আর-রাহীকুল মাখতূম দ্বিতীয় পর্যায় (الْمَرْحَلَةُ الثَّانِيَةُ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
২. মিশরের সম্রাট মুক্বাওক্বিসের নামে পত্র (الْكِتَابُ إِلٰى الْمُقَوْقِسِ مُلْكِ مِصْر):

নাবী কারীম (ﷺ) মিশর ও ইসকান্দারিয়ার সম্রাট জুরাইজ বিন মাত্তার[1] নামে একটি মূল্যবান পত্র প্রেরণ করেন। তার উপাধি ছিল মুক্বাওক্বিস। পত্রখানার বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরুপ :

‏(‏بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ مِنْ مُّحَمَّدٍ عَبْدِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ إِلَى الْمُقَوْقِسِ عَظِيْمِ الْقِبْطِ، سَلَامٌ عَلٰى مَنْ اِتَّبَعَ الْهُدٰى، أَمَّا بَعْدُ، فَإِنِّيْ أَدْعُوْكَ بِدِعَايَةِ الْإِسْلَامِ، أَسْلِمْ تَسْلَمْ، وَأَسْلِمْ يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرَّتَيْنِ، فَإِنْ تَوَلَّيْتَ فَإِنَّ عَلَيْكَ إِثْمَ أَهْلِ الْقِبْــطِ،

(‏يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلٰى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوْا اشْهَدُوْا بِأَنَّا مُسْلِمُوْنَ‏)

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম

আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ হতে কিবত প্রধান মুক্বাওক্বিসের প্রতি-

সালাম তার উপর যে হিদায়াত অনুসরণ করবে। অতঃপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। ইসলাম গ্রহণ করুন, আল্লাহ আপনাদেরকে দ্বিগুণ সওয়াব প্রদান করবেন। কিন্তু আপনি যদি মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে কিবতীগণের পাপ বর্তিবে আপনারই উপর। হে কিবতীগণ এমন একটি কথার প্রতি তোমরা এগিয়ে এসো যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান তা এই যে আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করব না এবং কাউকেও তাঁর অংশীদার করব না। অধিকন্তু, আমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও রব বা প্রভূ বানাবো না। অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও যে, ‘সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম।[2]

এ পত্রখানা পৌঁছানোর জন্য হাতিব বিন আবী বালতাআ’হ-কে মনোনীত করা হয়। তিনি মুক্বাওক্বিসের দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘এ পৃথিবীর উপর তোমাদের পূর্বে এ ব্যক্তি গত হয়ে গিয়েছেন যিনি নিজেই নিজেকে বড় প্রভূ মনে করতেন। আল্লাহ তাঁকে শেষ ও প্রথমের জন্য মানুষের শিক্ষণীয় করেছেন। প্রথমে তো তাঁর দ্বারাই মানুষ হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। অতঃপর তাঁকেই প্রতিশোধের লক্ষ্য স্থলে পরিণত করেছেন। অতএব, অন্যদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং এমন যেন না হয় যে, অন্যেরা আপনার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।’

মুক্বাওক্বিস বলল, ‘আমাদের একটি ধর্ম আছে এবং যতক্ষণ এর চাইতে উত্তম কিছু না পাব ততক্ষণ আমরা তা পরিত্যাগ করতে পারব না।’ হাতেব বিন আবি বাতলাত’ বলেন ‘আমরা আপনাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি যে ধর্মকে আল্লাহ তা‘আলা অন্যান্য সকল ধর্মের পরিপূরক হিসেবে তৈরি করেছেন। দেখুন, এ নাবী (ﷺ) মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। কুরাইশরা এ ব্যাপারে সব চাইতে শক্তভাবে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং ইহুদীরা সব চাইতে বেশী শত্রুতা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টানগণ সব চাইতে নিকটে থেকেছে। আমার জীবনের শপথ! মুসা (আঃ) যে ভাবে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে শুভ সংবাদ দিয়েছেলেন, আমরা কুরআন মজীদের প্রতি আপনাদের ঐ ভাবে দাওয়াত দিতেছি, যেমনটি আপনারা তওরাতের অনুসারীদের ইঞ্জিলের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন। যখন যে সম্প্রদায়ের মাঝে যে নাবীর আবির্ভাব হয় তখন সেই সম্প্রদায়ের লোকজনদের সেই নাবীর উম্মত হিসেবে গণ্য করা হয়। সে নাবীর আনুগত্য করা তখন সে সম্প্রদায়ের লোকজনদের অবশ্য করণীয় কর্তব্য হয়ে পড়ে। আপনারা এ নাবীর অনুসরণ করেছেন। আমরা কিন্তু আপনাদেরকে মসীহ-র দ্বীন হতে বিরত থাকতে বলছিনা, বরং তারই দ্বীনের পরিপূরক ব্যবস্থার অনুসরণের জন্য দাওয়াত দিচ্ছি।

মুক্বাওক্বিস বললেন, ‘এ নাবীর ব্যাপারে আমি চিন্তাভাবনা করলাম। এতে আমি এটুকু পেলাম যে, তিনি কোন অপছন্দীয় কথা কিংবা কাজের নির্দেশ প্রদান করেন নি এবং কোন পছন্দনীয় কথা কিংবা কাজ হতে নিষেধও করেন নি। তাকে ভ্রষ্ট যাদুকর কিংবা মিথ্যুক ভবিষ্যদ্বক্তা বলেও মনে হয় না, বরং আমি তাঁর নিকট নবুওয়াতের এ সকল নিদর্শন পাচ্ছি যে তিনি গোপনকে প্রকাশ করেন এবং পরামর্শের সংবাদ দিতেছেন। আমি এ ব্যাপারে অধিক চিন্তাভাবনা করব। মুক্বাওক্বিস নাবী কারীম (ﷺ)-এর পত্রখানা হাতে নিয়ে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে হাতীর দাঁতের তৈরি একটি বাক্সে রাখলেন এবং তাতে সীলমোহর লাগিয়ে তা যত্ন সহকারে রেখে দেয়ার জন্য একজন দাসীর হাতে দিলেন। অতঃপর আরবী ভাষা লিখতে সক্ষম একজন কেরানী (লেখক) কে ডাকিয়ে নিয়ে রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে নিম্নবর্ণিত পত্রখানা লিখলেন।

(‏بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ ‏.‏ لِمُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ مِنْ الْمُقَوْقِسِ عَظِيْمِ الْقِبْطِ، سَلَامٌ عَلَيْكَ، أَمَّا بَعْدُ‏:‏

فَقَدْ قَرَأْتُ كِتَابَكَ، وَفَهِمْتُ مَا ذَكَرْتَ فِيْهِ، وَمَا تَدْعُوْ إِلَيْهِ، وَقَدْ عَلِمْتُ أَنَّ نَبِيًّا بَقِيٌّ، وَكُنْتُ أَظُنُّ أَنَّهُ يَخْرِجُ بِالشَّامِ، وَقَدْ أَكْرَمْتُ رَسُوْلَكَ، وَبَعَثْتُ إِلَيْكَ بِجَارِيْتِيْنَ، لَهُمَا مَكَانٌ فِيْ الْقِبْطِ عَظِيْمٌ، وَبِكِسْوَةٍ، وَأَهْدَيْتُ بَغْلَةً لِتَرْكَبِهَا، وَالسَّلَامُ عَلَيْكَ‏)‏‏.‏

বিসমিললাহির রহমানির রাহীম, মুহাম্মাদ (ﷺ) বিন আব্দুল্লাহর প্রতি মহান মুক্বাওক্বিস কিবতের পক্ষ হতে :

‘আপনি আমার সালাম গ্রহণ করুন। অতঃপর, আপনার পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। পত্রে উল্লেখিত আপনার কথাবার্তা ও দাওয়াত আমি উপলব্ধি করেছি। এখন যে একজন নাবীর আবির্ভাব ঘটবে সে বিষয়ে আমার ধারণা রয়েছে। আমরা ধারণা ছিল যে, শাম রাজ্য থেকে আবির্ভূত হবেন।

আমি আপনার প্রেরিত সংবাদ বাহকের যথাযোগ্য সম্মান ও ইজ্জত করলাম। আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আপনার খিদমতে দুটি দাসী প্রেরণ করলাম। কিবতীদের মাঝে যারা বড় মর্যাদার অধিকারিণী। অধিকন্তু, আপনার পরিধানের জন্য কিছু পরিচ্ছদ এবং বাহন হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি খচ্চর পাঠালাম সামান্য উপঢৌকন হিসেবে। অতঃপর আপনার খিদমতে পুনরায় সালাম পেশ করলাম।’

মুক্বাওক্বিস এর অতিরিক্ত আর কিছুই লিখেন নি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেও তিন কিন্তু ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করেন নি। তাঁর প্রেরিত দাসী দুটির নাম ছিল মারিয়া এবং শিরীন। খচ্চরের নাম ছিল দুলদুল। খচ্চরটি মু’আবিয়ার সময় পর্যন্ত জীবিত ছিল।[3]

নাবী কারীম (ﷺ) মারিয়াকে বিবাহ করেন। তাঁর গর্ভে নাবী পুত্র ইবরাহীম জন্মলাভ করেন। শিরীনকে হাসসান বিন সাবেত আনসারীর হাতে দেয়া হয়।

[1] এ নাম আল্লামা মানসুরপুরী রহমাতুল্লিল আলামীন গ্রন্থে ১ম খন্ড ১৭৮ পৃ: উল্লেখ করেছেন। ড. হামীদুল্লাহ তাঁর নাম বিণয়ামিন বলেছেন, দ্র: ‘রাসূলে আকরাম (সাঃ) কী সিয়াসী জিন্দেগী পৃ: ১৪১।

[2] ইবনুল কাইয়্যেম রচিত যাদুল মা‘আদ ৩/৬১ পৃঃ। অল্পদিন পূর্বে এ পত্র হস্তগত হয়েছে। ডক্টর হামিদুল্লাহ সাহেব যে ফটোকপি ছেপেছেন তাতে এবং যাদুল মাআদে লিখিত পত্রে কেবল দুটি অক্ষরের পার্থক্য আছে। যাদুল মা‘আদে আছে,‘আসলিম তাসলাম, আসলিম ইয়ুতিকাল্লাহ........ আল ডক্টর হামিদুল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত ফটোকপির পত্রে আছে, ‘ফাআসলিম তাসলাম ইযুতিকাল্লাহু। এ ভাবে যাদুল মা‘আদে আছে ‘ইসমু আহলিল কিবতি’ এবং পত্রে আছে ‘ইসমুল কিবতি’ দ্রষ্টব্য ‘রাসূলে আকরাম কী সিয়াসী জিন্দেগী’’ পৃ: ১৩৬-১৩৭ ।

[3] যাদুল মাআদ ৩য় খন্ড ৬১ পৃঃ।