মোল্লা আলী কারীর বক্তব্য থেকে আমরা জানলাম যে, ঈমানের দাবিদার ব্যক্তি কুফরী কর্মে লিপ্ত হলে তার কর্মকে কুফর বলতে হবে, তাকে কুফরী পর্যায়ের পাপে লিপ্ত বলতে হবে, তবে তাকে কাফির বলার আগে তার কোনো ওজর আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। কিছু জানতে না পারলে ওজর আছে বলেই ধরে নিতে হবে। এ দ্বারা তার কুফরী কর্মকে অনুমোদন করা হয় না, বরং ভুলক্রমে মুমিনকে কাফির বলার মহাপাপ থেকে আত্মরক্ষা করা হয়। মুমিন সকল প্রকার কুফর-শিরককে ঘৃণা ও নিন্দা করার পাশাপাশি মুমিনকে কাফির বলার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। এ বিষয়ক বিভিন্ন বক্তব্য আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ এবং ‘‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’’ বইয়ে আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

(১) আমরা দেখেছি যে, কুরআন কারীমে মহান আল্লাহর বিধান অনুসারে ফয়সালা না করাকে কুফর বলা হয়েছে। পাশাপাশি আল্লাহর বিধান বিরোধিতায় লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে মুমিন বলা হয়েছে। হাদীস শরীফে বিভিন্ন কর্মকে কুফর বলা হলেও এরূপ কর্মে লিপ্ত ঈমানের দাবিদারদের মুসলিম বলেই গণ্য করা হয়েছে।

(২) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘একব্যক্তি জীবনভর সীমালঙ্ঘন ও পাপে লিপ্ত থাকে। যখন তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তখন সে তার পুত্রদেরকে ওসিয়ত করে বলে: আমার মৃত্যু হলে তোমরা আমাকে আগুনে পুড়াবে। এরপর আমাকে বিচুর্ণ করবে। এরপর ঝড়ের মধ্যে আমাকে (আমার দেহের বিচুর্ণিত ছাই) সমূদ্রের মধ্যে ছাড়িয়ে দেবে। কারণ, আল্লাহর কসম, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে ধরতে সক্ষম হন তবে আমাকে এমন শাস্তি দিবেন যে শাস্তি তিনি অন্য কাউকে দেন নি। তার সন্তানগণ তার ওসিয়ত অনুসারে কর্ম করে। তখন আল্লাহ যমিনকে নির্দেশ দেন যে যা গ্রহণ করেছে তা ফেরত দিতে। তৎক্ষণাৎ লোকটি পুনর্জীবিত হয়ে তার সামনে দন্ডায়মান হয়ে যায়। তখন তিনি লোকটিকে বলেন: তুমি এরূপ করলে কেন? লোকটি বলে: হে আমার প্রতিপালক: আপনার ভয়ে। তখন তিনি তাকে এজন্য ক্ষমা করে দেন।’’[1]

আমরা দেখি যে, এ ব্যক্তি একটি কুফরী বিশ্বাস পোষণ করেছে। সে ধারণা করেছে যে, তার দেহ এভাবে পুড়িয়ে ছাই করে সমূদ্রে ছড়িয়ে দিলে আল্লাহ তাকে আর পুনরুজ্জীবিত করতে এবং শাস্তি দিতে পারবেন না। তবে তার এ ধারণা ছিল অজ্ঞতা প্রসূত। এজন্য তার মধ্যে বিদ্যমান নির্ভেজাল আল্লাহ-ভীতির কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে আমরা দেখি যে, একটি বিশ্বাস সুনিশ্চিত কুফরী হলেও উক্ত বিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

(৩) মক্কা বিজয়ের পূর্বে হাতিব ইবন আবী বালতা‘আ (রা) যুদ্ধের গোপন বিষয় ফাঁস করে মক্কার কাফিরদের নিকট একটি পত্র লিখেন। পত্রটি উদ্ধার করার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতিব (রা)-কে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, মুনাফিকী বা কুফরীর কারণে তিনি এরূপ করেন নি, বরং নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে এরূপ করেছেন। হাতিবের কর্ম বাহ্যত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) সাথে খিয়ানত ও কুফর ছিল। এজন্য উমার (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি অনুমতি দিন, আমি এ মুনাফিককে হত্যা করি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিষয়ে হাতিবের বক্তব্যকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করেছেন।[2]

অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে একটি কর্ম সুনিশ্চিত কুফর হতে পারে। তবে এরূপ কর্মে লিপ্ত মুমিন যদি এর কোনো ওযর বা ব্যাখ্যা দেন তবে তা গ্রহণ করতে হবে।

(৪) একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন করছিলেন। এমতাবস্থায় যুল খুওয়াইসিরা নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে:


يَا مُحَمَّدُ، اتَّقِ اللَّهَ (مَا عَدَلْتَ)


‘‘হে মুহাম্মাদ, আল্লাহকে ভয় করুন, আপনি তো বে-ইনসাফি করলেন!’’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তাকওয়া বা ইনসাফের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা সুনিশ্চিত কুফর। এজন্য মাজলিসে উপস্থিত খালিদ ইবন ওয়ালীদ (রা) লোকটিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘না। হয়তবা লোকটি সালাত আদায় করে।’’ খালিদ (রা) বলেন: ‘‘কত মুসল্লীই তো আছে যে মুখে যা বলে তার অন্তরে তা নেই।’’ তখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘‘আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, আমি মানুষের অন্তর খুঁজে দেখব বা তাদের পেট ফেড়ে দেখব।’’[3]

এ থেকে আমরা দেখছি যে, কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে মুসলিম দাবি করে এবং ইসলামের ব্যাহ্যিক কিছু কর্ম করে তবে তাকে মুসলিম বলে গণ্য করতে হবে এবং লোকটি কুফরী কথা বললে তার কোনো ওযর আছে বলে ধরে নিতে হবে।

(৫) অজ্ঞতার ওযর সম্পর্কে হুযাইফা (রা) বর্ণিত একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


يَدْرُسُ الإِسْلامُ كَمَا يَدْرُسُ وَشْيُ الثَّوْبِ حَتَّى لا يُدْرَى مَا صِيَامٌ وَلا صَلاةٌ وَلا نُسُكٌ وَلا صَدَقَةٌ وَلَيُسْرَى (وَيسْرِي النسيان) عَلَى كِتَابِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فِي لَيْلَةٍ فَلا يَبْقَى فِي الأَرْضِ مِنْهُ آيَةٌ وَتَبْقَى طَوَائِفُ مِنْ النَّاسِ الشَّيْخُ الْكَبِيرُ وَالْعَجُوزُ يَقُولُونَ أَدْرَكْنَا آبَاءَنَا عَلَى هَذِهِ الْكَلِمَةِ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ فَنَحْنُ نَقُولُهَا. فَقَالَ لَهُ صِلَةُ مَا تُغْنِي عَنْهُمْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَهُمْ لا يَدْرُونَ مَا صَلاةٌ وَلا صِيَامٌ وَلا نُسُكٌ وَلا صَدَقَةٌ فَأَعْرَضَ عَنْهُ حُذَيْفَةُ ثُمَّ رَدَّهَا عَلَيْهِ ثَلاثًا كُلَّ ذَلِكَ يُعْرِضُ عَنْهُ حُذَيْفَةُ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْهِ فِي الثَّالِثَةِ فَقَالَ يَا صِلَةُ تُنْجِيهِمْ مِنْ النَّارِ ثَلاثًا


‘‘কাপড়ের নকশি যেমন মলিন হয়ে মুছে যায় তেমনি মলিন ও বিলীন হয়ে যাবে ইসলাম। এমনকি মানুষ জানবে না যে, সালাত কী? সিয়াম কী? হজ্জ কী, যাকাত কী? এক রাতে কুরআন অপসারিত হবে (বিস্মৃতি কুরআনকে আবৃত করবে) ফলে পৃথিবীতে কুরআনের কোনো আয়াত অবশিষ্ট থাকবে না। অনেক বয়স্ক নারী-পুরুষ রয়ে যাবে যারা বলবে, আমার আমাদের পিতা-পিতামদেরকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’’ কালিমাটি বলতে শুনতাম কাজেই আমরা তা বলি।’’ তখন সিলাহ নামক এক শ্রোতা বলেন, ‘‘তারা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত কিছুই জানে না, কাজেই তাদের জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কোনো কাজে লাগবে না।’’ তখন হুযাইফা মুখ ফিরিয়ে নেন। সিলাহ তিনবার কথাটি বলেন এবং তিন বারই হুযাইফা মুখ ফিরিয়ে নেন। তৃতীয় বারে তিনি বলেন: ‘‘হে সিলাহ, এ কালিমাটি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে।’’ তিনি তিনবার একথাটি বললেন।’’[4]

(৬) ১৭ জন সাহাবী থেকে প্রায় ৫০টি পৃথক সূত্রের হাদীসে খারিজীগণের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বারবার বলেছেন যে, তারা ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে যাবে। সাহাবীগণ এ সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সবাইকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা খারিজীদেরকে কাফির বলে গণ্য করেন নি। তাঁরা সাহাবীগণকে কাফির বলেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তাঁদের নিরস্ত্র পরিজনদেরকে হত্যা করেছে, কিন্তু সাহাবীগণ তাদেরকে কাফির বলেন নি। যুদ্ধের ময়দান ছাড়া তাদের হত্যার অনুমতি দেন নি। তাদের পিছনে সালাত আদায় করেছেন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল রেখেছেন।[5]

(৭) চার ইমাম ও প্রথম যুগগুলোর অন্যান্য ইমাম খারিজী, শীয়া, মুতাযিলী, মুজাসসিমা, মুশাবিবহা, কাদারিয়া ও অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অনেক কর্মকে ‘‘কুফর’’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে এ সকল ফিরকার অনুসারীদের কাফির বলে গণ্য করেন নি। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল বারবার বলেছেন যে, কুরআনকে মাখলূক বা সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করা কুফর। পাশাপাশি তিনি এ কুফরী মতের প্রধান অনুসারী, প্রচারক ও পৃষ্ঠপোষক খলীফা মামুন, মুতাসিম ও ওয়াসিককে মুমিন বলে গণ্য করেছেন, কুফরী আকীদা ও পাপ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাঁদের আনুগত্যের জন্য জনগণকে নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের ও তাঁদের অনুসারী ইমামদের পিছনে জুমুআ ও ঈদের সালাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যান্য ইমামও একই পথ অনুসরণ করেছেন। বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অনেক বিশ্বাস ও কর্ম কুফর বলে গণ্য হলেও এ সকল ফিরকার অনুসারী ব্যক্তি মুসলিমকে তারা কাফির বলে গণ্য করেন নি।

শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দীন ইবন তাইমিয়া বলেন:


وَلا يَجُوزُ تَكْفِيرُ الْمُسْلِمِ بِذَنْبِ فَعَلَهُ وَلَا بِخَطَأِ أَخْطَأَ فِيهِ كَالْمَسَائِلِ الَّتِي تَنَازَعَ فِيهَا ... وَالْخَوَارِجُ الْمَارِقُونَ الَّذِينَ أَمَرَ النَّبِيُّ ﷺ بِقِتَالِهِمْ قَاتَلَهُمْ أَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ عَلِيُّ.. أَحَدُ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ. وَاتَّفَقَ عَلَى قِتَالِهِمْ أَئِمَّةُ الدِّينِ مِنْ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ وَمَنْ بَعْدَهُمْ. وَلَمْ يُكَفِّرْهُمْ عَلِيُّ وَسَعْدُ بْنُ أَبِي وَقَّاصٍ وَغَيْرُهُمَا مِنْ الصَّحَابَةِ بَلْ جَعَلُوهُمْ مُسْلِمِينَ ... وَإِذَا كَانَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ ثَبَتَ ضَلَالُهُمْ بِالنَّصِّ وَالْإِجْمَاعِ لَمْ يُكَفَّرُوا مَعَ أَمْرِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ بِقِتَالِهِمْ فَكَيْفَ بِالطَّوَائِفِ الْمُخْتَلِفِينَ الَّذِينَ اشْتَبَهَ عَلَيْهِمْ الْحَقُّ فِي مَسَائِلَ غَلِطَ فِيهَا مَنْ هُوَ أَعْلَمُ مِنْهُمْ ؟ .. هَذَا مَعَ أَنَّ اللَّهَ أَمَرَ بِالْجَمَاعَةِ والائتلاف وَنَهَى عَنْ الْبِدْعَةِ وَالاخْتِلافِ ...


‘‘কোনো পাপের কারণে বা আকীদাগত মতভেদীয় কোনো বিষয়ে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা বৈধ নয়। .... বিদ্রোহী খারিজীদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। খলীফায়ে রাশেদ আলী (রা) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিষয়ে সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের ইমামগণ সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন। এতদসত্ত্বেও আলী (রা), সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) ও অন্যান্য সাহাবী কেউ তাদেরকে কফির বলেন নি, বরং তাদেরকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করেছেন।.... হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও ইজমার মাধ্যমে যাদের বিভ্রান্তি প্রমাণিত তাদের বিষয়েই এরূপ বিধান। অন্যান্য বিভ্রান্ত দল-উপদলের বিভ্রান্তি আরো অনেক অস্পষ্ট। যে সকল বিষয়ে তারা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে সে সকল বিষয়ে অনেক সময় তাদের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞ আলিমেরও পদস্খলন হয়েছে। .... উপরন্তু মহান আল্লাহ জামাআত বা ঐক্যের ও সম্প্রীতির নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিদআত ও মতভেদ নিষেধ করেছেন।’’[6]

আমরা দেখেছি যে, আল্লাহর বিশেষণ অস্বীকার করা ইমাম আবূ হানীফা ও অন্যান্য ইমাম কুফর বলেছেন। এগুলো মূলত কর্মের বিধান। কিন্তু অনেকে এ বিষয়ে প্রান্তিকতায় নিপতিত হয়েছেন। হাম্বালী-সালাফী ও আশআরী-মাতুরিদীগণ এ প্রসঙ্গে একে অপরকে কাফির বলেছেন। এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘কথার দাবি’ দ্বারা কাফির বলা। কেউ বলেছেন: ‘‘মহান আল্লাহর হাত, মুখমণ্ডল, চক্ষু, আরশের উপরে থাকা, অবতরণ ইত্যাদি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে সে কাফির। কারণ সে মহান আল্লাহকে দেহধারী বলে বিশ্বাস করে।’’ এরা ‘তুলনাযুক্ত’ ও ‘তুলনামুক্ত’ বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য করছেন না। কেউ বলছেন: ‘‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর হাত অর্থ ক্ষমতা, আরশে অধিষ্ঠান অর্থ ক্ষমতা গ্রহণ... বলে বা তাঁর ঊর্ধ্বত্ব অস্বীকার করে সে জাহমী-কাফির; কারণ সে কুরআন বা হাদীস অস্বীকার করে।’’ তারা ইজতিহাদী ব্যাখ্যা ও জেদপূর্বক অস্বীকারের মধ্যে পার্থক্য করছেন না।

যে ব্যক্তি কুরআন-হাদীসের কোনো বক্তব্য বা বিশেষণ ইজতিহাদী কারণে ব্যাখ্যা করা জরুরী মনে করেন তার প্রসঙ্গে ইবন তাইমিয়া বলেন: তার ইজতিহাদ ভুল হলেও তিনি কাফির নন। মৃতদেহ পোড়ানোর ওসিয়তকারী আল্লাহর ‘কুদরত’ বিশেষণ অবিশ্বাস করেছিল। এরপরও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। এ বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন:


وَالْمُتَأَوِّلُ مِنْ أَهْلِ الِاجْتِهَادِ الْحَرِيصُ عَلَى مُتَابَعَةِ الرَّسُولِ أَوْلَى بِالْمَغْفِرَةِ مِنْ مِثْلِ هَذَا .


‘‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে সচেষ্ট, তবে ইজতিহাদের কারণে এরূপ তাবীল-ব্যাখ্যা করেন তিনি এ ব্যক্তির চেয়ে ক্ষমা লাভের অধিক যোগ্য।’’[7]

ইবন তাইমিয়া আরো বলেন:


أَنِّي مِنْ أَعْظَمِ النَّاسِ نَهْيًا عَنْ أَنْ يُنْسَبَ مُعَيَّنٌ إلَى تَكْفِيرٍ وَتَفْسِيقٍ وَمَعْصِيَةٍ، إلَّا إذَا عُلِمَ أَنَّهُ قَدْ قَامَتْ عَلَيْهِ الْحُجَّةُ الرسالية الَّتِي مَنْ خَالَفَهَا كَانَ كَافِرًا تَارَةً وَفَاسِقًا أُخْرَى وَعَاصِيًا أُخْرَى وَإِنِّي أُقَرِّرُ أَنَّ اللَّهَ قَدْ غَفَرَ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ خَطَأَهَا : وَذَلِكَ يَعُمُّ الْخَطَأَ فِي الْمَسَائِلِ الْخَبَرِيَّةِ الْقَوْلِيَّةِ وَالْمَسَائِلِ الْعَمَلِيَّةِ.


‘‘কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাফির বলা, ফাসিক বলা বা পাপী বলা আমি কঠোরভাবে নিষেধ করি। কেবলমাত্র যদি কারো বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সুনিশ্চিতভাবে কুফর, ফিসক বা পাপাচার প্রমাণিত হয় তবেই তা বলা যাবে। আমি নিশ্চিত যে, মহান আল্লাহ এ উম্মাতের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করেছেন। আর ফিকহী মাসআলার ভুল এবং আকীদা বিষয়ক ভুল উভয় প্রকারের ভুলই এ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত।’’[8]

আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি) বলেন:


لا يكفر بها حَتَّى الْخَوَارِجُ الَّذِينَ يَسْتَحِلُّونَ دِمَاءَنَا وَأَمْوَالَنَا وَسَبَّ الرَّسُولِ، وَيُنْكِرُونَ صِفَاتِهِ تَعَالَى وَجَوَازَ رُؤْيَتِهِ لِكَوْنِهِ عَنْ تَأْوِيلٍ وَشُبْهَةٍ بِدَلِيلِ قَبُولِ شَهَادَتِهِمْ، إلا الْخَطَّابِيَّةِ... وَإِنْ أَنْكَرَ بَعْضَ مَا عُلِمَ مِنْ الدِّينِ ضَرُورَةً كَفَرَ بِهَا


‘‘এমনকি খারিজীগণ, যারা আমাদের রক্তপাত ও ধনসম্পদ বৈধ বলে গণ্য করে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গালি প্রদান করে, মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহ অস্বীকার করে এবং আখিরাতে তাঁর দর্শন অস্বীকার করে তাদেরও এগুলির কারণে কাফির বলা হয় না। কারণ তাদের এ সকল মতের কারণ ব্যাখ্যা ও কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ বুঝতে অস্পষ্টতা বা ভুল বুঝা। এর প্রমাণ যে, মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ মামলা-মুকাদ্দামায় তাদের সাক্ষ্য কবুল করা হয়। তবে কেবল খাত্তাবিয়্যাহ ফিরকাকে কাফির বলা হয়েছে।[9] আর কোনো ফিরকা যদি দীনের কোনো অত্যাবশ্যকীয় সর্বজনজ্ঞাত বিশ্বাস অস্বীকার করে তবে এরূপ বিদ‘আতের কারণে সে কাফির বলে গণ্য হবে।’’[10]

আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী বলেন:


نقل عن السلف - منهم إمامنا أبو حنيفة - أنا لا نكفر أحدا من أهل القبلة وعليه بنى أئمة الكلام عدم تكفير الروافض والخوارج والمعتزلة والمجسمة وغيرها من فرق الضلالة سوى من بلغ اعتقاده منهم إلى الكفر


‘‘সালাফ সালিহীন- আমাদের ইমাম আবূ হানীফাও তাঁদের অন্তর্ভূক্ত- থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আমরা কোনো আহলু কিবলাকে কাফির বলি না। এ বক্তব্যের ভিত্তিতেই আকীদাবিদগণ মূলনীতি তৈরি করেছেন যে, শীয়া-রাফিযী, খারিজী, মুতাযিলী, মুজাস্সিমা (দেহে বিশ্বাসী) ও অন্যান্য বিভ্রান্ত ফিরকাকে কাফির বলা যাবে না। তবে কারো আকীদা বিশ্বাস যদি কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে যায় তবে ভিন্ন কথা।’’[11]

মোল্লা আলী কারী আল্লামা ইবন হাজার মাক্কীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন:


الصواب عند الأكثرين من علماء السلف والخلف أنا لا نكفر أهل البدع والأهواء إلا إن أتوا بمكفر صريح لا استلزامي لأن الأصح أن لازم المذهب ليس بلازم ومن ثم لم يزل العلماء يعاملونهم معاملة المسلمين في نكاحهم وإنكاحهم والصلاة على موتاهم ودفنهم في مقابرهم لأنهم وإن كانوا مخطئين غير معذورين حقت عليهم كلمة الفسق والضلال إلا أنهم لم يقصدوا بما قالوه اختيار الكفر وإنما بذلوا وسعهم في إصابة الحق فلم يحصل لهم لكن لتقصيرهم بتحكيم عقولهم وأهويتهم وإعراضهم عن صريح السنة والآيات من غير تأويل سائغ وبهذا فارقوا مجتهدي الفروع فإن خطأهم إنما هو لعذرهم بقيام دليل آخر عندهم مقاوم لدليل غيرهم من جنسه فلم يقصروا ومن ثم أثيبوا على اجتهادهم


‘‘সালাফ সালিহীন এবং পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলিমের নিকট সঠিক মত এই যে, বিদআতপন্থী এবং বিভ্রান্ত ফিরকাগুলোর অনুসারীদেরকে আমরা কাফির বলব না। তবে যদি তারা সুস্পষ্ট কোনো কুফরী কর্ম বা মত গ্রহণ করে তবে তাদেরকে কাফির বলা হবে। কারো আকীদার দাবি বা পরিণতির অজুহাতে তাকে কাফির বলা যাবে না। কারণ সঠিক মত এই যে, কারো মতের দাবি বা পরিণতি তার মত বলে গণ্য নয়। আর এজন্যই সকল যুগেই আলিমগণ বিভ্রান্ত ফিরকার অনুসারীদের সাথে মুসলিম হিসেবেই আচরণ করেছেন, যেমন তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক, তাদের মৃতদের জানাযার সালাত আদায়, মুসলিমদের গোরস্থানে দাফন করা ইত্যাদি। এ সকল সম্প্রদায় ভুলের মধ্যে নিপতিত এবং তাদের এ ভুলের পক্ষে তাদের কোনো ওযর বা গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। এজন্য তাদেরকে পাপী ও পথভ্রষ্ট বলতে হবে। তবে তাদের উদ্দেশ্য কুফরী করা নয়। তারা সত্য সন্ধানে ইজতিহাদ বা চেষ্টা করেছে তবে সত্যে পৌঁছাতে পারে নি। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির উপর ও নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করা এবং গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছাড়া সুস্পষ্ট সুন্নাত এবং কুরআনের আয়াতগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণেই তারা সত্যে না পৌঁছে বিভ্রান্ত হয়েছে। আর এখানেই ফিকহী বিষয়ে ইজতিহাদকারীর সাথে তাদের পার্থক্য। ফিকহী বিষয়ে ইজতিহাদকারী ভিন্নমতের একটি দলীলের বিপরীতে একই পর্যায়ের অন্য দলীল থাকার কারণে ভিন্নমত পোষণ করেন। এজন্য তিনি ইজতিহাদের জন্য সাওয়াব লাভ করেন।’’[12]

ইমাম আবূ হানীফা এ পরিচ্ছেদে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের এ মূলনীতি অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর অন্যান্য গ্রন্থেও তিনি এ বিষয়টি বারবার আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা দেখেছি যে, ইমাম আযম তাঁর ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ গ্রন্থে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ বা শ্রেষ্ঠতম ফিকহের সংজ্ঞায় বলেছেন: ‘‘পাপের কারণে কোনো কিবলাপন্থী মুসলিমকে কাফির বলবে না এবং কারো ঈমান অস্বীকার করবে না।’’ এ পুস্তকে তাঁর আরেকটি বক্তব্য দেখুন:


قُلْتُ: أَرَأَيْتَ لَوْ أَنَّ رَجُلاً قَالَ: مَنْ أَذْنَبَ ذَنْباً فَهُوَ كَافِرٌ، مَا النَّقْضُ عَلَيْهِ؟ فَقَالَ: يُقَالُ لَهُ: قَالَ اللهُ تَعَالَى: "وَذَا النُّونِ إِذْ ذَهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَنْ لَنْ نَقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ"، فَهُوَ ظَالِمٌ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ بِكَافِرٍ وَلاَ مُنَافِقٍ. وَإِخْوَةُ يُوْسُفَ قَالُوْا: "يَا أَبَانَا اسْتَغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا إِنَّا كُنَّا خَاطِئِينَ"، وَكَانُوْا مُذْنِبِيْنَ لاَ كَافِرِيْنَ. وَقَالَ اللهُ تَعَالَى لِمُحَمَّدٍ ﷺ "لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ"، وَلَمْ يَقُلْ: مِنْ كُفْرِكَ. وَمُوْسَى حِيْنَ قَتَلَ الرَّجُلَ كَانَ فِيْ قَتْلِهِ مُذْنِباً لاَ كَافِراً


‘‘আবূ মুতী বলেন: যদি কেউ বলে, যে পাপে লিপ্ত হয় সে-ই কাফির, তবে তার বক্তব্য কিরূপে খন্ডন করা হবে তা বলুন। তিনি (ইমাম আবূ হানীফা) বলেন: তাকে বলা হবে: আল্লাহ তাআলা বলেছেন[13]: ‘‘এবং স্মরণ কর যুন্নুন-ইউনূস-এর কথা যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, আমি তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না; অতঃপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র মহান, নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।’’ তাহলে তিনি যালিম মুমিন, কাফিরও নন, মুনাফিকও নন। ইউসূফের ভাইগণ বলেছিলেন[14]: ‘‘হে আমাদের পিতা, আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন; নিশ্চয় আমরা ছিলাম অপরাধী’’; তাঁরা ছিলেন পাপী, কিন্তু তাঁরা কাফির ছিলেন না। আর মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বলেছেন[15]: ‘‘যেন আল্লাহ মার্জনা করেন ‘তোমার ত্রুটি’ অতীত ও ভবিষ্যতের’’, তিনি বলেন নি: ‘‘তোমার কুফর’’। আর মূসা (আঃ) যখন সে মানুষটিকে হত্যা করলেন তিনি হত্যার কারণে অপরাধী হন, কাফির হন নি।’’[16]

আল-ফিকহুল আবসাত গ্রন্থে আবূ মুতী ও ইমাম আযমের আরেকটি কথোপকথন:


قُلْتُ لَهُ: مَا تَقُوْلُ فِيْ الْخَوَارِجِ الْمُحَكِّمَةِ؟ قَالَ: هُمْ أَخْبَثُ الْخَوَارِجِ. قُلْتُ لَهُ: أَتُكَفِّرُهُمْ؟ قَالَ: لاَ، وَلَكِنْ نُقَاتِلُهُمْ عَلَى مَا قَاتَلَهُمْ الأَئِمَّةُ مِنْ أَهْلِ الْخَيْرِ وَعَلِيٌّ وَعُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيْزِ؛ فَإِنَّ الْخَوَارِجَ يُكَبِّرُوْنَ وَيُصَلُّوْنَ وَيَتْلُوْنَ الْقُرْآنَ .... فَكُفْرُ الْخَوَارِجِ كُفْرُ النِّعَمِ كُفْرٌ بِمَا أَنْعَمَ اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِمْ.


‘‘আমি (আবু মুতী) তাঁকে বললাম: হুকুম-পন্থী খারিজীগণ (যারা বলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে হুকুম-বিধান-এর ক্ষমতা প্রদান বা কারো হুকুম-বিধান পালন করা কুফর)-এর বিষয়ে আপনি কী বলেন? তিনি (ইমাম আবূ হানীফা) বলেন: এরা হলো খারিজীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দল। আমি বললাম: আপনি কি তাদেরকে কাফির বলেন? তিনি বলেন: না, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি যেভাবে নেককার ইমাম-রাষ্ট্রপ্রধানগণ, আলী (রা) এবং উমার ইবন আব্দুল আযীয (রাহ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। .... কারণ খারিজীগণ তাকবীর বলে, সালাত আদায় করে, কুরআন তিলাওয়াত করে.... অতএব খারিজীদের কুফর হচ্ছে নিয়ামতের কুফর বা অকৃতজ্ঞতা, আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের অস্বীকার ও অকৃতজ্ঞতা।’’[17]

ইমাম আবূ হানীফা রচিত অন্য পুস্তিকা ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’-এ এক স্থানে ইমাম আযমের সাথে আবূ মুকাতিলের আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর নিম্নরূপ:


أَخْبِرْنِيْ عَمَّنْ يَشْهَدُ عَلَيْكَ بِالْكُفْرِ، مَا شَهَادَتُكَ عَلَيْهِ؟ فَقَالَ...: شَهَادَتِيْ عَلَيْهِ أَنَّهُ كَاذِبٌ، وَلاَ أُسَمِّيْهِ بِذَلِكَ كَافِراً، وَلَكِنْ أَسَمِّيْهِ كَاذِباً؛ لأَنَّ الْحُرْمَةَ حُرْمَتَانِ: حُرْمَةٌ تُنْتَهَكُ مِنَ اللهِ تَعَالَى، وَحُرْمَةٌ تُنْتَهَكُ مِنْ عَبِيْدِ اللهِ سُبْحَانَهُ، وَالْحُرْمَةُ الَّتِيْ تُنْتَهَكُ مِنْ عَبِيْدِ اللهِ، فَذَلِكَ مَا يَكُوْنُ بَيْنَهُمْ مِنَ الْمَظَالِمِ. وَلاَ يَنْبَغِيْ أَنْ يَكُوْنَ الَّذِيْ يَكْذِبُ عَلَى اللهِ وَعَلَى رَسُوْلِهِ ﷺ كَالَّذِيْ يَكْذِبُ عَلَىَّ؛ لأَنَّ الِّذِيْ يَكْذِبُ عَلَى اللهِ وَعَلَى رَسُوْلِهِ ذَنْبُهُ أَعْظَمُ مِنْ أَنْ لَوْ كَذَبَ عَلَى جَمِيْعِ النَّاسِ؛ فَالَّذِيْ شَهِدَ عَلَيَّ بِالْكُفْرِ فَهُوَ عِنْدِيْ كَاذِبٌ، وَلاَ يَحِلُّ لِيْ أَنْ أَكْذِبَ عَلَيْهِ لِكَذِبِهِ عَلَيَّ؛ لأَنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ: "وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى".


‘‘আবূ মুকাতিল বলেন: যে ব্যক্তি আপনাকে কাফির বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে, তার বিষয়ে আপনি কি সাক্ষ্য দিবেন? উত্তরে ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘‘তার বিষয়ে আমার সাক্ষ্য যে, সে মিথ্যাবাদী। এজন্য আমি তাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করি না, বরং তাকে মিথ্যাবাদী বলি। কারণ মর্যাদা বা হক্ক দু প্রকার। এক হলো আল্লাহর হক্ক বা মর্যাদা নষ্ট করা, অন্যটি হলো আল্লাহর বান্দাদের হক্ক বা মর্যাদা নষ্ট করা। আল্লাহর বান্দাগণের মর্যাদা বা হক্ক নষ্ট করা হলো তাদের মধ্যকার জুলুম ও অন্যায়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ বিষয়ে যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার অবস্থা আর আমার বিষয়ে যে মিথ্যা বলে তার অবস্থা এক হতে পারে না। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ নামে মিথ্যা বলছে তার পাপ দুনিয়ার সকল মানুষের নামে মিথ্যা বলার চেয়েও ভয়ঙ্করতর। অতএব যে ব্যক্তি আমাকে কাফির বলে সাক্ষ্য দেয় সে ব্যক্তি আমার মতে মিথ্যাবাদী। তবে সে আমার বিষয়ে মিথ্যা বলেছে এ অজুহাতে তার বিষয়ে মিথ্যা বলা আমার জন্য বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ বলেছেন[18]: ‘‘কোনো গোষ্ঠীর সাথে শত্রুতা যেন তোমাদেরকে বে-ইনসাফী করার প্ররোচনা না দেয়; তোমরা ইনসাফ করবে; ইনসাফ তাকওয়ার সাথে সুসমঞ্জস’’...।’’[19]

এখানে ইমাম আযম আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কর্মধারা ব্যাখ্যা করেছেন, তা হলো প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বী মুমিনের বাহ্যত কুফরী কথা ব্যাখ্যা করে তাকে মুমিন বলে গণ্য করার চেষ্টা। আমরা দেখেছি যে, বিভ্রান্ত দলগুলো ভিন্নমতের মুমিনদেরকে কাফির বলতে উদগ্রীব থাকে। কোনো সুস্পষ্ট অজুহাত না পেলে তার কোনো একটি বক্তব্য ব্যাখ্যা করে তার ভিত্তিতে তাকে কাফির বলে। পক্ষান্তরে সাহাবীগণ ও আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ ভিন্নমতের মুমিনকে মুমিন বলতে উদগ্রীব। তার কথার মধ্যে সুস্পষ্ট কুফরী থাকলেও তা ব্যাখ্যা করে তাকে মুমিন বলতে চেষ্টা করেন তারা। বিষয়টি ইমাম আবূ হানীফা এখানে ব্যাখ্যা করেছেন।

আমরা দেখেছি যে, খারিজী ও অন্যান্য বিভ্রান্ত দল সুন্নাত অনুসারীদের কাফির বলত। ইমাম আবূ হানীফাকেও তারা কাফির বলেছে। প্রায় মুতাওয়াতির হাদীসে বলা হয়েছে যে, মুমিনকে কাফির বলা কুফরী। এ সকল হাদীসের দলীল দিয়ে ইমাম আযম বলতে পারতেন যে আমাকে কাফির বলে সে কাফির। কারণ (১) অনেকগুলো সহীহ হাদীস দ্বারা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে, মুমিনকে কাফির বলা কুফরী, (২) আমি নিশ্চিতভাবেই মুমিন, (৩) কাজেই যে আমাকে কাফির বলেছে সে নিশ্চিতভাবেই কাফির। কিন্তু আহলুস সুন্নাত-এর ইমামগণ প্রতিপক্ষকে কাফির বানাতে উদগ্রীব ছিলেন না, বরং প্রতিপক্ষকে মুমিন বলে দাবি করতে উদগ্রীব ছিলেন। এজন্য অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণতার সাথে ইমাম আযম তাকে মিথ্যাবাদী মুমিন বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ গ্রন্থের আরেকটি বক্তব্য দেখুন:


فَقُلْتُ: إِذَا أَنْكَرَ بِشَيْءٍ مِنْ خَلْقِهِ فَقَالَ: لاَ أَدْرِيْ مَنْ خَالِقُ هَذَا؟ قَالَ: فَإِنَّهُ كُفْرٌ لِقَوْلِهِ تَعَالَى "خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ"، فَكَأَنَّهُ قَالَ: لَهُ خَالِقٌ غَيْرُ اللهِ. وَكَذَلِكَ لَوْ قَالَ: لاَ أَعْلَمُ أَنَّ اللهَ فَرَضَ عَلَيَّ الصَّلاَةَ وَالصِّيَامَ وَالزَّكَاةَ، فَإِنَّهُ قَدْ كَفَرَ، لِقَوْلِهِ تَعَالَى "أَقِيْمُوْا الصَّلاَةَ وَآتُوْا الزَّكَاةَ" وَلِقَوْلِهِ تَعَالَى: "كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ"، وَلِقَوْلِهِ تَعَالَى: "فَسُبْحَانَ اللهِ حِيْنَ تُمْسُوْنَ وَحِيْنَ تُصْبِحُوْنَ وَلَهُ الْحَمْدُ فِيْ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَشِيًّا وَحِيْنَ تُظْهِرُوْنَ". فَإِنْ قَالَ: أُوْمِنُ بِهَذِهِ الآيَةِ وَلاَ أَعْلَمُ تَأْوِيْلَهَا وَلاَ أَعْلَمُ تَفْسِيرَهَا، فَإِنَّهُ لاَ يَكْفُرُ؛ لأَنَّهُ مُؤْمِنٌ بِالتَّنْزِيْلِ وَمُخْطِئٌ فِيْ التَّفْسِيْرِ.


‘‘আমি (আবূ মুতী বালখী) বললাম: যদি কেউ আল্লাহর কোনো সৃষ্টি অস্বীকার করে বলে, এ বস্ত্ত কে সৃষ্টি করেছেন তা আমি জানি না, তাহলে তার বিধান কী? তিনি (আবূ হানীফা) বলেন: এ তো কুফরী করল; কারণ আল্লাহ বলেছেন[20]: ‘‘তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকারী’’; আর উপরের কথা দ্বারা সে যেন বলল, এ দ্রব্যটির আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে। অনুরূপভাবে যদি সে বলে, আল্লাহ আমার উপর সালাত, সিয়াম ও যাকাত ফরয করেছেন বলে আমি জানি না (অর্থাৎ এগুলির আবশ্যকতা সে অস্বীকার করে) তবে সে কাফির হবে। কারণ আল্লাহ বলেছেন: ‘‘সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর’’[21], এবং বলেছেন: ‘‘তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ হলো’’।[22] আল্লাহ আরো বলেছেন: ‘‘অতএব আল্লাহর তাসবীহ যখন তোমরা সন্ধ্যায় উপনীত হও এবং যখন তোমরা প্রভাতে উপনীত হও। এবং তাঁরই জন্য প্রশংসা আসমানসমূহ এবং যমীনে অপরাহ্নে এবং যখন তোমরা যুহরের সময়ে উপনীত হও।’’[23] (এ আয়াতে আল্লাহ সময়ের উল্লেখ করে সালাতের নির্দেশ দিয়েছেন, কাজেই তা অস্বীকার করলে কাফির হবে।) যদি সে বলে আমি এ আয়াত বিশ্বাস করি, তবে এর ব্যাখ্যা জানি না, তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে না। কারণ সে কুরআনকে বিশ্বাস ও স্বীকার করেছে, কিন্তু ব্যাখ্যায় ভুল করেছে।’’[24]

এ পুস্তকে আরো অনেক বিষয় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যার মূল কথা একটিই: ঈমানের দাবিদারকে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা ও ওজর-অজুহাতের মাধ্যমে মুমিন বলে গণ্য করার চেষ্টা করা। যদি কেউ কুরআনের সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত কোনে বিষয় অস্বীকার করার ঘোষণা দেয় তবে সে কাফির। আর যদি সে ব্যাখ্যায় ভুল করে, বা কোনো বিশেষ ব্যাখ্যা অস্বীকার করে তাহলে তাকে কাফির বলা যাবে না।Anchor

এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেন :


لا ينبغي لأحد من أهل الإسلام أن يشهد على رجل من أهل الإسلام بذنب أذنبه بكفر وإن عظم جرمه وهو قول أبي حنيفة والعامة من فقهائنا


‘‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলে সাক্ষ্য দিবে, সে পাপ যতই বড় হোক না কেন। এটিই আবূ হানীফার মত এবং আমাদের ফকীহগণের সকলের মত।’’[25]

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৮৩ (কিতাবুল আম্বিয়া, বাবু আম হাসিবতা...); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২১১০ (কিতাবুত তাওবা, বাবুন ফী সাআতি রাহমাতিল্লাহ)

[2] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৯৫ (কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার, বাবুল জাসূস); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৪১ (কিতাবু ফাদাইলিস সাহাবা, বাবুন মিন ফাদাইলি আহলি বাদর ওয়া কিস্সাতি হাতিব..)।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২১৯, ১৩২১, ৪/১৫৮১, ১৭১৪, ৫/২২৮১, ৬/২৫৪০, ২৭০২; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৪১-৭৪৪।

[4] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৩৪৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৫২০, ৫৮৭; ইবনু কাসীর, আন-নিহায়াতু ফিল ফিতানি ওয়াল মালাহিম ১/১০; বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ৪/১৯৪; আলবানী, সাহীহাহ ১/৮৭ সহীহু সুনানি ইবন মাজাহ ২/৩৭৮।

[5] বিস্তারিত দেখুন: ইসলামের নামে জাঙ্গিবাদ ও কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা।

[6] ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ৩/২৮২- ২৮৬।

[7] ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ৩/২৩১।

[8] ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ৩/২২৯।

[9] খাত্তাবিয়্যাহ সম্প্রদায় বিশ্বাস করত যে, আলী (রা) ও তাঁর বংশের ইমামগণ আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়পাত্র, তাঁদের মধ্যে ‘উলূহিয়্যাত’ বা আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণে ইলাহ হওয়ার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। আল্লাহর সাথে সুস্পষ্ট শির্ক করার কারণে এদেরকে কাফির বলা হয়েছে। দেখুন: বাগদাদী, আব্দুল কাহির, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২৪৭।

[10] ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/৫৬১।

[11] আব্দুল হাই লাখনবী, আত-তালীকুল মুমাজ্জাদ, ইমাম মুহাম্মাদের মুআত্তাসহ ৩/৪০৪।

[12] মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ ১/৩০৬ (কিতাবুল ঈমান, ঈমান বিল কাদার)।

[13] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৮৭ আয়াত।

[14] সূরা (১২) ইউসূফ: ৯৭ আয়াত।

[15] সূরা (৪৮) ফাতহ: ২ আয়াত।

[16] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫৫-৫৬।

[17] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪৫-৪৬।

[18] সূরা (৫) মায়িদা: ৮ আয়াত।

[19] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩২।

[20] সূরা (৬) আনআম: ১০২ আয়াত।

[21] সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৮ আয়াত; সূরা (৫৮): ১৩ আয়াত।

[22] সূরা (২) বাকারা: ১৮৩ আয়াত।

[23] সূরা (৩০) রূম: ১৭-১৮ আয়াত।

[24] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪২-৪৩।

[25] মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মুআত্তা ৩/৪০৪।