অজ্ঞতাবশত অনেকে মনে করেন যে, কোনো হাদীস কোনো হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহীহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহীহ। যেমন কোনো হাদীস যদি সুনানু ইবনি মাজাহ বা মুসান্নাফু আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো হাদীসটি নিশ্চয় সহীহ, নইলে ইবনু মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মত অত বড় মুহাদ্দিস তা গ্রহণ করলেন কেন? অন্তত, ইবনু মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মতে হাদীসটি সহীহ, নইলে তিনি তাঁর গ্রন্থে হাদীসটির স্থান দিতেন না।
আমরা দেখেছি যে, এ ধারণাটির উভয় দিকই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দিসই তাঁদের গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ সকল প্রকার হাদীসই সংকলন করেছেন। তাঁরা কখনোই দাবি করেন নি বা পরিকল্পনাও করেন নি যে, তাঁদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করবেন। আর যারা সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেছেন তাদের দাবিও মুহাদ্দিসগণ যাচাই না করে গ্রহণ করেন নি।
অধিকাংশ হাদীসগ্রন্থের মধ্যেই সহীহ, যয়ীফ, জাল ও বাতিল হাদীস বিদ্যমান; কারণ মুহাদ্দিসগণের উদ্দেশ্য ছিল সনদ-সহ সকল কথিত বিষয় সংকলন করা। ৯ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২হি) চতুর্থ শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম তাবারানীর (৩৬০হি) গ্রন্থগুলির মধ্যে বিদ্যমান অনেক জাল ও বাতিল হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন:
وهذا أمر لا يختص به الطبراني فلا معنى لإفراده باللوم، بل أكثر المحدثين في الأعصار الماضية من سنة مائتين وهلم جرا إذا ساقوا الحديث بإسناده اعتقدوا أنهم برؤا من عهدته
‘‘এটি তাবারানীর একক বিষয় নয় এবং এ বিষয়ে তাকে পৃথকভাবে দোষ দেওয়ার কিছু নেই; দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী যুগগুলির অধিকাংশ মুহাদ্দিস মনে করতেন যে, সনদ-সহ হাদীস উল্লেখ করলেই দায়িত্ব পালিত হয়ে গেল এবং তাঁরা যিম্মাদারি থেকে মুক্ত হলেন।’’[1]
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবীকে প্রশ্ন করা হয়: ‘‘সুনান চতুষ্ঠয়: নাসাঈ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনু মাজাহ, বাইহাকীর লিখিত গ্রন্থসমূহ, দারাকুতনীর লিখিত গ্রন্থসমূহ, হাকিম, ইবনু আবী শাইবা, ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ ও বিশাল বিশাল হাদীসের গ্রন্থসমূহের হাদীসগুলি কি সহীহ? ... না কি হাসান ...? নাকি অন্য কিছু?’’ উত্তরে তিনি বলেন:
ليس كل ما في هذه الكتب وأمثالها صحيحاً أو حسناً، بل هي مشتملة على الأخبار الصحيحة والحسنة والضعيفة والموضوعة.
‘‘এ সকল গ্রন্থে এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে সংকলিত সকল হাদীস সহীহ বা হাসান নয়; বরং এ সকল গ্রন্থের মধ্যে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকারের হাদীস বিদ্যমান।’’[2]
এরপর তিনি সুদীর্ঘ আলোচনায় প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজুর্গগণের অনেক উদ্ধৃতি ও বিশ্লেষণ উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, তাঁরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, এ সকল গ্রন্থের মধ্যে অনেক সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ ও জাল হাদীস বিদ্যমান। কাজেই সনদ বিচারে জাল প্রমাণিত হলে তাকে গ্রন্থকারের মর্যাদার অযুহাতে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ বা অনুমতি কোনো মুহাদ্দিস, ফকীহ বা বুজুর্গ দেন নি।[3]
আমাদের সমাজে ‘সিহাহ সিত্তাহ’[4] নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২টি সহীহ গ্রন্থ: ‘‘সহীহ বুখারী’’ ও ‘‘সহীহ মুসলিম’’ ছাড়া বাকি ৪টির সংকলকও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁরা তাঁদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক দুর্বল বা বানোয়াট হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাঁদের গ্রন্থগুলোর অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে তাঁদের গ্রন্থগুলোর উপর নির্ভর করেছেন, সাথে সাথে তাঁরা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রদান করেছেন। আমরা দেখলাম যে, আব্দুল হাই লাখনবী সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, এ চারটি গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও বানোয়াট সকল প্রকারের হাদীস রয়েছে।
ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহর বিবরণ দেখেছি। তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী: এ তিনটি গ্রন্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন, যে সকল গ্রন্থের হাদীসসমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি ‘সুনান ইবন মাজাহ’-কে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেন নি। এর কারণ হলো, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযিদ ইবনু মাজাহ আল-কাযবীনী (২৭৫ হি) সংকলিত ‘সুনান’ গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণযোগ্য গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত করেন নি। হিজরী ৭ম শতক পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অতিরিক্ত এ তিনটি সুনানগ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু তাহির মাকদিসী, আবুল ফাদল ইবনুল কাইসুরানী (৫০৭ হি) এগুলোর সাথে সুনান ইবন মাজাহ যোগ করেন।
তাঁর এ মত পরবর্তী ২ শতাব্দী পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেন নি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রাহমান (৬৪৩ হি), আল্লামা আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসাবে উপরের ৫টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনান ইবন মাজাহ-কে তাঁরা এগুলোর মধ্যে গণ্য করেন নি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কিক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মাদ (৬০৬ হি) ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে ইমাম মালিকের মুআত্তাকে গণ্য করেছেন।
সুনান ইবন মাজাহকে উপরের ৩টি সুনানের পর্যায়ভুক্ত করতে আপত্তির কারণ হলো ইমাম ইবনু মাজাহর সংকলন পদ্ধতি এ তিন গ্রন্থের মত নয়। উপরের তিন গ্রন্থের সংকলক মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। বিষয়বস্তের প্রয়োজনে কিছু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে ইবনু মাজাহ তৎকালীন সাধারণ সংকলন পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, এসকল যুগের অধিকাংশ সংকলক সনদসহ প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করতেন। এতে সহীহ, যয়ীফ, মাউদূ সব প্রকারের হাদীসই তাঁদের গ্রন্থে স্থান পেত। সনদ বিচার ছাড়া হাদীসের নির্ভরতা যাচাই করা সম্ভব হতো না। ইবনু মাজাহও এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সহীহ বা হাসান হাদীস সংকলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। তিনি সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ ও কিছু মাউযূ হাদীসও সংকলন করেছেন। তিনি এসকল যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসের ক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করেন নি।
৮ম হিজরী শতক থেকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস সুনান ইবনি মাজাহকে ৪র্থ সুনানগ্রন্থ হিসাবে গণ্য করতে থাকেন। মুআত্তা ও সুনান ইবনি মাজাহর মধ্যে পার্থক্য হলো, মুআত্তা গ্রন্থের হাদীস সংখ্য কম এবং এ গ্রন্থের সকল সহীহ হাদীস উপরের ৫ গ্রন্থের মধ্যে সংকলিত। ফলে এ গ্রন্থটিকে পৃথকভাবে অধ্যয়ন করলে অতিরিক্ত হাদীস জানা যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে সুনান ইবন মাজাহর মধ্যে উপরের ৫ টি গ্রন্থের অতিরিক্ত সহস্রাধিক হাদীস রয়েছে। এজন্য পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ এ গ্রন্থটিকে ৪র্থ সুনান হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনু মাজাহর সুনান গ্রন্থে মোট ৪৩৪১টি হাদীস সংকলিত। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাঁচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী প্রায় দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমাদ ইবনু আবী বাকর আল-বূসীরী (৮৪০ হি) ইবনু মাজাহর এসকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বূসীরী ১৪৭৬টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন, যেগুলো উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয় নি, শুধুমাত্র ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় একতৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।[5]
[2] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আজবিবাতুল ফাদিলাহ, পৃ. ৬৬।
[3] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আজবিবাতুল ফাদিলাহ, পৃ. ৬৬-১১৭।
[4] ‘সিহাহ সিত্তা’ পরিভাষাটি ভারতীয় ব্যবহার। এই ৬ টি গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা সুপরিচিত। তবে গ্রন্থগুলি ‘সহীহ’ নয়। বরং ২টি গ্রন্থ সহীহ ও বাকিগুলি সুনান। এজন্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সুপরিচিত পরিভাষা হলো ‘আল-কুতুবুস সিত্তা’ ‘পুস্তক ছয়টি’। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও ‘সিহাহ সিত্তা’ পরিভাষাটি প্রচলিত নয়।
[5] ইবনুল কাইসুরানী, আবুল ফাদল মুহাম্মাদ ইবনু তাহির (৫০৭ হি), শুরুতুল আইম্মাহ আস-সিত্তাহ পৃ: ১৩, ২৪-২৬; বুসীরী, আহমাদ ইবনু আবী বাকর (৮৪০ হি), যাওয়াইদ ইবনি মাজাহ, কাত্তানী, আর-রিসালাহ আল-মুসতাতরাফাহ, পৃ: ১২-১৩।