হাদীসের নামে জালিয়াতি ৪. জালিয়াতি প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

উপরের আলোচনা থেকে আমরা সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাই যে, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, অনুধাবনগত বা অসাবধানতাজনিত সকল প্রকার মিথ্যা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসকে নির্ভেজালভাবে সংরক্ষণের জন্য সাহাবীগণ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তা একদিকে যেমন যৌক্তিক, প্রায়োগিক, বৈজ্ঞানিক ও সুক্ষ্ম, অন্যদিকে তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একক ও অনন্য। অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীগণ তাঁদের ধর্মের মূল শিক্ষা বা ওহী সংরক্ষণের জন্য এরূপ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। যা প্রচারিত হয়েছে তাই সংকলিত করা হয়েছে। অবশেষে ওহীর সাথে মানবীয় জ্ঞানের মিশ্রণের মাধ্যমে ওহীর বিকৃতি ও অবলুপ্তি ঘটেছে।

তাবিয়ীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সাহাবীগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আপোষহীন ছিলেন। তাঁরা হাদীসের সংরক্ষণ এবং বানোয়াট কথা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসের বাছাই-এর জন্য তাঁদের জীবনের সকল আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করেছেন। এ পরিচ্ছেদে আমরা সংক্ষেপে তাঁদের মূলনীতিগুলো আলোচনা করব।

৪. ১. হাদীস শিক্ষা ও সংরক্ষণ

মহান আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রথম যুগের মানুষদেরকে তাঁর মহান রাসূল ()-এর হাদীস সংরক্ষণের বিষয়ে একটি সঠিক ও সময়োপযোগী কর্মের তাওফীক প্রদান করেন। প্রথম হিজরী শতক থেকে সাহাবী, তাবিয়ী ও তৎপরবর্তী যুগের আলিমগণ মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি গ্রামগঞ্জ, শহর ও জনপদ ঘুরে ঘুরে সকল হাদীস ও বর্ণনাকারীগণের তথ্যাদি সংগ্রহ করতেন। হাদীস শিক্ষা, লিখে রাখা, শেখানো ও হাদীস কেন্দ্রিক আলোচনাই ছিল ইসলামের প্রথম তিন-চার শতকের মানুষদের অন্যতম কর্ম, পেশা, নেশা ও আনন্দ।

তাবিয়ীগণের যুগ থেকে বা হিজরী প্রথম শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালে আমরা দেখতে পাই যে, হাদীস বর্ণনাকারীগণ দুই প্রকারের :

অনেকে নিজ এলাকার ‘রাবী’ বা মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে এবং সম্ভব হলে অন্যান্য কিছু দেশের কিছু মুহাদ্দিসের কাছে হাদীস শিক্ষা করেছেন। এরপর তিনি হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষায় রত থেকেছেন। তাঁর কাছে যে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছে তাঁকে সে হাদীসগুলো শিক্ষা দিয়েছেন। এরা সাধারণভাবে ‘রাবী’ বা বর্ণনাকারী নামে পরিচিত।

অপরদিকে এ যুগগুলোতে অনেক মুহাদ্দিস নিজ এলাকার সকল ‘রাবী’র কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা ও লিপিবদ্ধ করার পরে বেরিয়ে পড়েছেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি জনপদ সফর করতে। তাঁরা প্রত্যেকে দীর্ঘ কয়েক বছর বা কয়েক যুগ এভাবে প্রতিটি জনপদে গমন করে সকল জনপদের সকল ‘রাবী’ বা মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন। একজন সাহাবীর বা একজন তাবিয়ীর একটিমাত্র হাদীস বিভিন্ন ‘রাবী’র মুখ থেকে শুনতে ও সংগ্রহ করতে তাঁরা মক্কা, মদীনা, খোরাসান, সমরকন্দ, মারভ, ওয়াসিত, বাসরা, কূফা, বাগদাদ, দামেশক, হালাব, কায়রো, সান‘আ... ইত্যাদি অগণিত শহরে সফর করেছেন। একটি হাদীসই তাঁরা শত শত সনদে সংগ্রহ করে তুলনার মাধ্যমে নির্ভুল ও ভুল বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন।

একটি নমুনা দেখুন। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবনু সাঈদ আল-জাউহারী আল-বাগদাদী (২৪৭ হি)। তার সমসাময়িক মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনু জা’ফার ইবনু খাকান বলেন: আমি ইবরাহীম ইবনু সাঈদকে আবু বাকর সিদ্দীক (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি তার খাদেমকে বললেন: গ্রন্থাগারে ঢুকে আবু বাকর সিদ্দীক (রা)-এর হাদীস-সংকলনের ২৩তম খন্ডটি নিয়ে এস। আমি বললাম: আবু বাকর (রা) থেকে ২০টি হাদীসও সহীহ সনদে পাওয়া যায় না, আপনি কিভাবে তাঁর হাদীস ২৩ খন্ডে সংকলন করলেন? তিনি উত্তরে বলেন: কোনো একটি হাদীস যদি আমি কমপক্ষে ১০০ টি সনদে সংগ্রহ করতে না পারি তাহলে আমি সে হাদীসের ক্ষেত্রে নিজেকে এতিম বলে মনে করি।[1]

হাদীস গ্রহণের সময় তাঁরা সংশ্লিষ্ট ‘রাবী'’-কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তার বর্ণনার যথার্থতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে তার ব্যক্তিগত সততা (عدالة), তার শিক্ষকগণ এবং এলাকার অন্যান্য রাবীগণের বিষয়ে সে এলাকার প্রসিদ্ধ আলিম, মুহাদ্দিস ও শিক্ষার্থীগণকে প্রশ্ন করেছেন। এভাবে সংগৃহীত সকল তথ্য তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা সকল ‘রাবী’ ও তাদের বর্ণিত সকল হাদীসের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন। এ সকল নিরীক্ষক ও সমালোচক হাদীস-বিশেষজ্ঞগণ একদিকে ‘রাবী’ বা হাদীস বর্ণনাকারী এবং সাথে সাথে ‘নাকিদ’ বা হাদীস সমালোচক ও হাদীসের ইমাম বলে পরিচিত। ইসলামের প্রথম ৪ শতাব্দীতে এ ধরনের শতাধিক ‘ইমাম’ ও ‘নাকিদ’ আমরা দেখতে পাই। হাদীসে রাসূলের খেদমতে এদের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ বিশ্বের ইতিহাসে নযিরবিহীন। জ্ঞান ও সভ্যতার ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। অন্য কোনো জাতির ইতিহাসে এর সামান্যতম নযির নেই। তাঁদের কর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণের জন্যও শত শত পৃষ্ঠার গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজন।

এ সকল নাকিদ মুহাদ্দিস বা ইমাম এভাবে সকল হাদীস ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীসের বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা চিহ্নিত করেছেন, মিথ্যাবাদীদেরকে চিহ্নিত করেছেন, বিশুদ্ধ হাদীসকে মিথ্যা ও সন্দেহজনক বর্ণনা থেকে পৃথক করেছেন। তাঁরা নিম্নের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছেন।

  1. সকল হাদীসের সনদ অর্থাৎ সূত্র বা reference সংরক্ষণ।
  2. সনদের সকল ‘রাবী’-র ব্যক্তিগত পরিচয়, জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, উস্তাদ, ছাত্র, কর্ম, সফর ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ।
  3. ‘রাবী’গণের ব্যক্তিগত সততা, বিশ্বস্ততা ও সত্যপরায়ণতা যাচাই করা।
  4. বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা ও যাচাই করা।
  5. সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক ‘রাবী’ তার উর্ধ্বতন ‘রাবী’-র কাছ থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন কিনা তা যাচাই করা।
  6. সংগৃহীত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা থেকে নির্ভুল বর্ণনাগুলো পৃথক করা।
  7. সংগৃহীত তথ্যাদি ও তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যে সকল ‘রাবী’র মিথ্যাচার ধরা পড়েছে তাদের মিথ্যাচার উম্মাহর সামনে তুলে ধরা।
  8. সংগৃহীত সকল হাদীস সনদসহ গ্রন্থায়িত করা।
  9. রাবীদের নির্ভুলতা বা মিথ্যাচার বিষয়ক তথ্যাদি গ্রন্থায়িত করা।
  10. পৃথক গ্রন্থে বিশুদ্ধ হাদীস সংকলিত করা।
  11. পৃথক গ্রন্থে মিথ্যা ও জাল হাদীসগুলো সংকলিত করা।
  12. জাল বা মিথ্যা হাদীস সহজে চেনার নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করা।

নিম্নে আমরা এ সকল বিষয়ে আলোচনা করব।

[1] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/১৫৪-১৫৫।