কুরআন-হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, ৫ ওয়াক্ত ফরয সালাত যথাসময়ে আদায় করা মুমিনের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। সালাতই মুমিনের পরিচয় এবং ঈমান ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য। সালাত পরিত্যাগকারী ‘কাফিরদের দলভুক্ত’ বলে গণ্য হবে। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম সালাতেরই হিসাব গ্রহণ করা হবে। এভাবে অগণিত সহীহ হাদীস থেকে আমার ফরয সালাতের গুরুত্ব ও সালাতে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতি জানতে পারি।
কিন্তু সাধারণ মানুষদের অবাক করার জন্য জালিয়াতগণ এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সমাজে প্রচলিত অনেক গ্রন্থেই কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীসের পরিবর্তে এ সকল বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথাগুলো লেখা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের ক্যালেন্ডার, পোস্টার ইত্যাদিতেও এ সকল বানোয়াট কথাগুলি লিখে প্রচার করা হয়। এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ জাল হাদীস আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। এ জাল হাদীসটির সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ:
যে ব্যক্তি যথারীতি ও গুরুত্ব সহকারে নামায আদায় করবে আল্লাহ পাক তাকে পাঁচ প্রকারে সম্মানিত করবেন: রুজী রোজগার ও জীবনের সংকীর্ণতা হতে তাকে মুক্ত করবেন, তার উপর হতে কবরের আযাব উঠিয়ে দিবেন, কিয়ামতের দিন তার আমলনামা ডান হাতে দান করবেন, সে ব্যক্তি পুলসিরাতের উপর দিয়ে বিদ্যুতের মত পার হয়ে যাবে এবং বিনা হিসাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে অলসতা করে তাকে পনের প্রকারের শাস্তি দেওয়া হয়। তন্মধ্যে পাঁচ প্রকার দুনিয়াতে, তিন প্রকার মৃত্যুর সময় তিন প্রকার কবরে এবং তিন প্রকার কবর হতে বের হওয়ার পর। এ পনের বা চৌদ্দ প্রকারের শাস্তির বিস্তারিত বিবরণ প্রায় সকল প্রচলিত নামায শিক্ষা, আমলিয়াত ইত্যাদি বইয়ে পাওয়া যায়। এজন্য এ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথাগুলো লিখে বইয়ের কলেবর বাড়াচ্ছি না।
এ দীর্ঘ হাদীসটি পুরোটিই ভিত্তিহীন ও জাল। কোনো হাদীসগ্রন্থে এ হাদীসটি পাওয়া যায় না। পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম তাদের ওয়ায নসীহত মূলক গ্রন্থে অন্য সকল প্রচলিত কথার সাথে এই কথাগুলোও হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের ইমামগণ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন যে, এই কথাগুলো বাতিল ও জাল কথা। কোন্ ব্যক্তি এ জালিয়াতি করেছে তাও তাঁরা উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী, সয়ূতী, ইবনু আর্রাক প্রমুখ মুহাদ্দিস এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।[1]
শাইখুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্ধলভী (রাহ) তাঁর ‘ফাযায়েলে নামায’ গ্রন্থে এ জাল হাদীসটি আরবী ইবারত-সহ পুরোপুরি উল্লেখ করেছেন। তিনি হাদীসটি উল্লেখ করার আগে বলেছেন, কেউ কেউ বলেছেন, এ কথাটি নাকি হাদীসে আছে.... । হাদীসটি উল্লেখ করার পরে তিনি সংক্ষেপে বলেছেন যে, ইমাম যাহাবী, ইমাম সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটি জাল ও বাতিল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। এর সনদের জালিয়াতদের পরিচয়ও তাঁরা তুলে ধরেছেন।[2]
এভাবে আল্লামা যাকারিয়া (রাহ) হাদীসটির জালিয়াতির বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁর আমানত আদায় করেছেন। কিন্তু অনুবাদে এ আমানত রক্ষা করা হয় নি। আল্লামা যাকারিয়া (রাহ) -এর এ আলোচনা অনুবাদে উল্লেখ করা হয় নি। অনুবাদের শুরুতে বলা হয়েছে: ‘‘এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে..’’। শেষে শুধুমাত্র লেখা হয়েছে ‘যাওয়াজির ইবন হাজার মাক্কী (রাহ)’। এতে সাধারণ পাঠক একে নির্ভরযোগ্য হাদীস বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (ﷺ)-এর কথা বলেই বিশ্বাস করছেন। অথচ মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কোনো জাল হাদীসকে ‘জাল’ বলে উল্লেখ না করে ‘হাদীস’ বলে বর্ণনা করা কঠিন হারাম। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
[2] হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী, ফাযায়েলে আমল, পৃ. ১০৪-১০৮।