আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
১০. ৩. পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বৈধতায় বিশ্বাস করতেন। আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল উদ্ধৃত করেছেন:


ابن المبارك يقول سمعت الأوزاعي يقول احتملنا عن أبي حنيفة كذا ... واحتملنا عنه كذا ... واحتملنا عنه كذا ... العيوب حتى جاء السيف على أمة محمد ﷺ فلما جاء السيف على أمة محمد ﷺ لم نقدر أن نحتمله


‘‘ইবনুল মুবারাক বলেন, আমি আওযায়ীকে বলতে শুনেছি: আমরা আবূ হানীফার অমুক অন্যায়-ত্রুটি সহ্য করলাম,... অমুক ত্রুটি সহ্য করলাম, ... অমুক অন্যায়-ত্রুটি সহ্য করলাম... কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর অস্ত্র নিয়ে আসলেন!! যখন তিনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে অস্ত্র নিয়ে আসলেন তখন আর আমরা তাকে সহ্য করতে পারলাম না।’’[1]

এরূপ অনেক কথা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, ইবন হিববান, ইবন আদী, খতীব বাগদাদী প্রমুখের গ্রন্থে পাঠক দেখবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তাঁর বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগ যে, তিনি পাপী রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদে কখনোই অংশগ্রহণ করেন নি। অর্থাৎ কেউ তাঁকে বিদ্রোহের পক্ষে বলে অভিযুক্ত করছেন। পক্ষান্তরে কেউ তাঁকে বিদ্রোহের বিপক্ষে বলে অভিযুক্ত করছেন। অর্থাৎ যে যেভাবে পারছেন তাঁকে অভিযুক্ত করছেন।[2] এ বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য আমরা ফিকহুল আকবারের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় দেখব। আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা নিজে ও তাঁর আকীদা ব্যাখ্যা করে ইমাম তাহাবী খুব সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন যে, পাপী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ইসলামী আকীদার পরিপন্থী ও অবৈধ। এখানে আমরা শুধু বুঝার চেষ্টা করি যে, তিনি যদি এরূপ বৈধতা দিয়েও থাকেন তাহলে তা কত বড় অপরাধ ছিল? সত্যই কি তিনিই প্রথম উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে অস্ত্র নিয়ে আগমন করেছিলেন?

প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ‘‘রাষ্ট্র’’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও মূল আরবের বাসিন্দারা কখনো ‘‘রাষ্ট্র’’ ব্যবস্থার অধীনে বাস করেন নি। তারা রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বুঝতেন না, বুঝতেন গোত্রীয় আনুগত্য। গোত্রের বাইরে কারো আনুগত্যকে তারা অবমাননাকর মনে করতেন। এছাড়া ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ তাদেরকে তাদের মতের বাইরে সকল সিদ্ধান্ত অমান্য করতে প্রেরণা দিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিচ্ছিন্ন জাতিকে প্রথমবারের মত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনেন। তিনি তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও আনুগত্যের মধ্যে অবস্থান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শাসক-প্রশাসক পাপী হলেও তার পাপের প্রতি ঘৃণা, আপত্তি ও প্রতিবাদসহ তার আনুগত্য ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বর্জন করা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা করা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বাইরে বা রাষ্ট্রহীনভাবে বাস করাকে তিনি জাহিলী জীবন ও এ প্রকারের মৃত্যুকে জাহিলী মৃত্যু বলেছেন। পরবর্তীতে আমরা এগুলো বিস্তারিত দেখব, ইনশা আল্লাহ।

রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বিষয়ক কুরআন-হাদীসের এ সকল নির্দেশনা অনুধাবন ও প্রয়োগ ঘটে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে বসবাসের সাথে সাথে। এ জাতীয় একটি বিষয় ‘‘পাপী রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য’’ বনাম ‘‘পাপের প্রতিবাদ’’। কুরআন ও হাদীসে বারবার ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখতে ও বিদ্রোহ বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উভয় নির্দেশের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রথম যুগের সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ও কর্মপার্থক্য ঘটে। অধিকাংশ সাহাবী-তাবিয়ী সর্বাবস্থায় রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখা ফরয এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ হারাম বলে গণ্য করেছেন।

পক্ষান্তরে তাঁদের যুগে কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে কেউ কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন। ইয়াযিদের সময়ে ইমাম হুসাইনের (রা) ঘটনায়, মদীনার বিদ্রোহে ও ইবন যুবাইরের ঘটনায় কয়েকজন সাহাবী ও অনেক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী অস্ত্রধারণ করেন। আব্দুল মালিকের (খিলাফাত ৬৫-৮৬) বিরুদ্ধে আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ ইবনুল আস‘আসের (৮৫ হি) বিদ্রোহে, উমাইয়া খলীফাদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইনের পৌত্র যাইদ ইবন আলীর (১২২ হি) যুদ্ধে এবং আববাসী খলীফা মানসূরের বিরুদ্ধে আলী (রা)-এর বংশধর, ‘নাফস যাকিয়্যাহ’ নামে পরিচিত প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ (৯২-১৪৭ হি)-এর বিদ্রোহে অনেক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী ইমাম ও আলিম অংশগ্রহণ করেন বা বৈধতা প্রদান করেন। কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে তাঁরা তা করেছেন তা আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তবে লক্ষণীয় যে, মূলধারার সাহাবী-তাবিয়ীগণ এরূপ বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছেন, তবে অংশগ্রহণকারী বা বৈধতাদানকারীদেরকে বিভ্রান্ত বলেন নি। বরং তাঁরা ইজতিহাদে ভুল করেছেন বলে গণ্য করেছেন এবং তাঁদের জন্য দুআ করেছেন।

এভাবে হিজরী প্রথম শতাব্দী ও দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত কোনো কোনো তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ পাপী সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদে অস্ত্রধারণ বৈধ বলে গণ্য করেছেন। একে তারা ‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের’’ অংশ বলে গণ্য করতেন। দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ একমত হয়ে যান যে, জালিম বা পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বৈধ নয়। খারিজী ও মুতাযিলীদের আকীদার মূলনীতি ছিল ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ ও জিহাদের নামে পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ। পক্ষান্তরে মূলধারার মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার মধ্যে পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অবৈধতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

তাহলে নুমান ইবন সাবিত প্রথম উম্মাতের মধ্যে অস্ত্র নিয়ে আগমন করেন নি। তাঁর পূর্বে ও সমসাময়িক অনেক সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস পাপী সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের বৈধতায় বিশ্বাস করেছেন। এ বিষয়ক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আগে, তাঁর যুগের কাউকে এ মত পোষণের জন্য বিভ্রান্ত বলা যায় না। ইবন হাজার আসকালানী বলেন:


وقولهم كان يرى السيف يعني كان يرى الخروج بالسيف على أئمة الجور وهذا مذهب للسلف قديم لكن استقر الامر على ترك ذلك... بمثل هذا الرأى لا يقدح في رجل قد ثبتت عدالته واشتهر بالحفظ والاتقان والورع التام.


‘‘অস্ত্রে বিশ্বাস করতেন, অর্থাৎ জালিম-ফাসিক শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ বৈধ বলে বিশ্বাস করতেন। প্রাচীন সালফ সালিহীনের মধ্যে এ মতটি বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে এটি বর্জন করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।...যার সততা প্রমাণিত এবং হাদীস মুখস্থ রাখা ও পরিপূর্ণ তাকওয়ার বিষয়ে যিনি প্রসিদ্ধ এ মতটি তাঁর ত্রুটি প্রমাণ করে না।’’[3]

[1] আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, আস-সুন্নাহ ১/১৮৫।

[2] শাইখ আবূ যুহরা, আবূ হানীফা: হায়াতুহু ওয়া আসরুহু, পৃ. ১৮০-১৮১।

[3] ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/২৫০।