মুশরিকরা বদর প্রান্তর হতে বিশৃঙ্খল, ছত্রভঙ্গ ও ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় মক্কামুখী হয়। শরম ও সংকোচের কারণে তাদের ধারণায় আসছিল না যে, কিভাবে তারা মক্কায় প্রবেশ লাভ করবে।
ইবনু ইসহাক্ব বলেন যে, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কুরাইশদের পরাজয়ের সংবাদ বহন করে মক্কায় পৌঁছেছিল, সে হলো হাইসামান ইবনু আব্দুল্লাহ কুযায়ী। জনগণ তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যুদ্ধের খবর কী?’ সে উত্তরে বলল, ‘‘উতবাহ ইবনু রাবীআহ, শায়বাহ ইবনু রাবীআহ, আবুল হাকাম ইবনু হিশাম, উমাইয়া ইবনু খালফসহ আরো কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে যারা সবাই নিহত হয়েছে। সে যখন নিহতদের তালিকায় সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের নাম উল্লেখ করতে শুরু করল তখন হাতীমের উপর উপবিষ্ট সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বলল, ‘আল্লাহর কসম! যদি তার স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে থাকে তবে তাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর?’ জনগণ তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলত সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার কী হয়েছে?’ সে উত্তরে বলল ‘ঐ দেখ, সে হাতীমে উপবিষ্ট রয়েছে। আল্লাহর কসম! তার পিতা ও ভ্রাতাকে নিহত হতে স্বয়ং আমিই দেখেছি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র আযাদকৃত দাস আবূ রাফি (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘আমি ঐ সময় আব্বাস (রাঃ)-এর গোলাম ছিলাম। আমাদের বাড়িতে ইসলাম প্রবেশ করেছিল। আব্বাস (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন, উম্মুল ফযল (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন এবং আমিও মুসলিম হয়েছিলাম। তবে অবশ্যই আব্বাস (রাঃ) তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন। এদিকে আবূ লাহাব বদর যুদ্ধে হাযির হয়নি। যখন কুরাইশদের পরাজয়ের খবর তার কানে পৌঁছল তখন লজ্জায় ও অপমানে তার মুখ কালো হয়ে গেল। পক্ষান্তরে আমরা নিজেদের মধ্যে শক্তি ও সম্মান অনুভব করলাম। আমি দুর্বল মানুষ ছিলাম, তীর বানাতাম এবং যমযম কক্ষে বসে তীরের হাতল ছিলতাম। আল্লাহর কসম! ঐ সময় আমি কক্ষে বসে তীর ছিলছিলাম। উম্মুল ফযল (রাঃ) আমার পাশেই বসেছিলেন এবং যে খবর এসেছিল তাতে আমরা খুশী ও আনন্দিত ছিলাম। ইতোমধ্যে আবূ লাহাব জঘন্যভাবে তার পদদ্বয় টেনে টেনে আমাদের কাছে এসে কক্ষপ্রান্তে বসে পড়লো। তার পৃষ্ঠ আমার পৃষ্ঠের দিকে ছিল। হঠাৎ গোলমাল শোনা গেল, ‘আবূ সুফইয়ান ইবনু হারিস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব এসে গেছে।’ আবূ লাহাব তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র। আমার কাছে এসো। আমার জীবনের শপথ! তোমার নিকট হতে খবর পাওয়া যাবে।’ তিনি আবূ লাহাবের কাছে বসে পড়লেন। জনগণ দাঁড়িয়ে ছিল। আবূ লাহাব বলল, লোকদের কী অবস্থা? ‘বল ভাতিজা, যুদ্ধের খবর কী?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘কিছুই নয়, এটুকুই বলা যথেষ্ট যে, লোকদের মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা হয়েছে এবং আমরা আমাদের কাঁধগুলো তাদেরকে সোপর্দ করেছি। তারা আমাদের ইচ্ছামত হত্যা করেছে এবং বন্দী করেছে। তা সত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদেরকে তিরষ্কার করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মোকাবালা এমন কতিপয় লোকের সঙ্গে হয়েছিল যারা আসমান ও জমিনের মধ্যস্থানে সাদাকালো মিশ্রিত ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল। আল্লাহর শপথ! না তারা কোন কিছু ছেড়ে দিচ্ছিল, না কোন জিনিস তাদের মোকাবালায় টিকতে পারছিল।’
আবূ রাফি (রাঃ) বলেন, আমি স্বীয় হাত দ্বারা তাঁবুর প্রান্ত উঠালাম, তারপর বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! তারা ছিলেন ফিরিশতা’। আমার এ কথা শুনে আবূ লাহাব তার হাত উঠিয়ে ভীষণ জোরে আমার গালে এক চড় লাগিয়ে দিল। আমি তখন তার সাথে লড়ে গেলাম। কিন্তু সে আমাকে উঠিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমার উপর হাঁটুর ভরে বসে আমাকে প্রহার করতে লাগল। আমি দুর্বল প্রমাণিত হলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে উম্মুল ফযল উঠে তাঁবুর একটি খুঁটি নিয়ে তাকে এমনভাবে মারলেন যে, তার মাথায় ভীষণভাবে আঘাত লাগল। আর সাথে সাথে উম্মুল ফযল (রাঃ) বলে উঠলেন, ‘তার মনিব নেই বলে তাকে দুর্বল মনে করছো। আবূ লাহাব তখন লজ্জিত হয়ে উঠে চলে গেল। এরপর আল্লাহর কসম! মাত্র সাত দিন অতিবাহিত হয়েছে এরই মধ্যে আল্লাহর হুকুমে সে আদাস নামক কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলো এবং এতেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে গেল। আদাসার ফোড়াকে আরবরা বড়ই কুলক্ষণ মনে করত। তাই, তার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা তার গোর-কাফন না করে তিন দিন পর্যন্ত তাকে উপরেই রেখে দেয়। কেউই তার নিকটে গেল না এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থাও করলনা। অবশেষে যখন তার পুত্ররা আশঙ্কা করল যে, তাকে এভাবে রেখে দিলে জনগণ তাদেরকে তিরস্কার করবে তখন তারা একটি গর্ত খনন করে ঐ গর্তের মধ্যে তার মৃত দেহকে কাঠ দ্বারা ঢেকে ফেলে দিল এবং দূর থেকেই ঐ গর্তের মধ্যে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে ঢেকে ফেললো।
মোট কথা, এভাবে মক্কাবাসীগণ তাদের লোকদের সুস্পষ্ট পরাজয়ের খবর পেলো এবং তাদের স্বভাবের উপর এর অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া হলো। এমনকি তারা নিহতদের উপর বিলাপ করতে নিষেধ করে দিল যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ না পায়।
এ ব্যাপারে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা রয়েছে। তা হচ্ছে বদরের যুদ্ধে আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের তিনটি পুত্র মারা যায়। তাদের জন্য সে কাঁদতে চাচ্ছিল। সে ছিল অন্ধ লোক। একদা রাত্রে সে এক বিলাপকারিণী মহিলার বিলাপের শব্দ শুনতে পেল। তৎক্ষণাৎ সে তার গোলামকে বলল ‘তুমি গিয়ে দেখ তো, বিলাপ করার কি অনুমতি পাওয়া গেছে? কুরাইশরা কি নিহতদের জন্য ক্রন্দন করছে? তাহলে আমিও আমার পুত্র আবূ হাকিমের জন্য ক্রন্দন করব। কেননা, আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে।’ গোলাম ফিরে এসে খবর দিল ‘মহিলাটি তো তার এক হারানো উটের জন্য ক্রন্দন করছে।’ এ কথা শুনে আসওয়াদ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। আবেগে সে নিম্নের বিলাপ পূর্ণ কবিতাটি বলে ফেললোঃ
أتبكي أن يضل لها بـعـير ** ويمنعها من النوم السهود
فلا تبكي على بكر ولكـن ** على بدر تقاصرت الجدود
على بدر سراة بني هصيص ** ومخزوم ورهط أبي الوليد
وبكى إن بكيت على عقيل ** وبكى حارثا أسد الأسود
وبكيهم ولا تسمى جميعـا ** وما لأبي حكيمة من نديد
ألا قد ساد بعدهـم رجال ** ولولا يوم بدر لم يسودوا
অর্থঃ ‘তার উট হারিয়ে গেছে এজন্যে কি সে কাঁদছে? আর ওর জন্যে অনিদ্রা কি তার নিদ্রাকে হারাম করে দিয়েছে। (হে মহিলা) তুমি উটের জন্যে ক্রন্দন করো না, বরং বদরের (নিহতদের) জন্যে ক্রন্দন করো, যেখানে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে গেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদরের (বেদনাদায়ক ঘটনার) জন্যে ক্রন্দন করো যেখানে বনু হাসীস, বনু মাখযূম, আবুল ওয়ালীদ প্রভৃতি গোত্রের অসাধারণ ব্যক্তিবর্গ (সমাধিস্থ) রয়েছে। যদি ক্রন্দন করতেই হয় তবে আকীলের জন্যে ক্রন্দন করো এবং হারিসের জন্যে ক্রন্দন করো যারা ছিল সিংহদের সিংহ। তুমি ঐ লোকদের জন্যে ক্রন্দন করো এবং সবার নাম নিও না। আর আবূ হাকীমার তো কোন সমকক্ষই ছিল না। দেখ ওদের পরে এমন লোকেরা নেতা হয়ে গেছে যে, ওরা থাকলে এরা নেতা হতে পারত না।’