আমরা দেখেছি যে, খারিজী ও সমমনা ফিরকাগুলো পাপী মুমিনকে কাফির বলে গণ্য করত। তাদের ‘তাকফীর’-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি ঈমানের প্রকৃতি নির্ধারণের উপর। তারা ‘আমল’ বা ইসলামের বিধান পালনকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করেছে। ফলে বিধান পালনের বিচ্যুতি তাদের মতে ঈমানের বিচ্যুতি বা কুফর বলে গণ্য। এর বিপরীতে মুরজিয়াগণ ঈমানকে আমল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেছে। তাদের মতে কোনোরূপ ইসলাম পালন ছাড়াই ঈমানের চূড়ান্ত পূর্ণতায় পৌঁছানো সম্ভব। তারা পাপী মুসলিমকে পরিপূর্ণ ঈমানদার ও নিশ্চিত জান্নাতী বলে গণ্য করেছে।

উভয় প্রান্তিকতার মাঝে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বিশ্বাস করেন যে, পাপী মুমিন কাফির নন, আবার ঈমানের পূর্ণতাও তিনি লাভ করেন নি। তবে ঈমানের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যায় আহলুস সুন্নাতের ইমামগণের মধ্যে সামান্য কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের দুটি মত রয়েছে:

(১) ইমাম আবূ হানীফা ও কোনো কোনো ইমামের মতে অন্তরের বিশ্বাস ও মুখে সে বিশ্বাসের স্বীকৃতির নামই ঈমান। আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ নয়, বরং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য দাবি ও সম্পূরক। আমলের ঘাটতি বা অনুপস্থিতি ঈমানের ঘাটতি বা অনুপস্থিতি প্রমাণ করে না, তবে দুর্বলতা প্রমাণ করে। বিষয়বস্ত্ত (আরকানুল ঈমান)-এর দিক থেকে ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, তবে গভীরতার দিক দিয়ে হ্রাসবৃদ্ধি হয়।

(২) অন্য তিন ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ বলেন: ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি ও দেহের কর্ম। আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ, তবে মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতির মত ‘অবিচ্ছেদ্য’ অংশ নয়, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘সম্পূরক’ অংশ। এজন্য তাঁদের মতে কর্মের অনুপস্থিতি দ্বারা ঈমানের অনুপস্থিতি প্রমাণিত হয় না, তবে দুর্বলতা ও কমতি প্রমাণিত হয়। আমল বা কর্মের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।

এ দু মতের মধ্যে শব্দ প্রয়োগে যতই পার্থক্য থাক না কেন, মূল বিশ্বাসে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কারণ উভয় মতের অনুসারীগণই একমত যে:

(১) ঈমান ও আমল দুটিই আল্লাহর নির্দেশ এবং বান্দাকে দুটিই অর্জন করতে হবে। ঈমান-হীন ইসলাম বা ইসলাম-হীন ঈমান অকল্পনীয়।

(২) আমল বা কর্মের ত্রুটির কারণে বা কবীরা গোনাহের কারণে বান্দা কাফির হয় না, তবে আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হবে।

উপরে ইমাম আবূ হানীফা এ বিষয়ে তাঁর মত ব্যাখ্যা করে বলেছেন: ‘‘বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে।’’ অর্থাৎ ঈমানের বিষয়বস্ত্তর বা আরকানুল ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। এরূপ কল্পনা করা যায় না যে, একজন মুমিন প্রথমে ৫টি বিষয় বিশ্বাস করত এবং পরে ৬টি বিষয় বিশ্বাস করেছে। তবে ঈমানের গভীরতা ও দৃঢ়তার হ্রাসবৃদ্ধি হয়। কুরআন-হাদীসে যেখানে ঈমানের বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে সেখানে মূলত দৃঢ়তা গভীরতার বৃদ্ধির কথাই বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:


وَالإِيمَانُ وَاحِدٌ وَأَهْلُهُ فِي أَصْلِهِ سَوَاءٌ، وَالتَّفَاضُلُ بَيْنَهُمْ بِالْخَشْيَةِ وَالتُّقَى، وَمُخَالَفَةِ الْهَوَى، وَمُلازَمَةِ الأَوْلَى .... وَالإِيمَانُ: هُوَ الإِيمَانُ بِاللَّهِ، وَمَلائِكَتِهِ، وَكُتُبِهِ، وَرُسُلِهِ، وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ، وَحُلْوِهِ وَمُرِّهِ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى.


‘‘ঈমান একই, এবং ঈমানদারগণ এর মূলে সবাই সমান। তবে, আল্লাহর ভয়, তাক্বওয়া, কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ এবং সর্বদা উত্তম কর্ম সম্পাদনের অনুপাতে তাদের মধ্যে স্তর ও মর্যাদাগত প্রভেদ হয়ে থাকে। ... ঈমান হলো: আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমুহ, তাঁর রাসূলবর্গ, আখিরাতের দিন, এবং ভাল-মন্দ ও মিষ্ট-তিক্তসহ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।’’[1]

[1] তাহাবী, আল-আকীদাহ, পৃ. ১৪-১৫।