কোন প্রকার ত্যাগ স্বীকার ছাড়াই বুন নাযীর যুদ্ধে মুসলিমগণের এক চমৎকার সাফল্য লাভ সম্ভব হয়। এর ফলে মদীনায় বসবাসকারী মুসলিমগণের অবস্থা বেশ মজবুত হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে মুনাফিক্বগণ বহুলাংশে হীনবল হয়ে পড়ে। এরপর থেকে প্রকাশ্যে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে। এবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ সকল বেদুঈনের খবরাখবর নেয়ার জন্য উদ্যোগী হন যারা উহুদ যুদ্ধের পর মুসলিমগণকে এক কঠিন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল এবং অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ইসলাম প্রচারকদের উপর হামলা চালিয়ে তাঁদের হত্যা করেছিল। এমনি এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তাদের সাহস এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা মদীনা আক্রমণেরও চিন্তা ভাবনা করছিল।

বনু নাযীর যুদ্ধ হতে মুক্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন সেই ওয়াদাভঙ্গকারী বেদুঈনদের শায়েস্তা করার কথা চিন্তা ভাবনা করছিলেন এমন সময় হঠাৎ সংবাদ প্রাপ্ত হন যে, বুন গাতফানের দু’টি গোত্র বুন মোহারেব এবং বনু সালাবাহ মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বেদুঈন ও পল্লীবাসীদের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহ করছে। এ সংবাদ প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাবী কারীম (ﷺ) নাজ্দ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকেন। উদ্দেশ্য ছিল সেই সকল পাষাণ হৃদয় বেদুঈনদের মনে এমন ভাবে ভীতির সঞ্চার করা যাতে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে পূর্বের ন্যায় কোন কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি করতে তারা সাহসী না হয়।

এদিকে উদ্ধত বেদুঈনদের মধ্য থেকে যারা লুণ্ঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল মুসলিমগণের আকস্মিক আক্রমণে তারা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় পলায়ন করে পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলিমগণ এ সকল লুণ্ঠনকারী গোত্র সমূহের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর নিরাপদে মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন।

জীবনী লেখকগণ এ সময়ে একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন যা ৪র্থ হিজরীর রবিউল আখের কিংবা জুমাদাল উলা মাসে নাজদে সংঘটিত হয়েছিল। তাঁরা এ যুদ্ধকেই ‘যাতুর রিক্বা’ বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এ সময় নাজদ ভূমিতে একটি যুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, তখন মদীনার পরিস্থিতি ঠিক সেই রূপই ছিল। উহুদ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় পরবর্তী বছর মদীনা প্রান্তরে যুদ্ধের জন্য আবূ সুফইয়ান যে আহবান জানিয়েছিল এবং মুসলিমরা মঞ্জুর করে নিয়েছিলেন সেই সময়টা ক্রমেই নিকটবর্তী হয়ে আসছিল। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কোনক্রমেই সমীচীন ছিল না যে, বেদুঈন ও গ্রামবাসীদেরকে তাদের ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতার উপর প্রতিষ্ঠিত রেখে দিয়ে বদরের মতো ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য মদীনাকে মুজাহিদশূন্য অবস্থায় রাখা হবে। বরং এটাই অত্যন্ত জরুরী ব্যাপার ছিল যে, বদর প্রান্তরে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বেই ঐ সকল বেদুঈনের উপর এমনভাবে আঘাত হানা যাতে তারা কোন অবস্থাতেই মদীনামুখী হওয়ার সাহস না পায়।

প্রসঙ্গক্রমে এটা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৪র্থ হিজরীর রবিউল আখের কিংবা জুমাদাল উলা মাসে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাকে যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধ বলে যে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে আমার অনুসন্ধান মোতাবেক তা বিশুদ্ধ নয়। কারণ, যাতুর রিক্বা’ যুদ্ধে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) এবং আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন এবং আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) খায়বার যুদ্ধের মাত্র কয়েক দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণের পর খায়বারেই নাবী (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়েছিলেন। গাযওয়ায়ে যাতুর রিক্বা যে খায়বার যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।

৪র্থ হিজরীর বেশ কিছু কাল পর যে যাতুর রিকা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে, এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খাওফের সালাত[1] আদায় করেছিলেন। খাওফের সালাত সর্ব প্রথম আদায় করা হয় গাযওয়ায়ে আসফানে। আর গাযওয়ায়ে ‘উসফান যে খন্দক যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৫ম হিজরীর শেষ ভাগে। প্রকৃতপক্ষে গাযওয়ায়ে আসফান ছিল হুদায়রিয়া সফরের একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা। আর হুদায়বিয়াহ সফর ছিল ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষ ভাগের ঘটনা। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) খায়বার অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। এ সূত্র থেকেও প্রমাণিত হচ্ছে যে, যাতুর রিকা যুদ্ধ খায়বার যুদ্ধের পরেই সংঘটিত হয়েছিল।

[1] যুদ্ধাবস্থায সালাতকে খওফের সালাত বলা হয়। এ সালাতের একটা নিয়ম হচ্ছে অর্ধসংখ্যক সৈন্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থাতেই ইমামের পিছনে সালাত আদায় করবেন আর বাকী অর্ধেক সৈন্য অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় শত্রুদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। এক রাকায়াত সালাতের পর দ্বিতীয় অর্ধেক ইমামের পিছনে চলে আসবেন এবং প্রথম অর্ধেক শত্রুদের প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য চলে যাবেন। ইমাম দ্বিতীয় রাকায়াত পুরো করে নেবেন এবং সেনাবাহিনীর উভয় দল নিজ নিজ সালাত পালাক্রমে পুরো করে নেবেন। এর সঙ্গে সঙ্গতিশীল এ সালাতের আরও কয়েকটি নিয়ম রয়েছে যা যুদ্ধের অবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আদায় করা হয়ে থাকে। বিস্তারিত বিবরণের জন্য হাদীসের কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য।