১। পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। আর তা নিম্ন পদ্ধতিতে সম্ভব;
(ক) সেইরূপ ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই সে প্রাণত্যাগ করতে পারে।
(খ) যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো অস্ত্র দ্বারা হয় এবং তা খুবই শীঘ্রতা ও শক্তির সাথে যবেহস্থলে (গলায়) পোচানো হয়।
ফলকথা, পশুর বিনা কষ্টে খুবই শীঘ্রতার সাথে তার প্রাণ বধ করাই উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক বস্ত্তর উপর অনুগ্রহ লিপিবদ্ধ (জরুরী) করেছেন। সুতরাং যখন (জিহাদ বা হদ্দে) হত্যা কর তখন উত্তমরূপে অনুগ্রহের সাথে হত্যা কর এবং যখন যবেহ কর তখন উত্তমরূপে অনুগ্রহের সাথে যবেহ কর। তোমাদের উচিত, ছুরিকে ধারালো করা এবং বধ্য পশুকে আরাম দেওয়া।’’[1]
বধ্য পশুর সম্মুখেই ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মকরূহ)। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে।’’[2]
আর যেহেতু পশুর চোখের সামনেই ছুরি ধার দেওয়ায় তাকে চকিত করা হয়; যা বাঞ্ছিত অনুগ্রহ ও দয়াশীলতার প্রতিকূল।
তদনুরূপ এককে অপরের সামনে যবেহ করা এবং ছেঁচ্ড়ে যবেহস্থলে টেনে নিয়ে যাওয়াও মকরূহ।
২। কুরবানী যদি উঁট হয়, (অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়), তাহলে তাকে বাম পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘সুতরাং দন্ডায়মান অবস্থায় ওদের যবেহকালে তোমরা আল্লাহর নাম নাও।’’ (কুঃ ২২/৩৬)
ইবনে আববাস (রা.) এই আয়াতের তফসীরে বলেন, ‘বাম পা বেঁধে তিন পায়ের উপর দন্ডায়মান অবস্থায় (নহর করা হবে)।’[3]
যদি উঁট ছাড়া অন্য পশু হয় তাহলে তা বামকাতে শয়নাবস্থায় যবেহ করা হবে। যেহেতু তা সহজ এবং ডান হাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। তবে যদি যবেহকারী নেটা বা বেঁয়ো হয় তাহলে সে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে যবেহ করতে পারে। যেহেতু সহজ উপায়ে যবেহ করা ও পশুকে আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্য।
পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে যবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছন দিকে পা মুচ্ড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়।
৩। যবেহকালে পশুকে কেবলামুখে শয়ন করাতে হবে।[4] অন্যমুখে শুইয়েও যবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু কেবলামুখ করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজেব হওয়ার ব্যাপারে কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই।[5]
৪। যবেহকালে আল্লাহর নাম নেওয়া (‘বিসমিল্লাহ’ বলা) ওয়াজেব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘যদি তোমরা তাঁর নিদর্শনসমূহের বিশ্বাসী হও তবে যাতে (যে পশুর যবেহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা আহার কর।’’ (কুঃ ৬/১১৮) ‘‘এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার করো না; উহা অবশ্যই পাপ।’’ (কুঃ ৬/১২১)
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর।’’[6]
‘বিসমিল্লাহ’র সাথে ‘আল্লাহু আকবার’ যুক্ত করা মুস্তাহাব। অবশ্য এর সঙ্গে কবুল করার দুআ ছাড়া অন্য কিছু অতিরিক্ত করা বিধেয় নয়। অতএব (কুরবানী কেবল নিজের তরফ থেকে হলে) বলবে, ‘বিসমিল্লাহি অল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিন্কা অলাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী।’
নিজের এবং পরিবারের তরফ থেকে হলে বলবে,‘---তাক্বাববাল মিন্নী অমিন আহলে বাইতী।’ অপরের নামে হলে বলবে, ‘---তাক্বাববাল মিন (এখানে যার তরফ থেকে কুরবানী তার নাম নেবে)[7]
এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পাঠ করা বিধেয় নয়; বরং তা বিদআত।[8] যেমন ‘বিসমিল্লাহ’র সাথে ‘আর-রাহমানির রাহীম’ যোগ করাও সুন্নত নয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে কোন দলীল নেই। যেমন যবেহ করার লম্বা দুআ ‘ইন্নী অজ্জাহ্তু’ এর হাদীস যয়ীফ।[9]
যবেহর ঠিক অব্যবহিত পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ জরুরী। এর পর যদি লম্বা ব্যবধান পড়ে যায়, তাহলে পুনরায় তা ফিরিয়ে বলতে হবে। তবে ছুরি ইত্যাদি হাতে নিয়ে প্রস্ত্ততি নেওয়ায় যেটুকু ব্যবধান পড়ে তাতে ‘বিসমিল্লাহ’ ফিরিয়ে পড়তে হয় না।
আবার ‘বিসমিল্লাহ’ শুধু সেই পশুর জন্যই পরিগণিত হবে যাকে যবেহ করার সঙ্কল্প করা হয়েছে। অতএব এক পশুর জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে অপর পশু যবেহ বৈধ নয়। বরং অপরের জন্য পুনরায় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া জরুরী। অবশ্য ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পর অস্ত্র পরিবর্তন করাতে আর পুনরায় পড়তে হয় না।
প্রকাশ যে, যবেহর পর পঠনীয় কোন দুআ নেই।
৫। যবেহতে খুন বহা জরুরী। আর তা দুই শাহরগ (কন্ঠনালীর দুই পাশে দু’টি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যা খুন বহায়, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর। তবে যেন (যবেহ করার অস্ত্র) দাঁত বা নখ না হয়।’’[10]
সুতরাং রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরী; শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুই মোটা শিরা।
৬। প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। অনুরূপভাবে দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যেহেতু অন্যভাবে পশুকে কষ্ট দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।
পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা (হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে) চেপে রাখা যায়।
যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল রাখা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
যবাই করে ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবাই করা যায়। নতুবা কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। আর তা হালাল।
প্রকাশ থাকে যে, যবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা যবেহকারীকে পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যেমন মাথায় টুপী রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। অবশ্য বিশ্বাস ও ঈমানের পবিত্রতা জরুরী। সুতরাং কাফের, মুশরিক (মাযার বা কবরপূজারী) ও বেনামাযীর হাতে যবেহ শুদ্ধ নয়।
যেমন যবেহ করার আগে কুরবানীর পশুকে গোসল দেওয়া, তার খুর ও শিঙে তেল দেওয়া অথবা তার অন্য কোন প্রকার তোয়ায করা বিদআত।
প্রকাশ থাকে যে, যবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম। অতএব তা কোন ফল লাভের উদ্দেশ্যে পায়ে মাখা, দেওয়ালে ছাপ দেওয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি করে খেলা করা বৈধ নয়।
[2] (মুসনাদ আহমাদ ২/১০৮, ইবনে মাজাহ ৩১৭২নং, সহীহ তারগীব ১/৫২৯)
[3] (তাফসীর ইবনে কাষীর)
[4] (আবূ দাঊদ, ইবনে মাজাহ ২/১০৪৩, হাদীসটির সনদে সমালোচনা করা হয়েছে)
[5] (আহকামুল উযহিয়্যাহ ৮৮,৯৫পৃঃ)
[6] (বুখারী ২৩৫৬, মুসলিম ১৯৬৮নং)
[7] (মানাসিকুল হাজ্জ, আলবানী ৩৬পৃঃ)
[8] (আল-মুমতে ৭/৪৯২)
[9] (যয়ীফ আবূ দাঊদ ৫৯৭নং)
[10] (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি, সহীহুল জামে’ ৫৫৬৫নং)