وَذُو اخْتِلافِ سَنَدٍ أَوْ مَتْنِ | مُضْطَرِبٌ عِنْدَ أُهَيْلِ الْفَنِّ
“আর বৈপরীত্যশীল সনদ বা মতন বিশিষ্ট হাদিস এ শাস্ত্রে অভিজ্ঞদের নিকট মুদতারিব”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের পঞ্চবিংশ প্রকার মুদতারিব। হাদিসের এ প্রকারের সম্পর্ক সনদ ও মতন উভয়ের সাথে।
اضطراب এর আভিধানিক অর্থ অমিল ও ইখতিলাফ। ইদতিরাবের মূল ব্যবহার হয় নদী বা সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্ষেত্রে, যখন অধিক তরঙ্গ দেখা দেয় ও ঢেউয়ের উপর ঢেউ আছড়ে পড়ে, তখন বলা হয়: اضطربت الأمواج ‘সমুদ্র অশান্ত হয়ে উঠছে বা ঢেউয়ের উপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে’। এ থেকে এক সনদের সাথে অপর সনদ ও এক মতনের সাথে অপর মতনের অমিল ও বিরোধ হলে ইদতিরাব বলা হয়।
‘ইদতিরাবে’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “সমান শক্তিশালী একাধিক সনদ অথবা মতনের বৈপরীত্য বা অমিলকে হাদিসের পরিভাষায় ইদতিরাব বলা হয়, যেগুলোর মাঝে সমন্বয় করা কিংবা কোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব নয়”। চারটি শর্তে ইদতিরাব হয়:
১. একাধিক সনদ, ২. পরস্পরের মাঝে অমিল, ৩. সব সনদের সমান শক্তিশালী হওয়া, ৪. উসুলে হাদিসের নীতিতে সমন্বয় করা সম্ভব না হওয়া।
অতএব ইদতিরাব সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে সব ক’টি সনদের মান ও শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। মুত্তাসিল ও মুনকাতি‘ এবং মারফূ‘ ও মাওকুফের মাঝে ইদতিরাব হয় না। অনুরূপ একাধিক সনদের মাঝে সমন্বয় কিংবা কোনো একটিকে প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব হলে ইদতিরাব বলা হয় না।
সমন্বয়ের ফলে ইদতিরাব নেই:
আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ ‘মানযুমাহ বাইকুনিয়া’র ব্যাখ্যায় বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজের বর্ণনা সম্বলিত হাদিসে ইদতিরাব পরীলক্ষিত হয়, কেউ বলেন: তিনি কিরান হজ করেছেন। কেউ বলেন: ইফরাদ হজ করেছেন। কেউ বলেন: তামাত্তু হজ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এতে কোনো ইদতিরাব নেই, কারণ সমন্বয় করা সম্ভব। সমন্বয় করার দু’টি পদ্ধতি:
প্রথম পদ্ধতি: যারা বলেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফরাদ হজ করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য ইফরাদ আমল, যেমন তিনি মক্কায় পৌঁছে প্রথমে তওয়াফে কুদুম ও হজের সায়ি করেন। অতঃপর ঈদের দিন শুধু তওয়াফে ইফাদা করেন। অতঃপর মক্কা ত্যাগ করার সময় তওয়াফে বিদা করে প্রস্থান করেন।
যারা বলেন তিনি তামাত্তু হজ করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য হজ ও ওমরা এক সফরে সম্পাদন করা। হজ ও ওমরা দু’টি ইবাদত, দু’সফরে সম্পাদন করাই স্বাভাবিক, তবে তিনি এক সফরে উভয় সম্পাদন করে ফায়দা তথা তামাত্তু হাসিল করেছেন। ওমরার পৃথক সফর ও অর্থব্যয় থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তামাত্তু অর্থ ফায়দা হাসিল করা।
যারা বলেন তিনি কিরান হজ করেছেন, তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত হজের বর্ণনা দিয়েছেন।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুরুতে হজের ইহরাম বাঁধেন, অতঃপর তার সাথে ওমরা সংযুক্ত করেন। ইহরামের প্রথম অবস্থার ভিত্তিতে তিনি মুফরিদ, দ্বিতীয় অবস্থার ভিত্তিতে তিনি কারিন। হজ ও ওমরা এক সফরে আদায় করেছেন হিসেবে তামাত্তুকারী।
শায়খুল ইসলাম ইব্নে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ প্রথম পদ্ধতি সমর্থন করে বলেন: “যিনি ইফরাদ বলেছেন, তার উদ্দেশ্য হজের আমল। যিনি তামাত্তু বলেছেন, তার উদ্দেশ্য এক সফরে হজ ও ওমরা সম্পন্ন করে তামাত্তু হাসিল করা। যিনি কিরান বলেছেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত হজ বর্ণনা করেছেন”।[1]
হজ তিন প্রকার:
১. ইফরাদ। ২. তামাত্তু। ৩. কিরান।
১- ইফরাদ: মিকাত থেকে শুধু হজের ইহরাম বেঁধে মুখে لبيك اللهم حجًّا বলা, অতঃপর মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফে কুদুম ও হজের সায়ি সম্পন্ন করে হজের শেষ পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকা। ঈদের দিন তাওয়াফে ইফাদা করে বাড়ি ফিরার সময় তাওয়াফে বিদা করা।
২- কিরান: একসাথে হজ ও ওমরার ইহরাম বেঁধে মুখে لبيك اللهم عمرة وحجًّا বলা, অতঃপর মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফে কুদুম ও হজ-ওমরার সায়ি করা। অতঃপর ইহরাম অবস্থায় থেকে ঈদের দিন শুধু তাওয়াফে ইফাদা করা। বাড়ি ফেরার সময় তাওয়াফে বিদা করা। কিরানের কর্মগুলো ইফরাদের ন্যায়, পার্থক্য শুধু নিয়তে ও হাদই প্রদানে।
৩- তামাত্তু: মিকাত থেকে ওমরার ইহরাম বেঁধে মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফ, সায়ি ও চুল ছোট করে ওমরা সম্পন্ন করা। অতঃপর জিল হজের অষ্টম দিন ইহরাম বেঁধে ঈদের দিন তাওয়াফে ইফাদা ও হজের সায়ি করা। বাড়ি ফেরার সময় শুধু তাওয়াফে বিদা করা।
প্রাধান্য দেওয়ার ফলে ইদতিরাব নেই:
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা যখন বারিরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে মুক্ত করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহ বহাল রাখা কিংবা ভেঙ্গে ফেলার স্বাধীনতা দেন। তখন ‘বারিরাহ’র স্বামী মুগিস গোলাম না স্বাধীন ছিল ইখতিলাফ রয়েছে, যা দূর করা সম্ভব নয়, তাই প্রাধান্য দেওয়ার নীতি অনুসরণ করব। মুহাদ্দিসদের নিকট মুগিস গোলাম ছিল বর্ণনা অধিক বিশুদ্ধ। ইমাম বুখারি বর্ণনা করেন:
قَالَ الْحَكَمُ: وَكَانَ زَوْجُهَا حُرًّا وَقَوْلُ الْحَكَمِ: مُرْسَلٌ، وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: رَأَيْتُهُ عَبْدًا.
“হাকাম বলেছে: তার স্বামী ছিল স্বাধীন, হাকামের কথা মুরসাল। ইব্ন আব্বাস বলেছেন: আমি তাকে গোলাম দেখেছি”।[2] বুখারি অন্যত্র বলেন:
قَالَ الْأَسْوَدُ: وَكَانَ زَوْجُهَا حُرًّا ". قَوْلُ الْأَسْوَدِ: مُنْقَطِعٌ، وَقَوْلُ ابْنِ عَبَّاسٍ: رَأَيْتُهُ عَبْدًا: أَصَحُّ.
“আসওয়াদ বলেছে: তার স্বামী ছিল স্বাধীন, আর আসওয়াদের কথা: মুনকাতি‘। ইব্ন আব্বাসের বাণী: ‘আমি তাকে গোলাম দেখেছি’ অধিক বিশুদ্ধ”।[3] ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন:
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: " كَانَ زَوْجُ بَرِيرَةَ عَبْدًا "
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আর তার স্বামী ছিল গোলাম”।[4] অতএব এতে কোনো ইদতিরাব নেই, কারণ বারিরার স্বামী গোলাম ছিল বর্ণনাগুলো অধিক বিশুদ্ধ।
ইব্ন দাকিকুল ঈদ বলেন: “মাখরাজ এক না হলে ইদতিরাব হবে না”।[5] অর্থাৎ মুদতারিব হাদিসের সব ক’টি সনদ একজন রাবির উপর নির্ভরশীল হতে হবে। সাহাবি দু’জন হলে ইদতিরাব হবে না।
ইব্ন রজব রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “... জেনে রাখ, এক হাদিসের সনদে ইখতিলাফ হলে ইদতিরাব হয়, একাধিক হাদিসের সনদের মাঝে ইদতিরাব হয় না। অতএব এক সনদের কারণে অপর সনদ ভুল বলা যাবে না।”।[6]
শায়খ সুলাইমানি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “ইদতিরাবের শর্তগুলো খুব সূক্ষ্ম, কোন হাদিসের সকল সনদ জমা করে ইদতিরাবের শর্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মুদতারিব ফায়সালা করা কঠিন কাজ। কারণ কেউ একটি হাদিস মুদতারিব বলল, অতঃপর তার চেয়ে বিজ্ঞ কেউ তাতে প্রাধান্য দিল, অথবা উভয়ের মাঝে সমন্বয় করল, তখন ইদতিরাব থাকবে না। ‘শায’ ফয়সালা করা অপেক্ষাকৃত সহজ, ইদতিরাব ফয়সালা করা কঠিন, বিশেষ করে মতনের ইদতিরাব”।[7] ইদতিরাব সনদ ও মতন উভয় জায়গায় হয়, বেশী হয় সনদে।
সুলাইমানি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “আলেমগণ সনদের কারণে একাধিক হাদিসে ইদতিরাবের বিধান আরোপ করেছেন, কিন্তু মতনের কারণে মাত্র কয়েকটি হাদিস মুদতারিব বলেছেন। সাখাবি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: ‘ইদতিরাবের সুনির্দিষ্ট উদাহরণ পাওয়া খুব মুশকিল’। অর্থাৎ এমন হাদিস পাওয়া দুষ্কর যা শুধু ইদতিরাবের কারণে দুর্বল, ইদতিরাব না হলে হাদিসটি সহি হত”।[8]
জ্ঞাতব্য: ইদতিরাব সেকাহ রাবিদের হাদিসে হয়, দুর্বল রাবিদের হাদিসে ইদতিরাব হয় না। কারণ, তাদের হাদিস ইদতিরাব ছাড়াই দুর্বল। আর ইদতিরাব সম্পন্ন হাদিস, ইদতিরাব থেকে মুক্ত হলে সহি হয়। তাই এ প্রকার সেকাহ রাবিদের হাদিসের সাথে খাস।
মুদতারিব হাদিসের হুকুম:
মুদতারিব হাদিস দ্বা‘ঈফ, কারণ রাবিদের ইখতিলাফ প্রমাণ করে কেউ হাদিসটি ভালো করে সংরক্ষণ করতে পারেনি।
>[2] বুখারি: (৬৭৫১)
[3] বুখারি: (৬৭৫৪)
[4] মুসলিম: (১০/১৪৭), (২৭৭৫)
[5] আল-ইকতিরাহ: (পৃ.৩২৪)
[6] শারহু ‘ইলালিত তিরমিযি: (২/৮৪৩)
[7] আল-জাওয়াহির: (৩৩৭)
[8] আল-জাওয়াহির: (৩৩৭)