‘নেক আমল’ অর্থাৎ আল্লাহর সাওয়াব লাভের জন্য যে বিশ্বাস বা কর্ম পালন করা হয় তা কবুল হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত, তা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত ও তাঁর শিক্ষা অনুসারে পালিত হতে হবে। যদি কোনো ইবাদত তাঁর শেখানো ও আচরিত পদ্ধতিতে পালিত না হয়, তাহলে যত ইখলাস বা আন্তরিকতাই থাক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে কোনো অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হবে না।
আমরা দেখেছি যে, শাহাদাতাইন বা তাওহীদ এবং রিসালাতে বিশ্বাসের মূল অর্থই এটি। বস্ত্তত কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করলে তিনি তা কবুল করবেন তা শিক্ষা দেওয়াই রিসালাতের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে কথা বলেন নি বা যে কাজ করেন নি সে কথা বলা বা সে কাজ করা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অল্প বা বেশি প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করা অথবা এরূপ কাজ না করলে আল্লাহর সন্তুষ্টির কমতি হবে বলে মনে করার অর্থ তাঁর রিসালাতের দায়িত্বের পূর্ণতায় সন্দেহ করা। তিনি ছাড়া অন্য কারো কথা, কর্ম বা রীতি আল্লাহর নিকট কবুলিয়্যাতের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করার অর্থ উক্ত ব্যক্তিকে রিসালাতের মর্যাদায় আসীন করা, যা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।
তাঁর সুন্নাতের ব্যতিক্রম কথা বা কর্ম জায়েয হতে পারে, তবে সাওয়াব বা কবুলের বিষয় হতে পারে না। যে কোনো কর্ম বা কথার মধ্যে যতটুকু ‘‘ইত্তিবায়ে রাসূল’’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণ রয়েছে ততটুকুই কবুল হবে। ইত্তিবার অতিরিক্ত বা ব্যতিক্রম কোনো কিছুই কবুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
‘‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাকারী দয়ালু।’’[1]
এ আয়াত নির্দেশ করে যে, আল্লাহর মহববত ও মাগফিরাত লাভের একমাত্র পথ ‘ইত্তিবায়ে রাসূল’ বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুকরণ-অনুসরণ। তাঁর অনুকরণের বাইরে আল্লাহর মহববত, কুবলিয়্যাত ও মাগফিরাত লাভের কোনো পথ নেই। বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘আমাদের কর্ম যা নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তবে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত (আল্লাহর নিকট কবুল হবে না)।’’[2]
সাহাবীগণ ইত্তিবায়ে রাসূলকেই ইবাদতের একমাত্র ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। উমার (রা) কাবা শরীফে হাজারে আসওয়াদকে সম্বোধন করে বলেন:
أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لا تَضُرُّ وَلا تَنْفَعُ وَلَوْلا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ اسْتَلَمَكَ مَا اسْتَلَمْتُكَ فَاسْتَلَمَهُ ثُمَّ قَالَ فَمَا لَنَا وَلِلرَّمَلِ؟ إِنَّمَا كُنَّا رَاءَيْنَا بِهِ الْمُشْرِكِينَ وَقَدْ أَهْلَكَهُمُ اللَّهُ ثُمَّ قَالَ: شَيْءٌ صَنَعَهُ النَّبِيُّ ﷺ فَلا نُحِبُّ أَنْ نَتْرُكَهُ.
‘‘আমি নিশ্চিতরূপেই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র, কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা তোমার নেই। যদি নবী ﷺ তোমাকে চুম্বন না করতেন তাহলে কখনই আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। এরপর তিনি হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করেন। এরপর তিনি বলেন: তাওয়াফের সময় দৌড়ানোর আর কী প্রয়োজন? আমরা তো মুশরিকদের দেখানোর জন্য এভাবে তাওয়াফ করেছিলাম। আল্লাহ তো মুশরিকদেরকে ধ্বংস করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন: একটি কাজ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেছেন (কোনো যুক্তি বা প্রয়োজন না থাকলেও) আমরা তা পরিত্যাগ করতে চাই না। (আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর পদ্ধতিতে দৌড়ে দৌড়ে তাওয়াফ করব)।’’[3]
এখানে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর বক্তব্য থেকে আমরা দেখি যে ‘ইত্তিবায়ে রাসূল’ (ﷺ) বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ ছাড়া কোনো ইবাদাত নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাবাগৃহের রুকন ইয়ামানী বা দক্ষিণ পশ্চিম কোণ এবং হাজার আসওয়াদ (দক্ষিণ পূর্ব কোণ) স্পর্শ করেন বা চুম্বন করেন। কাবা গৃহের অন্য কোনো স্থান তিনি স্পর্শ করেন নি। কোনো মুমিন যদি হাজার আসওয়াদ (কাল পাথর) চুম্বন করেন, চুম্বন করতে না পারলে স্পর্শ করেন, কোনো লাঠি দিয়ে স্পর্শ করেন বা দূর থেকে ইঙ্গিত করেন তবে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে এবং তিনি সাওয়াব ও কবুলিয়্যাত লাভ করবেন, তার মনের আবেগ যাই হোক না কেন। পক্ষান্তরে তিনি যদি রুকন ইয়ামানী বা হাজার আসওয়াদ ছাড়া অন্য কোনো স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করেন এবং তাতে তার মনের মহা আবেগ, ভাব, ক্রন্দন ইত্যাদি থাকে তবে তার যতই ভাল লাগুক না কেন তাতে কোনো সাওয়াব হবে না; কারণ তা ইত্তিবা না হওয়ার কারণে ইবাদত বলে গণ্য হবে না।
এ বিষয়ে মুজাদ্দিদ-ই-আলফ-ই-সানী, শাইখ আহমদ সারহিন্দী (১০৩৪ হি.) বলেন: ‘‘যদি কেহ সহস্র্ বৎসর ধরিয়া ইবাদত বন্দেগি, কঠোর ব্রত ও অসাধ্য সাধন করে এবং পয়গম্বর (আ.)-গণের অনুসরণের নূরের আলোতে আলোকিত না হয়, তবে উক্ত সাধনার এ কদর্পকও মূল্য হইবে না। দ্বিপ্রহরের নিদ্রা, যাহা পয়গাম্বর (আ.)- গণের সুন্নাত এবং যাহা সরাসরি অচৈতন্য (অর্থাৎ, যাহা কোনো কর্মই নয়, শুধু আরামে অচেতন হওয়া) উল্লেখিত কঠোর সাধনাবলী ইহারও সমতুল্য নহে...।’’[4]
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৭৫ (কিতাবুল ই’তিসাম, বাবু ইযাজতাহাদাল আমিলু..); মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩৪৩ (কিতাবুল আকদিয়া, বাবু নাকদিল আহকামিল বাতিলা..)
[3] বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৭৯ (কিতাবুল হজ্জ, বাবু মা যুকিরা ফিল হাজারিল আসওয়াদি)
[4] মুজাদ্দিদ আলফ সানী, মাকতুবাত শরীফ, ১ম খন্ড, ২য় ভাগ, মাকতুব ১৯১, পৃ: ৭০।