হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকহ, ওয়ায, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারণত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতা বশত ধারণা করেন যে, এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয় যাচাই বাছাই করে হাদীসগুলো লিখেছেন। সহীহ না হলে কি আর তিনি হাদীসটি লিখতেন?
এ ধারণাটিও ভিত্তিহীন, ভুল এবং উপরের ধারণাটির চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর। সাধারণত প্রত্যেক ইল্মের জন্য পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত বেশি সময় দিতে পারেন না। মুফাস্সির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সূফী, ওয়ায়িয ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদীসের নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনার গভীরতায় যেতে পারেন না। সাধারণভাবে তাঁরা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ, জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপরে নির্ভর করেন। এজন্য তাঁদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন, সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
আল্লামা নাবাবী তাঁর ‘‘তাকরীব’’ গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ূতী তাঁর ‘‘তাদরীবুর রাবী’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীস বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোনো কোনো মুফাসসির, যেমন - আল্লামা আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম আস সা’লাবী নিশাপূরী (৪২৭ হি.) তাঁর ‘‘তাফসীর’’ গ্রন্থে, তাঁর ছাত্র আল্লামা আলী ইবন আহমাদ আল-ওয়াহিদী নিশাপূরী (৪৬৮ হি.) তাঁর ‘‘বাসীত’’, ‘‘ওয়াসিত’’, ‘‘ওয়াজীয’’ ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাসেম মাহমূদ ইবন উমার আয-যামাখশারী (৫৩৮ হি.) তাঁর ‘‘কাশ্শাফ’’ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবন উমার আল-বাইযাবী (৬৮৫ হি.) তাঁর ‘‘আনওয়ারুত তানযীল’’ বা ‘‘তাফসীরে বাইযাবী’’ গ্রন্থে এসকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এ কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ূতী বলেন : ‘‘ইরাকী (৮০৬ হি.) বলেছেন যে, প্রথম দুজন - সা’লাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখপূর্বক এসকল বানোয়াট বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। ফলে তাঁদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারণ তাঁরা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মাওযূ বা মিথ্যা হাদীস সনদসহ উল্লেখ করলেও সাথে সাথে তাকে ‘মাওযূ’ না বলে চুপ করে যাওয়া জায়েয নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন - যামাখশারী ও বাইযাবী-এর ভুল খুবই মারাত্মক। কারণ, তাঁরা সনদ উল্লেখ করেন নি, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে সরাসরি সুস্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট কথা উল্লেখ করেছেন।[1]
৪র্থ হিজরী শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও বুজুর্গ শাইখ আবূ তালিব মাক্কী মুহাম্মাদ ইবন আলী (৩৬৮হি)। তাঁর রচিত ‘কুতুল কুলূব’ বা ‘হৃদয়ের খোরাক’ বইটি তাসাউফের জগতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধতম আলিম ও সূফী হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবূ হামিদ গাযালী মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ (৫০৫ হি)। তাঁর রচিত ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থটি মুসলিম জগতের প্রসিদ্ধতম গ্রন্থগুলির অন্যতম। তাঁদের বুজুর্গি এবং তাঁদের গ্রন্থগুলির প্রতি শ্রদ্ধা-সহ উম্মাতের আলিমগণ এগুলির মধ্যে বিদ্যমান জাল হাদীসগুলি চিহ্নিত করেছেন। মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) এ সকল গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন: ‘‘কুতুল কুলুব, এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন, তাফসীরে সা’লাবী ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ আছে দেখে ধোঁকা খাবেন না।[2]
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী ফিক্হের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলির নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্লেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপারে। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরূপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলোর উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন, কিন্তু সেগুলো জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ‘ফাতওয়া’ বিষয়ক পুস্তকাদি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সকল পুস্তকের লেখকগণ যদিও ‘কামিল’ ছিলেন, তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অসতর্ক ছিলেন।’’[3]
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিক্হ, তাফসীর, তাসাঊফ, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লিখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নিরীক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবন আবু বকর আল-মারগীনানী (৫৯৩ হি.) তাঁর লেখা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘‘হেদায়া’’-য় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসাবে ফিকহী মাসায়েল নির্ধারণ ও বর্ণনার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোনো হাদীসের সহীহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে যান নি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবন ইউসূফ যাইলায়ী হানাফী (৭৬২ হি.), আল্লামা আহমাদ ইবন আলী ইবন হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.) প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদীস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষণা করে এর মধ্যথেকে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস নির্ধারণ করেছেন।
অনুরূপভাবে ইমাম গাযালী এহ্ইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে ফিক্হ ও তাসাউফ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকীহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেন না। এজন্য হাদীসের সনদের বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদ্ল আব্দুর রহীম ইবন হুসাইন আল-ইরাকী (৮০৬ হি.) ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাঁর উল্লিখিত হাদীসসমূহের সনদ-ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণ করে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসগুলো নির্ধারণ করেছেন । এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু আলী সুবকী (৭৭১ হি) ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে উল্লেখিত কয়েক শত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম ‘আল-আহাদীস আল্লাতী লা আস্লা লাহা ফী কিতাবিল এহইয়া’, অর্থাৎ ‘এহইয়া.. গ্রন্থে উল্লিখিত ভিত্তিহীন হাদীসসমূহ’।
[2] মোললা আলী কারী, আল-আসরারুল মারফুয়া, পৃ: ২৮৯।
[3] আব্দুল হাই লাখনবী, আন-নাফি আল-কাবীর, পৃ. ১২-১৩।