আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

হাদীস বিষয়ক অভিযোগ আলোচনায় আমরা দেখব যে, ইমাম বুখারী (রাহ) ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-কে ‘‘মুরজিয়া’’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। অন্যত্র তিনি বলেন:


قال لي ضرار بن صرد حدثنا سليم سمع سفيان: قال لي حماد بن أبي سليمان أبلغ أبا حنيفة المشرك أني برئ منه قال: وكان يقول: القرآن مخلوق


‘‘দিরার ইবন সুরাদ আমাকে বলেন, আমাদেরকে সালীম বলেছেন, তিনি সুফইয়ান সাওরীকে বলতে শুনেছেন, আমাকে হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান বলেন, আবূ হানীফা নামক মুশরিককে আমার পক্ষ থেকে জানাও যে, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন: আবূ হানীফা বলে: কুরআন সৃষ্ট।’’[1]

আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফা ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ গ্রন্থে কুরআনকে সৃষ্ট বলার বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখেছেন। কুরআনকে সৃষ্ট বলার বিরুদ্ধে যিনি কলম ধরেন তাঁর নামে ‘‘কুরআন সৃষ্ট’’ বলার অভিযোগ, তাও তাঁর প্রিয়তম ও নিকটতম উস্তাদের নামে! এ কাহিনীটির একমাত্র বর্ণনাকারী আবূ নুআইম দিরার ইবন সুরাদ। তিনি কুফার একজন বড় আবিদ-বুজুর্গ ছিলেন; কিন্তু তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন। হক্কের পক্ষে বুজুর্গদের মিথ্যাচার সম্পর্কে ‘‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি।[2] ইবন মায়ীন বলেন: কূফায় দুজন মহা-মিথ্যাবাদী আছে: একজন আবূ নুআইম নাখয়ী, অন্যজন আবূ নুআইম দিরার ইবন সুরাদ। ইমাম নাসায়ী বলেন: (متروك الحديث) সে পরিত্যক্ত হাদীস বর্ণনাকারী। নাসায়ীর পরিভাষায় পরিত্যক্ত অর্থ মিথ্যাবাদী। অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস একই কথা বলেছেন। ইমাম বুখারী নিজেও তাকে মাতরূক অর্থাৎ পরিত্যক্ত বা মিথ্যাবাদী বলেছেন। কেউ কেউ তাকে দুর্বল বলেছেন।[3]

সুস্পষ্টতই এটি এ ব্যক্তির বানানো একটি জাল গল্প। তারপরও ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এ গল্পটি ও এরূপ অনেক গল্প উদ্ধৃত করেছেন। তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে ইমাম আযমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা আমরা এ থেকে বুঝতে পারছি। ইমাম বুখারী তাঁর ‘আত-তারীখ আস-সগীর’ গ্রন্থে বলেন:


سمعت إسماعيل بن عرعرة يقول قال أبو حنيفة جاءت امرأة جهم إلينا ههنا فأدبت نساءنا


‘‘আমি ইসমাঈল ইবন আরআরাকে বলতে শুনেছি, আবূ হানীফা বলেন: জাহম (ইবন সাফওয়ান)-এর স্ত্রী আমাদের এখানে এসে আমাদের মহিলাদেরকে শিক্ষা দান করে।’’[4]

আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, জাহম ইবন সাফওয়ান (১২৮ হি) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন কুফরী-বিদআতী আকীদা প্রচলন করেন। এ কাহিনীতে পরোক্ষভাবে ইমাম আবূ হানীফাকে জাহমের অনুসারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তাঁকে জাহমী বলে অভিযুক্ত করে আরো অনেক বর্ণনা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল, ইবন হিববান, ইবন আদী, খতীব বাগদাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। সনদগতভাবে এ সকল বর্ণনা সবই জাল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদে বর্ণিত। অর্থগতভাবে অভিযোগগুলো আমরা একটু পরে পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এ বর্ণনার কথক ইসমাঈল ইবন আরআরা একেবারেই অপরিচিত ব্যক্তি। জারহ-তাদীল বিষয়ক বা অন্য কোনো জীবনী বা ইতিহাস গ্রন্থে তার বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে কিছু পাওয়া যায় না। ইমাম বুখারী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি তাঁর থেকে কোনো কিছু বর্ণনা করেছেন, অথবা তিনি কোনো আলিমের কাছ থেকে কিছু শিখেছেন বলেও কোথাও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাহ্যত তিনি ইমাম আবূ হানীফা থেকে সরাসরি কোনো কথা শুনেন নি। আদৌ তিনি তাঁকে দেখেছেন বলে প্রমাণিত নয়। সমাজে প্রচলিত একটি কথা তিনি ইমাম বুখারীকে শুনিয়েছেন মাত্র।

[1] বুখারী, আত-তারীখ আল-কাবীর ৪/১২৭।

[2] ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি, পৃ. ১৫২-১৬১।

[3] ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৪/৪০০।

[4] বুখারী, আত-তারীখ আস-সগীর ২/৪১।