আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

ইমাম বুখারী মুসলিম উম্মাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ। সহীহ বুখারী ছাড়াও হাদীস বর্ণনাকারী রাবী ও মুহাদ্দিসগণের গ্রহণযোগ্যতা, দুর্বলতা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। রাবীগণের সমালোচনায় ইমাম বুখারীর দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়:

প্রথমত: পরিভাষার বিনম্রতা। অন্যান্য মুহাদ্দিস যাকে ‘‘মিথ্যাবাদী’’ বা ‘‘জালিয়াত’’ বলেছেন, তিনি তার বিষয়ে বলেছেন: ‘‘তার বিষয়ে আপত্তি আছে’’, ‘‘আপত্তিকর’’, ‘‘পরিত্যক্ত’’, তাকে মুহাদ্দিসগণ পরিত্যাগ করেছেন’’, ‘‘তার বিষয়ে তারা নীরব থেকেছেন’’, ‘‘মুখ ফিরিয়েছেন’’ ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত: সমালোচনার বিনম্রতা। অন্যান্য মুহাদ্দিস যাদেরকে অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করেছেন, তাদের অনেককে তিনি অল্প দুর্বল বা কোনো রকম গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।

এ বিনম্র সমালোচক ইমাম আবূ হানীফার ক্ষেত্রে বিনম্রতা রাখতে পারেন নি। তিনি ‘আত-তারীখ আস-সগীর’ গ্রন্থে তাঁর উস্তাদ নুআইম ইবন হাম্মাদ (২২৮ হি)-এর সূত্রে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।[1] একটি বক্তব্য দেখুন:


حدثنا نعيم بن حماد قال حدثنا الفزاري قال كنت عند سفيان فنعى النعمان فقال الحمد لله كان ينقض الاسلام عروة عروة ما ولد في الاسلام أشأم منه


‘‘আমাদেরকে নুআইম ইবন হাম্মাদ বলেন, আমাদেরকে আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবন মুহাম্মাদ ফাযারী বলেন, আমি সুফইয়ান সাওরীর কাছে ছিলাম, এমতাবস্থায় নু’মানের মৃত্যু সংবাদ আসল। তখন তিনি বলেন: আল-হামদু লিল্লাহ, সে ইসলামকে ধ্বংস করত, একটি একটি করে রশি ছিন্ন করে!! ইসলামের মধ্যে তার চেয়ে অধিক অশুভ আর কেউ জন্মগ্রহণ করে নি।’’[2]

এ কাহিনীর বর্ণনাকারী নুআইম ইবন হাম্মাদ সুন্নাতের পক্ষে এবং বিদআতের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। হানাফীদেরকে তিনি বিদআতী, মুতাযিলী, মুরজিয়া, এবং হাদীস বিরোধী কিয়াস পন্থী ‘আহলুর রায়’ বলে প্রচার করতেন। এজন্য জাল-জালিয়াতিও তিনি পরোয়া করতেন না। কিয়াস-পন্থীদেরকে বা হানাফীদেরকে ৭৩ ফিরকার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফিরকা বলে উল্লেখ করে একটি হাদীস তিনি বর্ণনা করেন। মুহাদ্দিসগণ একমত যে হাদীসটি ভিত্তিহীন জাল। তবে অনেক মুহাদ্দিস তার প্রতি শ্রদ্ধাবশত বলেছেন যে, তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুল করেছেন। অন্য অনেকে বলেছেন এটি তার জালিয়াতি। তাঁর সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেন:


كان يضع الحديث في تقوية السنة وحكايات في ثلب أبي حنيفة كلها كذب


‘‘তিনি সুন্নাতকে শক্তিশালী করার জন্য জাল হাদীস তৈরি করতেন এবং আবূ হানীফার নিন্দায় কাহিনী তৈরি করতেন যা সবই মিথ্যা।’’[3]

নুআইমের এ বর্ণনা সত্য হলে ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতা প্রমাণ হতো না, সুফিয়ান সাওরীর দুর্বলতা প্রমান হতো। আমাদেরকে বলতে হতো, সুফইয়ান সাওরী এ কথা বলে পাপে লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ কোনো মানুষকে ‘অশুভ’ বলা হাদীসে নিষিদ্ধ হারাম। কোনো ব্যক্তির কর্মের বা মতের দলিলভিত্তিক সমালোচনা করা যায়। কিন্তু কোনো আলিম তো দূরের কথা একজন সাধারণ পাপী মুসলিমকেও ‘‘অশুভ’’ বলা বা এভাবে ঢালাও অভিযোগ করা বৈধ নয়। তবে বাহ্যত এ কাহিনী সত্য নয় বরং নুআইম ইবন হাম্মাদের বানানো। আল্লাহ আমাদেরকে ও পূর্ববর্তী আলিমদেরকে ক্ষমা করুন এবং দীনের জন্য তাঁদের খিদমাত কবুল করুন।

‘‘আত-তারীখ আল-কাবীর’’ গ্রন্থে ইমাম বুখারী বলেন:


نعمان بن ثابت أبو حنيفة ... كان مرجئا سكتوا عنه وعن رأيه وعن حديثه


‘‘নুমান ইবন সাবিত আবূ হানীফা কূফী ... তিনি মুরজিয়া ছিলেন; তাঁরা (মুহাদ্দিসগণ) তাঁর থেকে, তাঁর মত থেকে এবং তাঁর হাদীস থেকে নীরব হয়েছেন।’’[4]

অন্যত্র কাযি আবূ ইউসূফের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:


يعقوب بن ابراهيم أبو يوسف القاضي ... وصاحبه أبو حنيفة تركوه


‘‘ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম কাযী আবূ ইউসূফ ... তাঁর সাথী আবূ হানীফাকে মুহাদ্দিসগণ পরিত্যাগ করেছেন।’’[5]

এখানে কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনাযোগ্য:

(১) ইমাম বুখারী বলেছেন যে, মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফা থেকে নীরব হয়েছেন। ইমাম বুখারীর পরিভাষায় ‘‘নীরব থাকা’’-র অর্থ মুহাদ্দিসগণ ইমাম আবূ হানীফাকে পরিত্যাগ করেছেন এবং তাঁরা তাঁকে মিথ্যাবাদী পর্যায়ের বলে গণ্য করেছেন।

(২) ইমাম বুখারীর বক্তব্য থেকে বুঝা যায় ইমাম আবূ হানীফার একমাত্র অপরাধ যে, তিনি মুরজিয়া ছিলেন, যে কারণে মুহাদ্দিসগণ তাঁকে, তাঁর ফিকহী মত এবং ‘তাঁর বর্ণিত হাদীস’ পরিত্যাগ করেছেন। মুরজিয়া হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অপরাধের কথা তিনি উল্লেখ করেন নি।

আবূ হানীফা মুরজিয়া ছিলেন কিনা তা আমরা পরে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তবে মুরজিয়া হওয়ার কারণে কোনো মুহাদ্দিস দুর্বল বা পরিত্যাক্ত হন না। নিরীক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিগত সততা ও বর্ণিত হাদীসের নির্ভুলতা প্রমাণ করা মুহাদ্দিসের গ্রণযোগ্যতার মূল ভিত্তি। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে অনেক মুরজিয়া, কাদারিয়া, খারিজী ও অন্যান্য ফিরকার মুহাদ্দিসের হাদীস সংকলন করেছেন। এখানে ইমাম আবূ হানীফার পূর্বের ও সমসাময়িক অল্প কয়েকজন প্রসিদ্ধ মুরজিয়া মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করছি যাদের বর্ণিত হাদীস বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন।

(১) বসরার তাবিয়ী তাল্ক ইবন হাবীব আল-আনাযী (৯০ হি)।

(২) কুফার তাবি-তাবিয়ী যার্র ইবন আব্দুল্লাহ মুরহাবী (১০০ হি)

(৩) কুফার তাবি-তাবিয়ী কাইস ইবন মুসলিম আল-জাদালী (১২০হি)

(৪) কূফার তাবিয়ী আমর ইবন মুর্রা জামালী (১২৮ হি)

(৪) কুফার তাবিয়ী খালিদ ইবন সালামাহ ইবনুল আস আল-ফা’ফা’ (১৩২ হি)।

(৫) হার্রানের তাবি-তাবিয়ী সালিম ইবন আজলান আল-আফতাস (১৩২ হি)

(৬) কুফার তাবিয়ী আসিম ইবন কুলাইব আল-জারমী (১৩৫ হি)।

(৭) কুফার তাবি-তাবিয়ী উমার ইবন যুর্র ইবন আব্দুল্লাহ (১৫৩ হি)

এদের সকলেই মুরজিয়া ছিলেন, কেউ মুরজিয়াদের নেতা ছিলেন, কাউকে সমকালীন কোনো কোনো মুহাদ্দিস পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এদের বর্ণিত হাদীস এবং এদের মত শতশত মুরজিয়া মুহাদ্দিসের হাদীস সহীহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।[6]

ইমাম মিয্যীর তাহযীবুল কামাল, হাফিয ইবন হাজারের তাহযীবুত তাহযীব ও অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে আমরা এরূপ শতশত রাবীর পরিচয় পাই, যারা মুরজিয়া হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একারণে তাকে ‘‘পরিত্যাগ’’ করলেও সামগ্রিক বিচারে বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁদেরকে নির্ভরযোগ্য বলে নিশ্চিত করেছেন। ইমাম বুখারীর অনেক উসতাদও মুরজিয়া বলে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন।

(৩) ইমাম বুখারীর বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, সকল মুহাদ্দিস আবূ হানীফাকে পরিত্যাগ করেছেন। তিনি বলতে পারতেন, অমুক অমুক মুহাদ্দিস তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, তাহলে ইলমের আমানত আদায় হতো। অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই তিনি এরূপ বলেছেন। কিন্তু আবূ হানীফার ক্ষেত্রে তা না বলে তিনি বললেন: মুহাদ্দিসগণ তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, শুবা, ইবনুল মুবারাক, ইসরাঈল ইবন ইউনূস, ইয়াহইয়া ইবন আদাম, হাসান ইবন সালিহ, ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান, ইবন মাহদী, আবূ দাউদ খুরাইবী, প্রমুখ জারহ-তাদীলের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম সুস্পষ্টভাবে তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন। এমনকি ইমাম বুখারীর উসতাদ ইবন মায়ীন ও ইবনুল মাদীনী তাকে বিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ইবন মায়ীন বলেছেন যে, তিনি একজনকেও আবূ হানীফাকে দুর্বল বলতে শুনেন নি। তাহলে কে তাঁকে পরিত্যাগ করল? আমরা দেখেছি যে, তৃতীয় শতকের কেউ কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন। কিন্তু ইমাম বুখারীর পূর্বে কেউই তাকে পরিত্যক্ত বলেন নি।

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, তৃতীয় শতকের ‘আবূ হানীফা বিরোধী’ যে প্রচারণার কথা আমরা বলেছি, যে প্রচারণার অন্যতম এক দিকপাল ছিলেন ইমাম বুখারীর এক উস্তাদ নুআইম ইবন হাম্মাদ, সে প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে ইমাম আবূ হানীফার প্রতি ইমাম বুখারী অত্যন্ত বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। তাঁর মন্তব্যে তাঁর মনের এ গভীর বিরক্তি ও আপত্তিই প্রকাশ পেয়েছে। নিরপেক্ষ জ্ঞানবৃত্তিক বিচারে ইমাম বুখারীর কথা মোটেও ঠিক নয়। আবূ হানীফাকে কখনোই সকল মুহাদ্দিস পরিত্যাগ করেন নি। এমনকি একজন প্রসিদ্ধ সমালোচক মুহাদ্দিসও তাঁকে ‘‘পরিত্যক্ত’’ বলেন নি। মহান আল্লাহ তাঁর দীন ও তাঁর নবীর (ﷺ) সুন্নাতের খিদমাতে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম বুখারীর অবদান কবুল করুন, তাঁদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করুন, তাঁদের উভয়কে উম্মাতের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।
প্রসিদ্ধ সৌদি আলিম আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ জারহ-তাদীলের বিভিন্ন পরিভাষা আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম বুখারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন:


ولا يعاب استعمالها منهم فيمن قالوها فيه، إلا قول البخاري في (أبي حنيفة النعمان بن ثابت الإمام الفقيه): "سكتوا عنه وعن رأيه وعن حديثه". فهذه حكاية من البخاري عن أهل الحديث، ومن تأمَّل فاحصاً منصفاً متبرئاً من العصبية وجد هذا القول خطأ، وذلك- بإيجاز- من جهتين :


الأولى: دلالة الاستقراء على أن أهل الحديث قد اختلفت عباراتهم في أبي حنيفة، بين معدِّل وجارح، علماً أن الجرح عند من جرح لم يفسر بسبب حديثه، فكيف سكتوا عنه، وفيهم من أثنى عليه وأطراه ورفع من شأنه .


والثانية: أن عبارات الجارحين وقع فيها من المبالغة والتَّهويل، وذلك بسبب الشِّقاق الذي كان بين أهل الرأي وأهل الحديث في تلك الفترة، علماً بأن كثيراً من تلك الأقاويل لا تصح نسبتها إلى من عزيت إليه.


وأبو حنيفة شغله الفقه عن الحديث، ولعله لو اشتغل به اشتغال كثير من أهل زمانه، لم يمكن مما مُكِّن فيه من الفقه، ومع ذلك فإنه قد روى وحدث، نعم، ليس بالكثير على التحقيق؛ للعلة التي ذكرنا، وهي انصرافه إلى فقه النصوص دون روايتها... وفي طبقات الشافعية للتاج السبكي 1/188 : ... الصواب أن من ثبتت إمامته وعدالته ، وكثر مادحوه وندر جارحه ، وكانت هناك قرينة دالّة على سبب جرحه من تعصب مذهبي أو غيره لم يلتفت إلى جرحه ...


‘‘(سكتوا عنه) ‘তাঁরা তার থেকে নীরব হয়েছেন’-এ পরিভাষাটি তারা যাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন তাদের ব্যবহার আপত্তিকর নয়। শুধু আপত্তিকর ইমাম ফকীহ আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিত-এর বিষয়ে বুখারীর বক্তব্য: ‘তাঁরা তাঁর থেকে, .... নীরব হয়েছেন।’ এখানে বুখারী মুহাদ্দিসগণের মত উদ্ধৃত করেছেন। যদি কেউ বিদ্বেষ বা পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ইনসাফের সাথে বিবেচনা করেন তবে তিনি নিশ্চিত হবেন যে, এ কথাটি ভুল। সংক্ষেপে দু কারণে এ কথাটি ভুল:

প্রথমত: মুহাদ্দিসগণের মত একত্র করলে দেখা যায় যে, তাঁর বিষয়ে তাঁদের মতভেদ রয়েছে। কেউ তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন, কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন। তবে লক্ষণীয় যে, যারা তাঁকে দুর্বল বলেছেন তাঁরা তাঁর হাদীসের ত্রুটি ব্যাখ্যা করে দুর্বল বলেন নি; তাহলে তাঁরা নীরব থাকলেন কিভাবে? অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর প্রশংসা করেছেন, গুণকীর্তন করেছেন এবং তাঁর উচ্চ মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত: যারা তাঁকে দুর্বল বলেছেন তাঁদের বক্তব্যে অনেক বাড়াবাড়ি ও অতিকথন রয়েছে। এর কারণ ‘আহলুর রায়’ বা ফকীহগণ ও ‘আহলুল হাদীস’ বা মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সে যুগে বিদ্যমান মতভেদ ও বিভক্তি। সর্বোপরি এ সকল বক্তব্যের অধিকাংশই সনদ বিচারে সহীহ নয়।

আবূ হানীফা হাদীসের চেয়ে ফিকহ বিষয়ে বেশি মাশগুল থেকেছেন। তিনি যদি তাঁর যুগের মুহাদ্দিসদের মত হাদীস নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তাহলে তিনি ফিকহে যে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন তা হয়ত অর্জন করতে পারতেন না। তা সত্ত্বেও তিনি হাদীস সংগ্রহ ও বর্ণনা করেছেন। তবে গবেষণা প্রমাণ করে যে, তাঁর বর্ণিত হাদীস বেশি নয়। এর কারণ আমরা যা বলেছি; অর্থাৎ তিনি হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষাদানের পরিবর্তে হাদীসের ফিকহী নির্দেশনা অনুধাবন ও শিক্ষাদানে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করেন।..... (সুপ্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস) তাজুদ্দীন সুবকী (৭২৭-৭৭১ হি) তাঁর ‘তাবাকাতুশ শাফিয়ীয়্যাহ ১/১৮৮ পৃষ্ঠায় বলেন: ‘‘... সঠিক কথা হলো, যার ইমামত ও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে, যার প্রশংসাকারীর সংখ্যা বেশি, কিন্তু খুব কম ব্যক্তিই তাঁকে দুর্বল বলেছেন, পারিপার্শিক অবস্থা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যারা তাঁকে দুর্বল বলেছেন তাঁরা মাযহাবী বা মতভেদগত পক্ষপাতের কারণে দুর্বল বলেছেন, তাহলে তাঁর দুর্বলতার বিষয়ে কথিত এ সকল বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না।....’’[7]

[1] বুখারী, আত-তারীখ আল-কাবীর ৮/৮১ : সম্পাদকের টীকা।

[2] বুখারী, আত-তারীখ আস-সগীর ২/৯৩; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৪/৪১৮।

[3] ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪১২।

[4] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৮/৮১।

[5] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৮/৩৯৭।

[6] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ১৪/৪৫২; ইবন হাজার, তাকরীব, পৃ. ১১৮, ১৮৮, ২০৩, ২২৭, ২৮৩, ২৮৬, ৪১২, ৪৫৮...।

[7] আলী ইবন নায়িফ শাহ্হূদ, আল-খুলাসাহ ফী ইলমিল জারহি ওয়াত তা’দীল ২/২২-২৩।