متواتر শব্দের উৎপত্তি تواتر ধাতু থেকে। আভিধানিক অর্থ تتابع বা লাগাতার, যেমন বলা হয়: تواتر المطر ‘লাগাতার বৃষ্টি হয়েছে’। অনুরূপ বলা হয়: تواتر المصلون إلى المسجد ‘লাগাতার মুসল্লি মসজিদে এসেছে’। এ থেকে লাগাতার অগণিত মানুষের বর্ণিত হাদিসকে মুতাওয়াতির বলা হয়।
متواتر এর পারিভাষিক সংজ্ঞা: “বৃহৎ জনসংখ্যার বর্ণিত হাদিস, মিথ্যার উপর যাদের একাট্টা হওয়া অসম্ভব, সনদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা বিদ্যমান থাকলে হাদিসকে মুতাওয়াতির বলা হয়।”
‘মুতাওয়াতির’ হাদিস বর্ণনাকারী অনেক সাহাবি থাকা জরুরি, যাদের একাট্টা হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যা রচনা করা অসম্ভব। হাদিসটি যদি বাণী হয়, তাহলে সবাই তাকে বলতে শুনেছেন; কর্ম হলে সবাই তাকে করতে দেখেছেন; অতঃপর একদল সাহাবি থেকে একদল তাবে‘ঈ বর্ণনা করেছেন; অতঃপর তাদের থেকে একদল অনুসারী বর্ণনা করেছেন; এভাবে হাদিসের বর্ণনাধারা গ্রহণযোগ্য কিতাবসমূহে লিপিবদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকা জরুরি। এ থেকে মুতাওয়াতির হাদিসের চারটি শর্ত পেলাম:
১. অধিক সংখ্যক সাহাবির বর্ণনা করা, যাদের সংখ্যা কোনো অবস্থায় চার থেকে কম নয়। তারা সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিস শ্রবণ করেছেন। অতঃপর তাদের থেকে দ্বিতীয় এক জমাত শ্রবণ করেছে, অতঃপর তাদের থেকে তৃতীয় এক জমাত শ্রবণ করেছে, এভাবে সনদের প্রত্যেক স্তরে রাবির সংখ্যা অধিক থাকা জরুরি, যাদের নির্ভুলতা সম্পর্কে চূড়ান্ত জ্ঞান হাসিল হয়।
২. মুতাওয়াতির হাদিসে প্রত্যেক স্তরে রাবির সংখ্যা এতো পরিমাণ থাকা জরুরি যে, তাদের মিথ্যার উপর একাট্টা হওয়া বিবেক সমর্থন করে না, যেমন তারা সবাই সেকাহ ও তাদের আদালত সবার নিকট প্রসিদ্ধ, অথবা তারা বিভিন্ন দেশের, অথবা তারা বিভিন্ন মাযহাবের। এমন কোনো কারণ নেই, যার ভিত্তিতে তারা সবাই বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি সংবাদ রচনা করবে। আবার হঠাৎ করে কিংবা অনিচ্ছায় তাদের সবার মিথ্যার উপর সমবেত হওয়া অসম্ভব ও অকল্পনীয়।
অতএব মুতাওয়াতির হাদিসে সংখ্যা বিবেচ্য নয়, তাদের মিথ্যার উপর একাট্টা সম্ভব নয় এরূপ হওয়া জরুরি। যদি চার ব্যক্তির মাঝে এ শর্ত পাওয়া যায়, তাহলে হাদিস মুতাওয়াতির, নচেৎ এক শো রাবির বর্ণিত সংবাদও মুতাওয়াতির নয়।
৩. মুতাওয়াতির হাদিসের বাহন মানুষ হওয়া জরুরি, যদি হাজারো জ্ঞানী দীর্ঘ গবেষণার পর বলে আল্লাহ এক, তাদের কথা মুতাওয়াতির হবে না, কারণ সেটা সংবাদ নয়।
৪. রাবিদের বর্ণিত হাদিস শ্রোতাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ও অকাট্য জ্ঞানের জন্ম দিতে হবে, যা নির্দিষ্ট সংখ্যার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং কখনো হাসিল হয় সংখ্যার কারণে, কখনো হাসিল হয় রাবিদের বিশেষ গুণের কারণে, কখনো হাসিল হয় অন্যান্য নিদর্শন দ্বারা, কখনো হাসিল হয় উম্মতের সবার বিনা বাক্যে গ্রহণ করার ফলে।
মুতাওয়াতির দু’প্রকার:
১. শব্দের তাওয়াতুর: যে হাদিস সকল রাবি একই শব্দে বর্ণনা করেন, কতক শব্দ ব্যতিক্রম হলেও অর্থ পরিবর্তন হয় না, তাই শব্দের মুতাওয়াতির, যেমন:
«مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»
“আমার উপর যে মিথ্যা রচনা করল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[1]
এ হাদিস নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শত্তুর থেকে অধিক সাহাবি বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবিও রয়েছেন, তাদের থেকে ক্রমানুসারে বিরাট এক জমাত বর্ণনা করেছে। হাদিসের কোনো কিতাব পাওয়া যাবে না, যেখানে এ হাদিস নেই।
২. অর্থের তাওয়াতুর: অনেক রাবি কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন বিষয় সম্বলিত প্রচুর হাদিস বিদ্যমান, যাদের মিথ্যার উপর একাট্টা হয়ে এসব হাদিস রচনা করা অসম্ভব, তাদের একটি হাদিসও অন্যান্য হাদিসের সাথে অর্থ ও শব্দের মিল না-থাকার করণে মুতাওয়াতির পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি, তবে একটি বিষয় রয়েছে, যা প্রত্যেক হাদিসে বিদ্যমান, তাই সে বিষয়টি মুতাওয়াতির। যেমন দো‘আর সময় উভয় হাত উত্তোলন করার হাদিস। শতাধিক হাদিসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আর সময় উভয় হাত উত্তোলন করেছেন, প্রত্যেকটি হাদিস খবরে ওয়াহেদ, এক হাদিসে যে ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, অপর হাদিসে তার বর্ণনা নেই, তবে সব হাদিসে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আর সময় উভয় হাত উঠিয়েছেন। অতএব দো‘আর সময় উভয় হাত উঠানো মুতাওয়াতির বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এটা অর্থগত মুতাওয়াতির।