হুনাইন যুদ্ধ থেকে নিম্মলিখিত শিক্ষাগুলো গ্রহণ করা যায়
- হুনাইন যুদ্ধের মাধ্যমে জানা যায় যে, শত্রুদের নিকট থেকে যোদ্ধাস্ত্র ধার নেওয়া যায়। কেননা নাবী (ﷺ) হুনাইনের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে সাফওয়ান বিন উমাইয়ার নিকট হতে অস্ত্র ধার নিয়েছিলেন। সাফওয়ান তখন মুশরিক ছিল।
- অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া আল্লাহর উপর ভরসার পরিপন্থী নয়। বরং তা পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর উপর ভরসা করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা‘আলা রসূল (ﷺ) কে হেফাজত করার দায়িত্ব নেওয়া সত্ত্বেও আসবাব তথা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাতে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
- আল্লাহ্ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। এই ওয়াদা বিভিন্ন প্রকার জিহাদের প্রতিবন্ধক নয়। অর্থাৎ এই ওয়াদার অর্থ এই নয় যে, আমরা আল্লাহর ওয়াদার উপর ভরসা করে বসে থাকবো এবং যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকব। বরং সঠিক কথা হচ্ছে আমরা যুদ্ধের ময়দানে নামব এবং আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়নের অপেক্ষা করব।
- নাবী (ﷺ) সাফওয়ানের নিকট থেকে যুদ্ধের হাতিয়ার ধার নেওয়ার শর্ত করেছিলেন যে, তিনি এর দায়-দায়িত্ব বহন করবেন। এ ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন- নাবী (ﷺ) এর মাধ্যমে ধার নেওয়া জিনিষের ক্ষতিপূরণ দেয়া জরুরী হওয়ার বিধান করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন- তিনি নিজেই ধার নেওয়া জিনিষটি হুবহু ফেরত দেয়ার যিম্মাদার হওয়ার খবর দিয়েছেন। এ কথাটি এরূপ ছিল যে, তোমার হাতিয়ার নষ্ট হবেনা। যেভাবে নিচ্ছি সেভাবেই ফেরত দিব।
- শত্রুদের ঘোড়া এবং অন্যান্য বাহনকেও আহত করা জায়েয। বিশেষ করে যখন বাহন হত্যা করা শত্রুকে হত্যা করার জন্য সহায়ক হবে। এটি জীব হত্যা বা প্রাণীকে হত্যা করার নিষিদ্ধতার আওতায় পড়বেনা।
- এখান থেকে আরও জানা যায় যে, নাবী (ﷺ) ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, যে রসূল (ﷺ) কে হত্যা করতে চেয়েছিল। শুধু ক্ষমাতেই শেষ নয়; তিনি তার বক্ষে হাত রেখে দু’আ করেছেন। এতে সে ইসলাম কবুল করে নিল এবং রসূল (ﷺ) এর আন্তরিক বন্ধু হয়ে গেল।
- যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত মালে গণীমত বণ্টন করায় তাড়াহুড়া করা যাবেনা। বরং অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে যে, তারা এর মধ্যেই ইসলাম কবুল করে কি না? যাতে করে ইসলাম কবুল করার পর তাদের মাল তাদেরকেই ফেরত দেয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, গণীমতের মাল ভাগ হওয়ার পূর্বে তাতে কারও মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়না। এ জন্যই কোন মুজাহিদ যদি গণীমতের মাল ভাগ হওয়ার পূর্বেই মারা যায়, তাহলে তার ওয়ারিসগণ সেখান থেকে কোন অংশ পাবেনা। বরং উক্ত মুজাহিদদের অংশ অন্যান্য মুজাহিদ ভাইদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। এটি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর মত। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) কুরাইশদের মন জয় করার জন্য সে দিন তাদেরকে যা দিয়েছিলেন, তা ছিল গণীমতের মাল থেকে এক পঞ্চমাংশ (১/৫) বের করার পর বাকী চার অংশ থেকে। এটি ছিল নাবী (ﷺ) এর পক্ষ থেকে তাদের জন্য অনুদান স্বরূপ। খুমুস ১/৫ বের করার পর তিনভাগের এক ভাগ (১/৩) দেয়া কিংবা চারভাগের এক ভাগ (১/৪) দেয়ার চেয়ে এটিই তথা মোট চার ভাগ থেকে অনুদান বের করাই উত্তম।
- গণীমতের মাল আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর রসূলের জন্য। রসূল (ﷺ) তা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ভাগ করবেন। তিনি যদি সম্পূর্ণ গণীমতকেই ইসলামের স্বার্থে বিশেষ এক গোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করে দেন, তাতেও হিকমত ও ইনসাফের খেলাফ হবেনা। যুল খুওয়াইসারা তামীমীর এ বিষয়টি বুঝে আসেনি বলেই সে বলেছিল- হে মুহাম্মাদ ইনসাফ কর, কারণ তুমি এই বন্টনের মধ্যে ইনসাফের খেলাফ করেছ।
- ইমাম বা শাসক হচ্ছেন মুসলিমদের নায়েব। মুসলিম নাগরিকদের স্বার্থে এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি চেষ্টা করবেন। ইসলামকে রক্ষার জন্য যদি তিনি জনগণের কাছে মাল দাবী করেন, তাহলে তা জায়েয আছে। এমনকি মুসলমানদেরকে কাফেরদের ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য শাসক যদি ইসলামের প্রধান প্রধান শত্রুকে নিজের কাছে ডেকে আনেন, তাহলে তাও জায়েয আছে। কেননা ইসলামী শরীয়তের অন্যতম মুলনীতি হচ্ছে বড় ধরণের বিপর্যয় ও ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য ছোট ক্ষতি বরদাশত করা জায়েয আছে এবং বৃহৎ স্বার্থ হাসিল করার জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করা জরুরী। সঠিক কথা হচ্ছে দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ অর্জনের মূল বুনিয়াদই হচ্ছে উক্ত দু’টি বিষয়।
- হুনাইন যুদ্ধের মাধ্যমে এও জানা গেল যে, দাস বিক্রি করা, এমন কি পশুর বিনিময়ে পশু বাকীতে এবং কম-বেশী দেয়ার শর্তে বিক্রি করা জায়েয আছে। ক্রেতা-বিক্রেতা মিলে যদি অনির্ধারিত মেয়াদে (বাকীতে) ক্রয়-বিক্রয় করে এবং উভয়েই সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাও জায়েয আছে। এটিই সঠিক মত, কারণ এখানে কোন নিষিদ্ধতা ও অনিশ্চয়তা বা ঝুকি নেই।
- হুনাইন যুদ্ধে নাবী (ﷺ) বলেছেন- কেউ যদি কোন কাফেরকে হত্যা করতে পারে, তাহলে সেই কাফেরের কাছ থেকে প্রাপ্ত মাল তারই হবে। তবে শর্ত হল এ ব্যাপারে প্রমাণ থাকতে হবে। ফিকাহবিদগণ এই মাসআলায় এখতেলাফ করেছেন। এটি শরীয়তের সাধারণ একটি মাসআলা? অর্থাৎ যে কোন মুজাহিদ যে কোন জিহাদে কোন কাফেরকে হত্যা করতে পারলে সাল্ব তথা নিহত কাফেরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মাল কি হত্যাকারী মুজাহিদেরই প্রাপ্য? নাকি ইমামের পক্ষ হতে এরূপ শর্ত করার পর হকদার হবে? উপরের দু’টি কথাই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল থেকে বর্ণিত হয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে, হত্যাকারীই নিহত কাফেরের (সাল্ব) আসবাব পত্রের হকদার হবে। ইমাম শর্ত করুক বা না করুক। দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে শর্ত না করলে সে (হত্যাকারী) নিহত কাফেরের সামানের (মালপত্রের) হকদার হবেনা।
- এখানে মতভেদের কারণ হল, নাবী (ﷺ) কি রসূল হিসাবে এমনটি বলেছেন যে, এটি একটি সাধারণ শরঈ হুকুমে পরিণত হয়েছে এবং সকল যুগেই এটি কার্যকর হবে? যেমন তিনি বলেছেন-
مَنْ زَرَعَ فِى أَرْضِ قَوْمٍ بِغَيْرِ إِذْنِهِمْ فَلَيْسَ لَهُ مِنَ الزَّرْعِ شَىْءٌ وَلَهُ نَفَقَتُهُ
- ‘‘যে ব্যক্তি অন্য লোকদের জমিতে তাদের অনুমতি ছাড়াই বীজ বপন করবে, সে উৎপন্ন ফল-ফসলের কোন অংশ পাবেনা’’। তবে সে যা খরচ করেছে, তার প্রাপ্য। না কি তিনি এ ব্যাপারে কারও জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছেন? যেমন তিনি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন- তুমি এবং তোমার স্বামীর সম্পদ হতে ঠিক সেই পরিমাণ নিতে পারবে যা তোমার সন্তানদের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট হবে। নাবী (ﷺ) কেবল তখনই তাকে এ কথা বলেছিলেন, যখন সে তার স্বামীর বিরুদ্ধে কৃপণতার অভিযোগ করেছিল। না কি তিনি মুসলিমদের ইমাম হিসাবে এটি বলেছেন যে, সেই সময় মুসলমানদের বৃহৎ স্বার্থে এমনটি বলে জিহাদের জন্য উৎসাহ যোগানোর প্রয়োজন ছিল? যাতে করে মুসলিমগণ পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুপাতে স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে এর প্রতি খেয়াল রাখেন।
- এখান থেকেই আলেমদের মাঝে অনেক বিষয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। যেমন তিনি বলেছিলেন- যে ব্যক্তি কোন পরিত্যক্ত ও মৃত যমীনকে আবাদ ও চাষোপযোগী করবে সেই ঐ যমীনের মালিক হবে।
- হুনাইন যুদ্ধ হতে এও জানা গেল যে, মামলা-মুকাদ্দমা ও বিচার-ফয়সালায় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একজনের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। বিচার ফয়সালার সময় সাক্ষীর এ কথা বলা জরুরী নয় যে, أشهد ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি’। (অন্য শব্দ দিয়েও উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে)।
- এ থেকে আরও জানা গেল যে, নিহত কাফেরের কাছ থেকে গৃহিত সম্পদে খুমুস লাগানো হবেনা। অর্থাৎ তাও পাঁচ ভাগে বিভক্ত করার সাধারণ বিধানের আওতায় আসবেনা। কারণ এটি মূল গণীমতের অন্তর্ভুক্ত। গণীমতের মালে যাদের কোন অংশ নেই, যেমন নারী ও শিশু, তারাও এই সম্পদের হকদার হতে পারে। হাদীস থেকে এও জানা গেল যে, একজন মুজাহিদ যত কাফেরকে হত্যা করবে, তাদের সকলের সম্পদেরই মালিক হবে। যদি নিহতের সংখ্যা অনেক হয় এবং সম্পদও হয় প্রচুর। মু’জেযা প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন লোকেরা পলায়ন করার পরও ময়দানে তাঁর একাই টিকে থাকা,
- এই যুদ্ধে নাবী (ﷺ) এর অনেকগুলো শত্রুরা দূরে থাকা সত্ত্বেও তাঁর পবিত্র হাতের নিক্ষিপ্ত মাটি শত্রুদের চোখে গিয়ে পড়া, ফিরিস্তাদের অবতরণ করা ও মুসলমানদের কাতারে শামিল হয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইত্যাদি। শত্রুরা এবং কতিপয় সাহাবী এই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছিল।