আরবী মা’রিফাত (المعرفة) শব্দটি আরাফা (عرف) ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত। এর অর্থ (إدراك الشيء بحاسة من حواسه) কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা। এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা (knowledge, education) সবই বুঝানো হয়।
‘জ্ঞান’ বা ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আল্লাহর মারিফাত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের দিকে ধাবিত করে। তবে কুরআন-হাদীসে মূলত ‘ইলম’ এবং ‘ফিকহ’-এর প্রশংসা করা হয়েছে, ‘মারিফাত’-এর কোনো বিশেষ প্রশংসা করা হয় নি। ‘মারিফাত’ ঈমানের পথে পরিচালিত করলে তা প্রশংসনীয়। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘মারিফাত’ অর্জনের পরেও মানুষ কুফর বা অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়। কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদী-খৃস্টানদের অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর দীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ‘মারিফাত’ অর্জনের পরেও কুফরী করত।[1] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ
‘‘অতঃপর যখন তাদের নিকট তা আগমন করল, তারা তার পরিচয় জানার বা মা’রিফাত অর্জনের পরেও কুফরী করল।’’[2]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহর নিয়ামতের মারিফাত (প্রকৃত পরিচয়) তারা লাভ করে- অতঃপর তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।’’[3]
আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকে জাহম ইবন সাফওয়ান প্রচার করেন যে, মারিফতই ঈমান এবং মারিফাতই সব। মারিফতের পরে আর আমলের প্রয়োজন নেই। মুরজিয়া মতবাদের মূল ভিত্তিও এটি। শীয়াগণও ‘মারিফাত’ বিষয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি প্রচার করেন।
কুরআন-হাদীসে ‘মারিফাত’-কে ‘ইলম’-এর চেয়ে নিম্নপর্যায়ে স্থান দেওয়া হয়েছে। মুমিনগণকে ‘মারিফাত’ অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয় নি, বরং ইলম অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কারণ ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের পূর্বের অবস্থা। কিন্তু জাহমীগণ মারিফাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তারা মারিফাতই ঈমান এবং ঈমানই সব, অর্থাৎ মারিফাতই সব বলে দাবি করতেন। শীয়াগণ ‘মারিফাত’-কে ইলম-এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ঈমান ও শরীয়ত থেকে উচ্চপর্যায়ের বিষয় বলে প্রচার করেন এবং মারিফাতকে ‘তত্ত্বজ্ঞান’ বা গোপন ও পৃথক জ্ঞান বলে প্রচার করেন। এ বিষয়ে তারা অনেক জাল হাদীস প্রচার করেন।
ইমাম আযম (রাহ) তাদের এ সকল বিভ্রান্তি দূর করতে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন: (১) মারিফাত ঈমানেরই সহযাত্রী। সকল মুমিনই আল্লাহর সত্যিকার ও পরিপূর্ণ মারিফাত লাভ করেছেন। (২) আল্লাহর মারিফাত গোপন কোনো তত্ত্বজ্ঞান নয় বা তা অর্জনের জন্য গোপন কোনো পথ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াই তাঁর প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মারিফাত। তিনি বলেন: ‘‘মহান আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত আমরা পূর্ণভাবে লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। ... মারিফাত, ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাববাত, রিযা, খাওফ, রাজা এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’
এ প্রসঙ্গে ‘ওসিয়্যাত’ পুস্তিকায় ইমাম আযম (রাহ) বলেন:
الإِيمان وهو إِقرارٌ باللسان وتصديقٌ بالجَنان. والإِقرار وحده لا يكون إِيمانًا ، لأنه لو كان إِيمانًا لكان المنافقون كلهم مؤمنين. وكذلك المعرفة وحدها لا تكون إِيمانًا ، لأنها لو كانت إِيمانًا لكان أهل الكتاب مؤمنين
‘‘ঈমান হচ্ছে মুখের স্বীকৃতি এবং অন্তরের বিশ্বাস। শুধু মুখের স্বীকৃতি ঈমান হতে পারে না; এরূপ হলে তো সকল মুনাফিক-ই মুমিন বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে শুধু ‘মারিফাত’ (অন্তরের জ্ঞান ও পরিচয় লাভ) ঈমান হতে পারে না; তাহলে তো ইহূদী-খৃস্টানগণ সকলেই মুমিন বলে গণ্য হবে। (কারণ আল্লাহ কুরআনে বারবার বলেছেন যে, তারা মারিফাত অর্জন করেছিল)।[4]
[2] সূরা (২) বাকারা: ৮৯ আয়াত।
[3] সূরা (১৬) নাহল: ৮৩ আয়াত।
[4] ইমাম আবূ হানীফা, কিতাবুল ওসিয়্যাত (আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম-সহ), পৃষ্ঠা ৭৬।