আবু হুরাইরা (রা) একজন সাহাবী। অনেক তাবিয়ী তাঁর কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করেছেন। এদের মধ্যে কেউ দীর্ঘদিন এবং কেউ অল্প দিন তাঁর সাথে থেকেছেন। কোনো সাহাবী বা মুহাদ্দিস একেক ছাত্রকে একেকটি হাদীস শিখাতেন না। তাঁরা তাঁদের কাছে সংগৃহীত হাদীসগুলো সকল ছাত্রকেই শিক্ষা দিতেন। ফলে সাধারণভাবে আবূ হুরাইরা (রা) বর্ণিত সকল হাদীসই তাঁর অধিকাংশ ছাত্র শুনেছেন। তাঁরা একই হাদীস আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ আবু হুরাইরার (রা) সকল ছাত্রের বর্ণিত হাদীস সংগ্রহ ও সংকলিত করে সেগুলো পরস্পরের সাথে মিলিয়ে নিরীক্ষা করেছেন।
যদি দেখা যায় যে, ৩০ জন তাবিয়ী একটি হাদীস আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করছেন, তন্মধ্যে ২০/২৫ জনের হাদীসের শব্দ একই প্রকার কিন্তু বাকী ৫/১০ জনের শব্দ অন্য রকম, তবে বুঝা যাবে যে, প্রথম ২০/২৫ জন হাদীসটি আবূ হুরাইরা যে শব্দে বলেছেন হুবহু সে শব্দে মুখস্থ ও লিপিবদ্ধ করেছেন। আর বাকী কয়জন হাদীসটি ভালভাবে মুখস্থ রাখতে পারেন নি। এতে তাদের মুখস্থ ও ধারণ শক্তির দুর্বলতা প্রমাণিত হলো।
যদি আবূ হুরাইরার (রা) কোনো ছাত্র তাঁর কাছ থেকে ১০০ টি হাদীস শিক্ষা করে বর্ণনা করেন এবং তন্মধ্যে সবগুলো বা অধিকাংশ হাদীস তিনি হুবহু মুখস্থ রেখে বিশুদ্ধ ভাবে বর্ণনা করতে পারেন তাহলে তা তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। অপরদিকে যদি এরূপ কোনো তাবিয়ী ১০০ টি হাদীসের মধ্যে অধিকাংশ হাদীসই এমন ভাবে বর্ণনা করেন যে, তার বর্ণনা অন্যান্য তাবিয়ীর বর্ণনার সাথে মেলে না তাহলে বুঝা যাবে যে তিনি হাদীস ঠিকমত লিখতেন না ও মুখস্থ রাখতে পারতেন না। এ বর্ণনাকারী তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। তিনি ‘‘যয়ীফ’’ বা দুর্বল রাবী হিসাবে চিহ্নিত হন।
ভুলের পরিমাণ ও প্রকারের উপর নির্ভর করে তার দুর্বলতার মাত্রা বুঝা যায়। যদি তার কর্মজীবন ও তার বর্ণিত এ সকল উল্টো পাল্টা হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হতো যে তিনি ইচ্ছা পূর্বক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশি কম করেছেন অথবা ইচ্ছাপূর্বক হাদীসের নামে বানোয়াট কথা বলেছেন তাহলে তাকে ‘‘মিথ্যাবাদী’’ রাবী বলে চিহ্নিত করা হতো। যে হাদীস শুধুমাত্র এই ধরনের ‘‘মিথ্যাবাদী’’ বর্ণনাকারী একাই বর্ণনা করেছেন সে হাদীসকে কোন অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে গ্রহণ করা হতো না। বরং তাকে ‘‘মিথ্যা’’ বা ‘‘মাউযূ’’ হাদীস রূপে চিহ্নিত করা হতো।
অনেক সময় দেখা যায় যে, আবূ হুরাইরার (রা) কোন ছাত্র এমন একটি বা একাধিক হাদীস বলছেন যা অন্য কোন ছাত্র বলছেন না। এক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ উপরের নিয়মে নিরীক্ষা করেছেন। যদি দেখা যায় যে, উক্ত তাবিয়ী ছাত্র আবূ হুরাইরার সাহচর্যে অন্যদের চেয়ে বেশি ছিলেন, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীস তিনি সঠিকভাবে হুবহু লিপিবদ্ধ ও মুখস্থ রাখতেন বলে নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর সততা ও ধার্মিকতা সবাই স্বীকার করেছেন, সে ক্ষেত্রে তার বর্ণিত অতিরিক্ত হাদীসগুলোকে সহীহ (বিশুদ্ধ) বা হাসান (সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য) হাদীস হিসাবে গ্রহণ করা হতো।
আর যদি উপরোক্ত তুলনামূলক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হতো যে তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে অধিকাংশ হাদীস বা অনেক হাদীস গ্রহণযোগ্য রাবীদের বর্ণনার সাথে কমবেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ তবে তার বর্ণিত এ অতিরিক্ত হাদীসটিও উপরের নিয়মে দুর্বল বা মিথ্যা হাদীস হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
সাধারণত একজন তাবিয়ী একজন সাহাবী থেকেই হাদীস শিখতেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক তাবিয়ী চেষ্টা করতেন যথা সম্ভব বেশি সাহাবীর কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করতে। এজন্য তাঁরা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের যে শহরেই কোনো সাহাবী বাস করতেন সেখানেই গমন করতেন । মুহাদ্দিসগণ উপরের নিয়মে সকল সাহাবীর হাদীস, তাদের থেকে সকল তাবিয়ীর হাদীস, তাঁদের থেকে বর্ণিত তাবে-তাবিয়ীগণের হাদীস একত্রিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে ও বর্ণনাকারীগণের ব্যক্তিগত জীবন, সততা, ধার্মিকতা ইত্যাদির আলোকে হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপন করতেন।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এ ধারা অব্যহত থাকে। একদিকে মুহাদ্দিসগণ সনদসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে কথিত সকল হাদীস সংকলিত করেছেন। অপরদিকে ‘রাবী’গণের বর্ণনার তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাদের বর্ণনার সত্যাসত্য নির্ধারণ করে তা লিপিবদ্ধ করেছেন।[1]
ইমাম তিরমিযী আবু ইসা মুহাম্মাদ ইবনু ইসা (২৭৫ হি) বলেন, আমাদেরকে আলী ইবনু হুজর বলেছেন, আমাদেরকে হাফস ইবনু সুলাইমান বলেছেন, তিনি কাসীর ইবনু যাযান থেকে, তিনি আসিম ইবনু দামুরাহ থেকে, তিনি আলী ইবনু আবী তালিব থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَاسْتَظْهَرَهُ فَأَحَلَّ حَلالَهُ وَحَرَّمَ حَرَامَهُ أَدْخَلَهُ اللهُ بِهِ الْجَنَّةَ وَشَفَّعَهُ فِي عَشْرَةٍ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ كُلُّهُمْ قَدْ وَجَبَتْ لَهُ النَّارُ
‘‘যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, মুখস্থ করবে, কুরআনের হালালকে হালাল হিসেবে পালন করবে ও হারামকে হারাম হিসেবে বর্জন করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের দশ ব্যক্তির বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।’’[2]
হাদীসটি এভাবে সংকলিত করার পরে ইমাম তিরমিযী হাদীসটির দুর্বলতা ও অগ্রহণযোগ্যতার কথা উল্লেখ করে বলেন:
هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لا نَعْرِفُهُ إِلا مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَلَيْسَ إِسْنَادُهُ بِصَحِيحٍ وَحَفْصُ بْنُ سُلَيْمَانَ يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ
এ হাদীসটি ‘‘গরীব’’। এ একটিমাত্র সূত্র ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটি জানা যায় না। এর সনদ সহীহ নয়। হাফস ইবনু সুলাইমান (১৮০ হি) হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল।
তিরমিযীর এ মতামত তাঁর ও দীর্ঘ তিন শতকের অগণিত মুহাদ্দিসের নিরীক্ষার ভিত্তিতে প্রদত্ত। তাঁদের নিরীক্ষার সংক্ষিপ্ত পর্যায়গুলো নিম্নরূপ:
- তাঁরা হাফস ইবনু সুলাইমান বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন।
- হাফস যে সকল শিক্ষকের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের অন্যান্য ছাত্র বা হাফসের ‘সহপাঠী’ রাবীদের বর্ণনা সংগ্রহ করে তাঁদের বর্ণনার সাথে তার বর্ণনার তুলনা করেছেন।
- এ হাদীসে হাফসের উস্তাদ কাসীর ইবনু যাযানের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করে হাফসের বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন।
- কাসীরের উস্তাদ আসিম ইবনু দামুরাহ বর্ণিত সকল হাদীস তার অন্যান্য ছাত্রদের সূত্রে সংগ্রহ করে হাফসের এ বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন।
- আলী (রা) এর অন্যান্য ছাত্রদের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করে তুলনা করেছেন।
- আলী (রা) ছাড়া অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীসের সাথে এ বর্ণনার তুলনা করেছেন।
এ নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেন:
ক. এ হাদীসটি এ একটিমাত্র সূত্র ছাড়া কোনো সূত্রে বর্ণিত হয় নি। অন্য কোনো সাহাবী থেকে কেউ বর্ণনা করেন নি। আলী (রা)-এর অন্য কোনো ছাত্র হাদীসটি তাঁর থেকে বর্ণনা করেন নি। আসিমের অন্য কোনো ছাত্র তা তাঁর থেকে বর্ণনা করেন নি। কাসীরের অন্য কোনো ছাত্র তা বর্ণনা করেন নি। এভাবে তাঁরা দেখেছেন যে, দ্বিতীয় হিজরীর শেষ প্রান্তে এসে হাফস ইবনু সুলাইমান দাবী করছেন যে, এ হাদীসটি তিনি এ সূত্রে শুনেছেন। তাঁর দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য কোনো ‘সাক্ষী’ পাওয়া গেল না।
খ. এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাদীসটি গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। কারণ সাধারণভাবে এরূপ ঘটে না যে, আলী (রা) বর্ণিত একটি হাদীস তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আসিম ছাড়া কেউ জানবেন না। আবার আসিম একটি হাদীস শেখাবেন তা একমাত্র যাযান ছাড়া কেউ জানবেন না। আবার যাযান একটি হাদীস শেখাবেন তা হাফস ছাড়া কেউ জানবেন না।
গ. এখন দেখতে হবে যে, হাফস বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের অবস্থা কী? মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, হাফস তার উস্তাদ যাযান এবং অন্যান্য সকল উস্তাদের সূত্রে যত হাদীস বর্ণনা করেছেন প্রায় সবই ভুলে ভরা। এজন্য তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, হাফস যদিও কুরআনের বড় কারী ও আলিম ছিলেন, কিন্তু তিনি হাদীস বর্ণনায় ‘দুর্বল’ ছিলেন। তিনি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না বললেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল করতেন খুব বেশি। এজন্য তাঁরা তাকে ‘দুর্বল’ ও ‘পরিত্যক্ত’ বলে গণ্য করেছেন।[3]
হাদীস বর্ণনাকারী বা ‘রাবী’র বর্ণনার যথার্থতা নির্ণয়ের এ সুক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনেকেই বুঝতে পারেন না। ফলে মুহাদ্দিস যখন কোনো ‘রাবী’ বা হাদীসের বিষয়ে বিধান প্রদান করেন তখন তাঁরা অবাক হয়েছেন বা আপত্তি করেছেন। কেউ বলেছেন: এ হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা বিচারের ধৃষ্টতা। কেউ বলেছেন: এ হলো অকারণে, না জেনে বা আন্দাজে নেককার মানুষদের সমালোচনা। বর্তমান যুগেই নয়, ইসলামের প্রথম যুগগুলোতেও অনেক মানুষ এ প্রকারের ধারণা পোষণ করতেন।[4]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, ‘রাবী’ ও ‘হাদীসের’ সমালোচনায় হাদীসের ইমামগণের সকল বিধান ও হাদীস বিষয়ক মতামত এ নিরীক্ষার ভিত্তিতে। কোনো মুহাদ্দিস যখন কোনো রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেন যে, তিনি (ثقة، ضابط، حافظ، صدوق، لا بأس به، ضعيف، كثير الوهم، منكر الحديث، متروك، كذاب، وضاع): নির্ভরযোগ্য, পরিপূর্ণ মুখস্থকারী, মুখস্থকারী, সত্যপরায়ণ, চলনসই, দুর্বল, অনেক ভুল করেন, আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী, হাদীস বানোয়াটকারী ইত্যাদি তখন বুঝতে হবে যে, তাঁর এ ‘সংক্ষিপ্ত মতামতটি’ তাঁর আজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম, হাদীস সংগ্রহ ও তুলনামূলক নিরীক্ষার ফল।
অনুরূপভাবে যখন তিনি কোনো হাদীসের বিষয়ে বলেন:
صحيح، ضعيف، منكر، موضوع، مرسل، الصحيح وَقْفُهُ...
হাদীসটি সহীহ, যয়ীফ, আপত্তিকর, বানোয়াট, মুরসাল, সহীহ হলো যে হাদীসটি সাহাবীর বাণী... ইত্যাদি তাহলেও আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি তাঁর আজীবনের সাধনার নির্যাস আমাদেরকে দান করলেন।
এভাবে আমরা মুহাদ্দিসগণের কর্মধারা সম্পর্কে জানতে পারছি। এবার আমরা এ কর্মধারার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো আলোচনা করব।
[2] তিরমিযী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা (২৭৫ হি), আস-সুনান ৫/১৭১।
[3] ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/৩৪৫; তাকরীবুত তাহযীব পৃ: ১৭২।
[4] মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আত-তাময়ীয, পৃ ১৬৯।