উসুলে হাদিসের অপর দিকপাল ইব্ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ সহজ ও সাবলীল ভাষায় অতি সংক্ষেপে একখানা কিতাব লিখেন "نُخْبَة الفِكَرِ في مصطلحِ أهلِ الأثر" নামে, যা মাত্র কয়েক পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। অতঃপর তিনি নিজেই তার নাতিদীর্ঘ এক ব্যাখ্যা লিখেন "نُزْهَة النظر شرح نُخْبَةِ الفِكَر" নামে। পরবর্তীতে তার ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা লিখেন শায়খ আলি ইব্ন সুলতান আল-কারি (মৃ.১০১৪হি.), "شرح الشرح" নামে। তার ব্যাখ্যার অপর ব্যাখ্যাকার শায়খ মুহাম্মদ আকরাম নাসরপুরি সিন্ধি, তার কিতাবের নাম "إمعان النظر شرحُ شرحِ نخبة الفكر" ইবন হাজারের হাতে উসুলে হাদিস পরিপক্ব ও সংহত হয়, পরবর্তী আলেমগণ তার কিতাবের উপর অধিক নির্ভরশীল।
আমরা দেখলাম হাদিস প্রচার ও সংরক্ষণ পদ্ধতি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে ধীরেধীরে তার পরিধি বাড়তে থাকে। যখন যতটুকু প্রয়োজন ছিল, তখন ততটুকু অস্তিত্ব লাভ করে। নববী যুগ থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়ার সাথে আদর্শের পতন তরান্বিত হয়।[1] কখনো মিথ্যার প্রসার ঘটে, কখনো কুচক্রীরা অনুপ্রবেশ করে, কখনো বাতিল ফির্কার জন্ম হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশিত কথা, কর্ম, সমর্থন ও তার গুণগান যথাযথ সংরক্ষণ করার জন্য আলেমগণ ঘাম ঝরান। তারা বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করেন ও কঠোর নিয়ম মেনে চলেন। হাদিসের কিতাবগুলো রচনা সম্পন্ন হলে দীন বিপদ মুক্ত হয়। অতঃপর আরম্ভ হয় বিভিন্ন কিতাবে সংগৃহীত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করা। কোনো মুহাদ্দিসের শিথিলতা, কারো কঠোরতা এবং কারো মধ্যমপন্থা চিহ্নিত হয়। মুহাদ্দিসগণ সহি, হাসান, দা‘য়িফ ও জাল হাদিসসমূহ নির্ণয় করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিসগুলো পরখ করে সহি, দুর্বল ও জাল হাদিস নির্ণয় করার পদ্ধতিকে পরিভাষায় ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ বলা হয়।
এ পর্যন্ত হাদিস শাস্ত্রের দু’টি পদ্ধতি জানলাম: একটি "علم الرواية" অপরটি "علم الدراية"
‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কর্ম, সমর্থন, চারিত্রিক ও সৃষ্টিগত গুণগান, অনুরূপ সাহাবি ও তাবে‘ঈদের কথা ও কর্মের জ্ঞানার্জন করা, সূক্ষ্মভাবে সংরক্ষণ করা, যথাযথ অপরের নিকট পৌঁছানো ও তার শব্দগুলো পরিপূর্ণ আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সাথে লিপিবদ্ধ করা।
‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’: এমন কতক বিধান ও নীতিমালা, যার দ্বারা হাদিসের সনদ ও মতনের অবস্থা জানা যায় এবং তার উপর ভিত্তি করে সহি, হাসান, দুর্বল ও তার প্রকারসমূহ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। সনদের অবস্থার অর্থ ইত্তেসাল, ইনকেতা ও তাদলিস; উঁচু সনদ ও নিচু সনদ, রাবি দুর্বল না সেকাহ ইত্যাদি। মতনের অবস্থার অর্থ মারফূ‘, মাওকুফ, মাকতু, শায, মু‘আল্লাল, সহি, দ্বা‘ঈফ অথবা মনসুখ ইত্যাদি। হাদিসের ফিকহ তথা অর্থ জানা ও তার থেকে মাসআলা আবিষ্কার করা এ ইলমের অন্তর্ভুক্ত, কারণ হাদিসের অর্থ জানা মতনের একটি বিশেষ গুণ, যার উপর ভিত্তি করে ইল্লত ও মুখালিফাত জানা যায়।
‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ ও ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’-কে "علم مصطلح الحديث" বা শুধু "مصطلح الحديث" বলা হয়। অর্থাৎ যে শাস্ত্রে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ ও ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, সে শাস্ত্রকে ‘ইলমু মুসতালাহিল হাদিস’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’কে ‘ইলমু মুসতালাহিল হাদিস’ বলা হয়। ‘মুসতালাহুল হাদিসের’ অপর নাম "علم علوم الحديث" ‘ইলমু উলুমিল হাদিস’ বা "علم أصول الحديث" ‘ইলমু উসুলিল হাদিস’ বা শুধু "علم الحديث" ‘ইলমুল হাদিস’।
উসুলে হাদিস উম্মতে মুসলিমার বৈশিষ্ট্য, পূর্বের কোনো জাতির নিকট এ ইলম নেই। অসংখ্য হাফেযে হাদিস গুরুত্বের সাথে এ ইলম গ্রহণ করেন, রাবিদের জীবনী ও তাদের ভাল-মন্দ সংবাদ সংগ্রহ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবি ও তাদের অনুসারী তাবে‘ঈদের সাথে সম্পৃক্ত হাদিসগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধ চিহ্নিত করেন, যা একমাত্র এ উম্মতের গর্বের বস্তু। আল্লাহ এভাবে দীন হিফাজত করেন, যার ওয়াদা তিনি নিম্নের আয়াতে করেছেন:
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]
“নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই তার হিফাযতকারী”।[2] আল্লাহ তাআলার সরাসরি তত্ত্বাবধানে কুরআনুল কারিম সংরক্ষিত। আর তার তৌফিকপ্রাপ্ত একদল বান্দার তত্ত্বাবধানে হাদিস সংরক্ষিত।
" خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ".
“আমার যুগের মানুষেরা সর্বোত্তম, অতঃপর তাদের সাথে যারা মিলিত হবে, অতঃপর তাদের সাথে যারা মিলিত হবে”। বুখারি: (২৬৫২), মুসলিম: (২৫৩৫)
[2] সূরা হিজর: (৯)