আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফাকে ফিকহের ইমাম বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর ফিকহ সহীহ হাদীস নির্ভর বলেও তাঁরা স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু তৃতীয় শতকের শুরু থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ফিকহী অযোগ্যতার বহুমুখি অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকে। বলা হতে থাকে যে, ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি অনভিজ্ঞ, অসমর্থ ও অযোগ্য ছিলেন। তিনি আরবী ভাষা জানতেন না। তিনি কোনো হাদীস জানতেন না তাই মনগড়াভাবে হাদীস বিরোধী মাসআলা দিতেন। তিনি সহীহ হাদীস অস্বীকার ও অমান্য করে নিজের কিয়াস মত ফাতওয়া দিতেন। তিনি দীনকে ধ্বংস করেছেন!!! .... ইত্যাদি। আমরা এখানে প্রথম এবং শেষদিক থেকে দুজন অভিযোগকারীর বক্তব্য উল্লেখ করছি।

১৩. ১. ইবন আবী শাইবা (১৫৯-২৩৫ হি)

তৃতীয় হিজরী শতকের সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ বকর আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবী শাইবা কূফী (রাহ)। হাদীসে নববী এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত ও কর্মের সংকলনে তাঁর ‘‘আল-মুসান্নাফ’’ গ্রন্থটি সুপ্রসিদ্ধ। তিনি এ গ্রন্থের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফার মত খন্ডনের জন্য ‘‘কিতাবুর রাদ্দি আলা আবী হানীফাহ’’ (আবূ হানীফার মত খন্ডনের অধ্যায়) নামে একটি অধ্যায় সংকলন করেছেন। এ অধ্যায়ে ১২৫টি পরিচ্ছেদে তিনি ইমাম আবূ হানীফার ১২৫টি ফিকহী মত হাদীস বিরোধী বলে খন্ডন করতে ৪৮৫টি হাদীস বা সাহাবী-তাবিয়ীর মত উল্লেখ করেছেন।[1]

১৩. ২. ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হি)

পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের প্রসিদ্ধতম শাফিয়ী ফকীহ, উসূলবিদ, সূফী ও দার্শনিক ইমাম আবূ হামিদ মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ গাযালী (রাহ), যার পরিচয় কারোই অজানা নয়। ফিকহ ও উসূল ফিকহ বিষয়ে তাঁর লেখা বই শাফিয়ী মাযহাবের অন্যতম পাঠ্য ও তথ্য গ্রন্থ। তিনি তাঁর ‘‘আল-মানখূল’’ নামক উসূলুল ফিকহ বিষয়ক গ্রন্থে বিভিন্ন স্থানে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেছেন। এখানে কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করছি:


ولا اكتراث بمخالفة أبي حنيفة فيها فإني أقطع بخطئه في تسعة أعشار مذهبه...وأما مالك فكان من المجتهدين نعم له زلل .. وأما أبو حنيفة فلم يكن مجتهدا لأنه كان لا يعرف اللغة ... وكان لا يعرف الأحاديث ولهذا رضي بقبول الأحاديث الضعيفة ورد الصحيح منها ولم يكن فقيه النفس بل كان يتكايس لا في محله... فكثر خبطه لذلك ... ولذلك استكنف كان أبو يوسف ومحمد من اتباعه في ثلثي مذهبه لما رأوا فيه من كثرة الخبط والتخليط والتورط في المناقضات... وأما أبو حنيفة رحمه الله فقد قلب الشريعة ظهرا لبطن وشوش مسلكها وغير نظامها.. ومن هذا اشتد المطعن والمغمز من سلف الأئمة فيه إذ اتهموه برومه خرم الشرع.. ولعل الناظر .. يظننا نتعصب للشافعي...على ابي حنيفة.. وهيهات فلسنا فيه إلا منصفين ومقتصدين عن مقتصرين على اليسير من الكثير


‘‘আবূ হানীফার বিরোধিতাকে আমি মোটেও পরোয়া করি না। কারণ আমি সুনিশ্চিত যে, তাঁর মাযহাবের দশভাগের নয় ভাগই ভুল, ... মালিক মুজতাহিদ ছিলেন। হাঁ, তাঁর কিছু ভুল ছিল। ... আর আবূ হানীফা মূলতই মুজতাহিদ ছিলেন না। কারণ তিনি আরবী ভাষা জানতেন না।... এবং তিনি হাদীস জানতেন না; এজন্য তিনি যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করতে রাযী হন এবং সহীহ হাদীস প্রত্যাখ্যান করেন। ফিকহী মানসিকতাই তাঁর ছিল না; এজন্য তিনি এমন স্থানে কিয়াস করতেন যেখানে কিয়াস করা হয় না....। এজন্য তাঁর ভুলভ্রান্তি ব্যাপক হয়। একারণে আবূ ইউসূফ ও মুহাম্মাদ তাঁর মাযহাবের দুইতৃতীয়াংশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন; কারণ তাঁরা এর মধ্যে ভুলভ্রান্তি, গোঁজামিল ও স্ববিরোধিতার ব্যাপকতা দেখতে পান। ... আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ শরীয়তকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছেন, উপরকে নিচে ও নিচেকে উপরে করেছেন, শরীয়তের ধারা কলুষিত করেছেন এবং এর পদ্ধতি পরিবর্তন করেছেন।... এজন্যই উম্মতের সালফে সালেহীন তাঁর বিষয়ে কঠিন আপত্তি ও নিন্দা করেছেন। তাঁরা তাঁকে শরীয়ত নষ্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।... হয়ত পাঠক ধারণা করবেন যে, আমরা শাফিয়ীর পক্ষে মাযহাবী গোঁড়ামি বশত আবূ হানীফার বিরুদ্ধে এরূপ বলছি। .... কখনোই নয়। এ সকল কথা বলার ক্ষেত্রে আমরা একান্তই ইনসাফ অবলম্বন করে কথাগুলো বলেছি, মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছি এবং এ বিষয়ে অনেক কথা বলা যেত তবে আমরা অল্প কথা বলে শেষ করছি।’’[2]

[1] ইবন আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৪/১৪৮-২৮২।

[2] গাযালী, আল-মানখূল, পৃ. ৫৪৬, ৫৭৯- ৫৮১, ৬০৮-৬১৮।