক কুরআন ও হাদীসের সকল নির্দেশনা আক্ষরিক ও সরল অর্থে বিশ্বাস করেন। আল্লাহর শাস্তির ওয়াদা এবং ক্ষমার ওয়াদা দুটিই তাঁরা বিশ্বাস করেন। মহান আল্লাহর শাস্তি তাঁর ইনসাফ, তাঁর পুরস্কার তাঁর অনুদান এবং তাঁর ক্ষমা তাঁর করুণা। ইমাম আবূ হানীফা এ আকীদাই ব্যাখ্যা করেছেন।

[1] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১২৯ আয়াত। সূরা (৫) মায়িদা ১৮ আয়াত ও সূরা (৪৮) ফাতহ: ১৪ আয়াত।

[2] সূরা (৪) নিসা: ৪৮ আয়াত। আরো দেখুন: ১১৬ আয়াত।

[3] সূরা (৬) আনআম: ১৬০ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৪) নিসা: ৪০ আয়াত; সূরা (২৭) নামল: ৮৯ আয়াত; (২৮) কাসাস: ৮৪ আয়াত; সূরা (৪০) গাফির (মুমিন): ৪০ আয়াত...।

[4] সুরা (২) বাকারা: ২৬১ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২৫) ফুরকান: ৬৯ আয়াত।

[5] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫২০-৫২৮।

[6] সূরা (৯) তাওবা: ৫, ১১ আয়াত।