আমাদের দেশে অনেক ধার্মিক মুসলিম আযানের সময় ‘‘আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’’ বাক্যটি শুনলে দুই হাতের আঙুলে চুমু খেয়ে তা দিয়ে চোখ মুছেন। এ মর্মে একটি বানোয়াট ও মিথ্যা হাদীসকে সত্য মনে করেই তাঁরা এ কাজ করেন। এ বানোয়াট হাদীসটি বিভিন্ন ভাবে প্রচারিত। এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আযানের এ বাক্যটি শুনে নিজে মুখে বলবে:
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِالله رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ ﷺ نَبِيًّا
‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল, আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দীন হিসাবে ও মুহাম্মাদ ﷺ-কে নবী হিসাবে গ্রহণ করে’’, আর এ কথা বলার সাথে দু হাতের শাহাদত আঙ্গুলের ভিতরের দিক দিয়ে তার দু চক্ষু মুছবে তার জন্য শাফায়াত পাওনা হবে।
কেউ কেউ বলেন: আযানের এ বাক্যটি শুনলে মুখে বলবে:
مَرْحَباً بِحَبِيْبِيْ وَقُرَّةِ عَيْنِيْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ
‘‘মারহাবা! আমার প্রিয়তম ও আমার চোখের শান্তি মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহকে’’, এরপর তার বৃদ্ধাঙ্গলিদ্বয়কে চুমু খাবে এবং উভয়কে তার দু চোখের উপর রাখবে। যদি কেউ এরূপ করে তবে কখনো তার চোখ উঠবে না বা চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হবে না।
এ জাতীয় সকল কথাই বানোয়াট। কেউ কেউ এ সকল কথা আবু বাক্র (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। মোল্লা আলী কারী বলেন, ‘‘আবু বাক্র (রা) থেকে বর্ণনা প্রমাণিত হলে তা আমল করার জন্য যথেষ্ট হবে।’’ তবে হাদীসটি আবু বাকর (রা) থেকেও প্রমাণিত নয়। ইমাম সাখাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মোল্লা আলী কারীর বক্তবব্যের টীকায় বর্তমান যুগের অন্যতম হানাফী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও সুফী আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ লিখেছেন, তাঁর উস্তাদ ও প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ যাহিদ কাওসারীর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মোল্লা আলী কারী এ বিষয়ে ইমাম সাখাবীর বিস্তারিত আলোচনা জানতে পারেন নি। ফলে তার মনে দ্বিধা ছিল। প্রকৃত বিষয় হলো, আবু বাকর (রা) বা অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটির কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় নি। মুহাদ্দিসগণ একমত হয়েছেন যে, এ বিষয়ক সকল বর্ণনা বানোয়াট।[1]
এখানে তিনটি বিষয় লক্ষ্যণীয়:
(১) রোগমুক্তি, সুস্থতা ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ‘আমল’ অনেক সময় অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রহণ করা হয়। এজন্য এ প্রকারের ‘আমল’ করে ফল পাওয়ার অর্থ এটাই নয় যে, এগুলো হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কেউ রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে কোনো শরীয়ত সম্মত আমল করতে পারেন। তবে বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া এরূপ ‘আমল’-কে হাদীস বলা যায় না।
(২) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মহববত করা ঈমানের অংশ ও অত্যন্ত বড় নেককর্ম। যদি কেউ এ জাল হাদীসটির জালিয়াতি অবগত না হওয়ার কারণে এর উপর আমল করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নাম শুনে হৃদয়ে মহববত ও ভালবাসা নিয়ে এভাবে আঙুলে চুমু খান, তবে তিনি এ জাল হাদীসে বর্ণিত সাওয়াব না পেলেও, মূল মহববতের সাওয়াব পাবেন, ইনশা আল্লাহ। তবে জেনেশুনে জাল হাদীসের উপর আমল করা জায়েয নয়।
(৩) এ জাল হাদীসের পরিবর্তে মুমিন একটি সহীহ হাদীসের উপর আমল করতে পারেন। দু হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ মুছার বিষয়টি বানোয়াট হলেও উপরের বাক্যগুলো মুখে বলার বিষয়ে অত্যন্ত বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘‘যদি কেউ মুআযযিনকে শুনে বলে:
أَشْهَدُ (وَأَنَا أَشْهَدُ) أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَحْدهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِالله رَبًّا وَبِمُحَمَّدٍ ﷺ رَسُوْلاً وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا
‘‘এবং আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি তুষ্ট ও সন্তুষ্ট আছি আল্লাহকে প্রভু হিসেবে, ইসলামকে দীন হিসেবে এবং মুvহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবী হিসেবে।’’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যদি কেউ এভাবে উপরের বাক্যগুলো বলে, তবে তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।’’[2]
[2] মুসলিম১/২৯০, নং ৩৮৬, ইবনু খুযাইমাহ ১/২২০, ইবনু হিববান ৪/৫৯১।