নাবী পরিবার পরম্পরা (الأُسْرَةُ النَّبَوِيَّةُ):

 নাবী কারীম (ﷺ)-এর পরিবার উপরের দিকে তাঁর প্রপিতামহ হাশিম বিন আবদে মানাফ থেকে পারিবারিক পরিচয় প্রদানের মূলসূত্র ধরার কারণে তা হাশেমী পরিবার নামে প্রসিদ্ধ ছিল। নাবী কারীম (ﷺ) সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য তাঁর পিতামহ, প্রপিতামহ, অর্থাৎ পূর্বতন কয়েক প্রজন্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের জীবনী সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। এ প্রেক্ষিতেই পরবর্তী আলোচনাঃ

হাশেমঃ আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, যখন বনু আবদে মানাফ এবং বনু আবদুদ্দারের মধ্যে হারামের সঙ্গে সংশি­ষ্ট পদ সমূহ বন্টনের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তখন আবদে মানাফের সন্তানদের মধ্যে হাশিমকেই ‘সিক্বায়াহ’ এবং রিফাদাহ অর্থাৎ হজ্জযাত্রীগণকে পানি পান করানো এবং তাঁদের মেহমানদারী করার মর্যাদা প্রদান করা হয়। হাশিম ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘শোরবা’ বা ঝোলের সঙ্গে রুটি মিশ্রিত করে মক্কায় হজ্জযাত্রীগণকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করেন। তাঁর আসল নাম ছিল ‘‘আমর’। কিন্তু শোরবা বা ঝোলের সঙ্গে রুটি ভেঙ্গে মিশ্রিত করার কারণে ‘হাশিম’ নামে তাকে ডাকা হতে থাকে। কারণ, হাশিম অর্থ হচ্ছে যিনি কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলেন। আবার এ হাশিমই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কুরাইশদের জন্য গ্রীষ্ম ও শীত কালে ব্যবসা-সংক্রান্ত দুইটি ভ্রমণ-পর্যটনের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর সম্পর্কে জনৈক কবি বলেছেনঃ

عمرو الذي هَشَمَ الثريدَ لقومه

** 

قَومٍ بمكة مُسِْنتِين عِجَافِ

سُنَّتْ إليه الرحلتان كلاهما

**   

سَفَرُ الشتاء ورحلة الأصياف

অর্থঃ ‘এ ‘আমরই এমন ব্যক্তিসত্তা যিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুর্বল স্বজাতির জন্য মক্কায় ‘শোরবা বা ঝোলের মধ্যে রুটির টুকরো ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাইয়েছিলেন এবং শীত ও গ্রীষ্মের দিনে ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলেন।’

তাঁর ব্যক্তি জীবন এবং পরবর্তী ইতিহাসের সঙ্গে সংশি­ষ্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এটা যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে শাম রাজ্যে যাওয়ার পথে যখন তিনি মদীনায় পৌঁছলেন তখন সেখানে বনু নাজ্জার গোত্রের সালামাহ বিনতে ‘আমর নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং কিছুকাল সেখানে অবস্থান করেন। তারপর স্বীয় স্ত্রীকে গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর পিত্রালয়ে রেখে দিয়ে তিনি শাম রাজ্যে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে ফিলিস্ত্বীনের গায্যাহ শহরে পরলোক গমন করেন।

এদিকে সালামাহর গর্ভজাত সন্তান যথা সময়ে ভূমিষ্ট হন। বর্ষপঞ্জীর হিসেবে সে বছরটি ছিল ৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দ। নবজাত শিশুর মাথার চুল ছিল সাদা তাই সালামাহ তাঁর নাম রাখেন শায়বাহ।[1] সালামাহ নিজ পিত্রালয়ে সযত্নে তাঁর লালন পালন করতে থাকেন। সেদিনের এ শিশুটিই ছিলেন পরবর্তী কালে আখেরী নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পিতামহ এবং অভিভাবক আব্দুল মুত্তালিব। শিশু আব্দুল মুত্তালিব দিনে দিনে শশীকলার মত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে উঠলেও দীর্ঘদিন যাবৎ হাশিম পরিবারের কেউই তাঁর জন্মের কথা জানতে পারেন নি। হাশিম ছিলেন ৯ জন সন্তান-সন্ততির জনক। ৯ জনের মধ্যে ৪ জন ছেলে ও ৫ জন মেয়ে। তাঁদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে আসাদ, আবূ সাইফী, নাযলাহ, আব্দুল মুত্তালিব এবং শিফা, খালিদাহ, যা’ঈফাহ, রুক্বাইয়া ও জান্নাহ।[2]

আব্দুল মুত্তালিবঃ পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বিলক্ষণ অবগত হয়েছি যে, ‘সিক্বায়াহ’ এবং ‘রিফাদাহ’ সম্পর্কিত পদের দায়িত্ব অর্পিত ছিল হাশিমের উপর। হাশিমের মৃত্যুর পর সেই দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর ভাই মুত্তালিবের উপর। তিনিও দলের মধ্যে বিভিন্ন সদগুণাবলী এবং মান-মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কথা অমান্য করা কিংবা নড়চড় করার ক্ষমতা দলের অন্য কারো ছিল না। বদান্যতার জন্যও তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। বদান্যতার কারণেই কুরাইশগণ তাঁর নাম রাখেন ‘ফাইয়ায’। যখন শায়বাহ অর্থাৎ আব্দুল মুত্তালিব দশ বছর বয়সে উপনীত হন তখন মুত্তালিব তাঁর সম্পর্কে অবগত হয়ে নিয়ে আসার জন্য ইয়াসরিব গমন করেন। সেখানে পৌঁছার পর যখন তিনি শায়বাহকে দেখতে পান তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে থাকে। তারপর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে উষ্ট্র পৃষ্ঠে আরোহণ করে নেন এবং মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

কিন্তু শায়বাহ তাঁর মাতার অনুমতি ব্যতিরেকে মক্কা যেতে অস্বীকার করায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুত্তালিব তাঁর মাতার নিকট অনুমতি প্রার্থী হন। কিন্তু শায়বাহর মাতা তাঁকে অনুমতি দিতে অস্বীকার করলে মুত্তালিব তাঁকে এ কথা বুঝিয়ে বলেন যে, ‘এ ছেলে তাঁর পিতার রাজত্বে এবং আল্লাহর হারাম শরীফের দিকে যাচ্ছেন। নিশ্চিতরূপে এ হচ্ছে তাঁর চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।’’

এ কথা শ্রবণের পর শায়বাহকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর আম্মা অনুমতি প্রদান করেন। অনুমতি লাভের পর মুত্তালিব তাঁকে তাঁর উটের পিঠে বসিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। মক্কায় পৌঁছলে শায়বাহকে মুত্তালিবের পাশে দেখে মক্কাবাসীগণ বলেন যে, এ বালক হচ্ছে ‘আব্দুল মুত্তালিব’ অর্থাৎ মুত্তালিবের দাস। তদুত্তরে মুত্তালিব বলেন, ‘না না, এ হচ্ছে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, আমার ভাই হাশিমের ছেলে।’ এর পর থেকে মুত্তালিবের নিকট লালিত হতে থাকেন।

শায়বাহ যখন যৌবনে পদার্পণ করেন তখন কোন এক সময় রোমান সাম্রাজ্যের ইয়ামানে মুত্তালিব পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আব্দুল মুত্তালিব পরিত্যক্ত পদ সমূহের অধিকার লাভ করেন। কালক্রমে আব্দুল মুত্তালিব নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন মান-মর্যাদা লাভ করেন যে, তাঁর পিতা কিংবা পিতামহ কেউই এত মান-সম্মানের অধিকারী হতে সক্ষম হন নি। একজন গুণী ব্যক্তি হিসেবে কাওমের লোকেরা সকলেই তাঁকে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ভালবাসতেন এবং সমীহ করে চলতেন।[3]

মুত্তালিব যখন পরলোক গমন করেন তখন নাওফাল বল প্রয়োগ করে আব্দুল মুত্তালিব চত্ত্বর দখল করে নেন। আব্দুল মুত্তালিবের একার পক্ষে তাঁর চাচার সঙ্গে মুকাবিলা করা সম্ভব না হওয়ার কারণে কুরাইশ গোত্রের কোন কোন লোকের নিকট তিনি সাহায্য প্রার্থী হন। কিন্তু তাঁরা এ কথা বলে আপত্তি করেন যে, তাঁর এবং তাঁর চাচার বিরোধের ব্যাপারে কোন কিছু করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিরুপায় হয়ে আব্দুল মুত্তালিব বনু নাজ্জার গোত্রের তাঁর মামা গোষ্ঠির নিকট কিছু কবিতা লিখে পাঠান যার মধ্যে নিহিত ছিল সাহায্যের করুণ আবেদন। এ আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর মামা আবূ সা‘দ বিন আদী আশি জন অশ্বারোহী নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং আবতাহ নামক স্থানে অবতরণ করেন। আব্দুল মুত্তালিব সেখানে গিয়ে তাঁর মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু নাওফালের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত আবূ সা‘দ তাঁর গৃহে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তারপর তিনি অগ্রসর হয়ে নাওফালের নানার নিকট গিয়ে দাঁড়ান।

নাওফাল তখন হাতীম নামক স্থানে কয়েকজন কুরাইশদের সাথে উপবিষ্ট ছিলেন। আবূ সা‘দ তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, ‘এ পবিত্র ঘরের প্রভুর শপথ, তোমরা যদি ভাগ্নেকে তাঁর অধিকার ফিরিয়ে না দাও তাহলে এ তলোয়ার তোমার বক্ষদেশ বিদীর্ণ করবে।’ কোন ইতস্তত না করে নাওফাল বললেন, ‘ঠিক আছে আমি তাঁর অধিকার ফেরত দিলাম।’ এ কথা শ্রবণের পর আবূ সা‘দ কুরাইশদের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে সাক্ষী থাকা এবং প্রয়োজনবোধে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান। তারপর তিনি আব্দুল মুত্তালিবের গৃহে গমন করেন এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান ও উমরাহ পালনের পর মদীনা প্রতাবর্তন করেন।

এ ঘটনার পর নাওফাল বনু হাশিমের বিরুদ্ধে বনু আবদে শামস এর সাথে পরস্পর সাহায্য ও সহযোগিতামূলক এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ দিকে বনু খুযা’আহ গোত্র যখন লক্ষ্য করলেন যে, বনু নাজ্জার গোত্র আব্দুল মুত্তালিবকে সাহায্য করেছে তখন তাঁরা বললেন যে, ‘আব্দুল মুত্তালিব যেমন তোমাদের সন্তান, তেমনি আমাদেরও সন্তান। অতএব, তাঁকে সাহায্য করা অধিকভাবে আমাদেরই কর্তব্য।’ কারণ আবদে মানাফের মায়ের সম্পর্ক ছিল খুযা’আহ গোত্রের সঙ্গে। এ প্রেক্ষিতে বনু খুযা’আহ গোত্র দারুণ নাদওয়ায় গিয়ে বনু আবদে শামস এবং বনু নাওফালের বিরুদ্ধে বনু হাশিমের সঙ্গে সাহায্য ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে এমন সব অঙ্গীকার করা হয়েছিল যা পরবর্তী পর্যায়ের ইসলামী যুগে মক্কা বিজয়ের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। বিস্তারিত বিবরণ যথাস্থানে উল্লে­খিত হবে।[4]

বায়তুল্লাহর সঙ্গে সংশি­ষ্ট হওয়ায় আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে দুইটি বিশেষ ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘যমযম’ কূপের খনন কাজ সম্পর্কিত ঘটনা এবং অন্যটি হচ্ছে ‘হস্তী বাহিনী’ সম্পর্কিত ঘটনা। ঘটনা দুটি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৭ পৃঃ রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ২৬ পৃঃ/ ২য় খন্ড ২৪ পৃঃ।

[2] রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০৭ পৃঃ।

[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ১৩৭-১৩৮ পৃঃ।

[4] শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ আবুল ওয়াহহাব নাজদী (রহঃ) মুখাতাসার সীরাতে রাসূল ৪১-৪২ পৃঃ।