এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘সকল নেককার ও পাপী মুমিনের পিছনে সালাত আদায় বৈধ।’’ এখানে তিনি ইসলামী আকীদার অন্যতম একটি বিষয় অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি যে, ইসলামী আকীদার আলোচ্য বিষয় চারটি: (১) মহান আল্লাহ, (২) নুবুওয়াত, (৩) ইমামাত বা রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ও (৪) আখিরাত। ইমাম আবূ হানীফা এখানে ইমামত প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন।
ইসলামে সালাতের ইমামত ও রাষ্ট্রীয় ইমামত বা রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়ে এবং পরবর্তী কয়েক যুগে সর্বদা রাষ্ট্রপ্রধান বা তার নিযুক্ত আঞ্চলিক প্রধান, বিচারক বা কর্মকর্তাই সালাতের ইমামতি করতেন। জুমুআ ও ঈদের সালাতের জন্য রাষ্টের ইমামের ইমামতি বা অনুমোদন শর্ত বলে গণ্য করেছেন অধিকাংশ ফকীহ। এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাতের বিশ্বাস বর্ণনা করেছেন ইমাম আযম একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে। তা হলো, পাপী ও পুণ্যবান সকলের পিছনেই সালাত বৈধ। সালাতের ইমাম অর্থই রাষ্ট্রীয় ইমাম বা তার নিয়োজিত ব্যক্তি। সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতির জন্য সর্বোত্তম বা সবচেয়ে মুত্তাকী ব্যক্তি হওয়া জরুরী নয়। যদি কোনো ফাসিক ব্যক্তি সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতি গ্রহণ করে তবে তার অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা ও যথাসাধ্য সৎকাজে আদেশসহ রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য বহাল রাখতে হবে। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর আকীদা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম তাহাবী (রাহ)। তিনি বলেন:
وَنَرَى الصَّلاةَ خَلْفَ كُلِّ بَرٍّ وَفَاجِرٍ مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ، وعَلَى مَنْ مَاتَ مِنْهُمْ. وَلا نُنَزِّلُ أَحَدًا مِنْهُمْ جَنَّةً وَلا نَارًا، وَلا نَشْهَدُ عَلَيْهِمْ بِكُفْرٍ وَلا بِشِرْكٍ وَلا بِنِفَاقٍ، مَا لَمْ يَظْهَرْ مِنْهُمْ شَيْءٌ مِنْ ذَلِكَ، وَنَذَرُ سَرَائِرَهُمْ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى. وَلا نَرَى السَّيْفَ عَلَى أَحَدٍ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ﷺ إِلاَّ مَنْ وَجَبَ عَلَيْهِ السَّيْفُ. وَلا نَرَى الْخُرُوجَ عَلَى أَئِمَّتِنَا وَوُلاةِ أُمُورِنَا وَإِنْ جَارُوا، وَلا نَدْعُو عَلَيْهِمْ، وَلا نَنْزِعُ يَدًا مِنْ طَاعَتِهِمْ، وَنَرَى طَاعَتَهُمْ مِنْ طَاعَةِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فَرِيضَةً، مَا لَمْ يَأْمُرُوا بِمَعْصِيَةٍ، وَنَدْعُو لَهُمْ بِالصَّلاحِ وَالْمُعَافَاةِ. وَنَتَّبِعُ السُّنَّةَ وَالْجَمَاعَةَ، وَنَجْتَنِبُ الشُّذُوذَ وَالْخِلافَ وَالْفُرْقَةَ. وَنُحِبُّ أَهْلَ الْعَدْلِ وَالأَمَانَةِ، وَنُبْغِضُ أَهْلَ الْجَوْرِ وَالْخِيَانَةِ. ... وَالْحَجُّ وَالْجِهَادُ مَاضِيَانِ مَعَ أُولِي الأَمْرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، بَرِّهِمْ وَفَاجِرِهِمْ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ، لا يُبْطِلُهُمَا شَيْءٌ وَلا يَنْقُضُهُمَا.
‘‘আমরা কেবলাপন্থী প্রত্যেক নেককার ও পাপী মুসলিমের পিছনে সালাত কায়েম করা এবং তাদের মৃত ব্যক্তির জন্য জানাযার সালাত আদায় করা বৈধ মনে করি। আমরা তাদের কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলে নিশ্চিত সাক্ষ্য প্রদান করি না। তাদের কারো উপর কুফর, শিরক বা নিফাকের সাক্ষ্য প্রদান করি না যতক্ষণ না এ ধরণের কিছু তাদের মধ্যে প্রকাশ্যভাবে দেখা দিবে। তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি আমরা আল্লাহ তা’আলার উপর ছেড়ে দিই। ধর্মীয় বিধান মতে ফরয না হলে মুহাম্মদ ﷺ-এর উম্মাতের কোনো লোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ আমরা বৈধ মনে করি না। আমাদের ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানগণ ও শাসকবর্গ অত্যাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বৈধ মনে করি না। আমরা তাদেরকে অভিশাপ প্রদান করি না এবং তাদের আনুগত্যও বর্জন করি না। আমরা তাদের আনুগত্যকে আল্লাহরই আনুগত্যের অংশ হিসেবে ফরয মনে করি যতক্ষণ না তারা কোনো পাপ কর্মের নির্দেশ দেয়। আর তাদের সংশোধন ও সংরক্ষণের জন্য দু‘আ করি। আমরা সুন্নাত এবং জামা‘আত (ঐক্য) অনুসরণ করি এবং বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য ও মতবিরোধিতা আমরা পরিহার করি। আমরা ন্যায়বিচারক ও দায়িত্ববান-আমানত আদায়কারী শাসকদের ভালবাসি এবং জালিম, দুর্নীতিবাজ বা দায়িত্বে খিয়ানতকারীদের ঘৃণা করি। মুসলিম শাসকের অধীনে- সে নেককার হোক আর পাপী-বদকার হোক- হজ্জ্ব এবং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোনো কিছুই এ দzুটকে বাতিল বা ব্যাহত করতে পারে না।’’[1]
এখানে ইমাম তাহাবী নেককার ও বদকারের ইমামতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এবং বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জিহাদ ও হজ্জ দুটি ইবাদতকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পালনের কথা উল্লেখ করেছেন।