- চুক্তিবদ্ধ কাফেররা যদি চুক্তি ভঙ্গ করে তাহলে তাদের উপর হঠাৎ আক্রমণ করা জায়েয আছে। হামলার খবর তাদেরকে জানানো জরুরী নয়। তবে তারা যদি অঙ্গিকার না করে তাহলে তাদের উপর আক্রমণ করার পূর্বে জানিয়ে দিতে হবে যে, তারা অঙ্গিকার ও চুক্তি বলবৎ রাখবে? না এ থেকে অব্যাহতি দিবে?
- চুক্তিবদ্ধদের কোন লোক চুক্তি ভঙ্গ করলে এবং বাকীরা চুক্তি ভঙ্গ না করলেও যদি তারা এতে সম্মতি দেয় তাহলে সকলেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে গণ্য হবে। যেভাবে সকলেই একসাথে সন্তুষ্ট হয়ে চুক্তি করেছিল।
- প্রয়োজনে শত্রুদের সাথে দশ বছর মেয়াদী শান্তিচুক্তি করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হল এর চেয়ে অধিক মেয়াদের চুক্তি করা যাবে কি না? সঠিক কথা হল যদি মুসলমানদের কল্যাণে হয় এবং তাতে বৃহৎ স্বার্থ পরিলক্ষিত হয়, তাহলে দশ বছরের চেয়েও অধিক মেয়াদী চুক্তি করা যেতে পারে।
- শত্রুদের সামনে মুসলমানদের সংখ্যা, শক্তি ও শান-শওকত প্রকাশ করা মুস্তাহাব। রসূল (ﷺ) মক্কায় প্রবেশের পূর্বে রাতের বেলায় এক সাথে দশ হাজার আগুন জ্বালানোর মধ্যে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
- মুসলমানদের ইমামের কাছে যদি চুক্তি নবায়ন বা না জায়েয কোন জিনিষের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়, এমতাবস্থায় ইমাম যদি চুপ থাকেন, তাহলে তার চুপ থাকা রেজামন্দির প্রমাণ বহন করেনা। কেননা মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান যখন চুক্তি নবায়ন করার আবেদন করল, তখন নাবী (ﷺ) চুপ ছিলেন। তাঁর এই চুপ থাকা চুক্তি নবায়নের জন্য যথেষ্ট ছিলনা বা চুপ থাকা চুক্তির নবায়ন বলে ধরে নেওয়া হয়নি।
- কাফেরদের দূতকে হত্যা করা যাবেনা। কেননা আবু সুফিয়ান চুক্তি ভঙ্গকারী হওয়া সত্ত্বেও সে যখন রসূল (ﷺ)-এর কাছে আসল, তখন তাকে হত্যা করা হয়নি। কেননা সে তার গোত্রের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিল।
- গোয়েন্দা মুসলিম হলেও তাঁকে হত্যা করা জায়েয আছে। হাতেব বিন আবু বালতাআকে হত্যা না করার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, তিনি বদরের যুদ্ধে শরীক ছিলেন।
- বিশেষ প্রয়োজনে মহিলাকে উলঙ্গ করার ধমক দেয়া জায়েয আছে। যেমন আলী (রাঃ) হাতেব (রাঃ) এর গোয়েন্দা মহিলাকে বের না করার কারণে তাকে উলঙ্গ করে তল্লাশি করার হুমকি দিয়েছিলেন।
- কেউ যদি কোন মুসলমানকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং দ্বীনের জন্য রসূান্বিত হয়ে কাফের বা মুনাফেক বলে দেয়, তাহলে সে গুনাহগার হবেনা। তবে শর্ত হল তা যেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কিংবা নফসের খাহেশাত পূর্ণ করার জন্য না হয়।
- হাতেব বিন আবু বালতাআর ঘটনা থেকে আরও জানা গেল যে, কখনও বড় নেকীর দ্বারা বড় গুনাহ্ মোচন হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَأَقِمِ الصَّلاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ
‘‘আর দিনের দুই প্রামেত্মই সলাত ঠিক রাখবে এবং রাতেরও প্রান্তভাগে; পুণ্য কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়, যারা স্মরণ রাখে তাদের জন্য এটি এক মহা স্মারক’’।[1] কখনও এর বিপরীতও হয়। অর্থাৎ পাপ কাজের কারণে অনেক সময় নেক আমল নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالأذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلا يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا لا يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِمَّا كَسَبُوا وَاللهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখেনা। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ঐ বস্ত্তর কোন সওয়াব পায়না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ্ কাফের সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’’।[2]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) হাতেব বিন আবু বালতাআ এবং যুল খুওয়াইসারার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। হাতেব ইবনে আবু বালতাআর ঘটনা বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রসূল (ﷺ) যখন মক্কা বিজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তখন বিশেষ উদ্দেশ্যে আক্রমণের বিষয়টি সাহাবীদেরকে গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তাঁর সাহাবী হাতিব বিন আবু বালতাআ শুধু তার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গোপন সামরিক তথ্য শত্রুদের জানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মক্কাবাসীদেরকে রসূলের উদ্দেশ্য জানিয়ে তিনি একটি চিঠি লিখে একজন মহিলার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রসূল (ﷺ) অহীর মাধ্যমে হাতেবের এই কর্মের কথা জানতে পেরে সাথে সাথে কয়েকজন সাহাবীকে চিঠি উদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। তারা রাওযায়ে খাক নামক বাগানে মহিলাকে পাকড়াও করে চিঠি উদ্ধার করেন। এরপর হাতেবকে ডেকে রসূল (ﷺ) চিঠির বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বলেন। হাতেব বলেন- হে আল্লাহর রসূল! আমি কেবল আমার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করার জন্যই এমনটি করেছি। রসূল (ﷺ) তখন তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
অতঃপর গ্রন্থকার বলেন- জ্ঞানীদের কাছে এই ঘটনার গুরুত্ব এবং হাতেব (রাঃ) এর প্রয়োজনের বিষয়টি মোটেই অস্পষ্ট নয়। জ্ঞানীগণ এই ঘটনা দ্বারা উপকৃত হতে পারবেন এবং এর মাধ্যমে সৃষ্টি জগতে আল্লাহর হিকমতের বিরাট এক অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারবেন।
- মক্কা বিজয়ের ঘটনা থেকে আরও জানা গেল যে, ইহরাম ছাড়াই যুদ্ধের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করা জায়েয। তবে এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, হাজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করলে অবশ্যই ইহরাম পরিধান করে প্রবেশ করতে হবে। এ ছাড়া আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসূল (ﷺ) যা ওয়াজিব করেছেন, তা ছাড়া অন্য কিছুই আবশ্যক নয়।
- মক্কা বিজয়ের ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে যে, মক্কা মুকার্রামা যুদ্ধের মাধ্যমে এবং বল প্রয়োগ করে জয় করা হয়েছে। যারা রসূল (ﷺ) কে গালি দিয়েছিল, তিনি তাদেরকে সে দিন হত্যা করেছেন।
- মক্কা বিজয়ের দিন রসূল (ﷺ) বলেছেন- আল্লাহ্ তা‘আলা মক্কাকে সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষেরা এটিকে সম্মান প্রদান করেনি। রসূল (ﷺ) আরও বলেন- আল্লাহ্ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) এর জবানে মক্কার পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন। সুতরাং পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ্ তা‘আলা মক্কাকে সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। শরীয়তেও এর সম্মান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নাবী ও বন্ধু ইবরাহীম (আঃ) এর পবিত্র জবানের মাধ্যমে এর সম্মান প্রকাশ করেছেন। নাবী (ﷺ) বলেন- উহাতে রক্তপাত করা যাবেনা। এখানে সেই রক্তপাত উদ্দেশ্য, যা হারামের সাথে সম্পৃক্ত এবং হারামের বাইরে তা করা বৈধ। যদি শরীয়তের দৃষ্টিতে তা হালাল হয়ে থাকে। যেমন হারামের সীমানার মধ্যে এমন গাছ কাটা হারাম, যা হারামের বাইরে কর্তন করা বৈধ। নাবী (ﷺ) বলেন- হারামের কাঁটাযুক্ত গাছও কর্তন করা যাবেনা। সুতরাং হারামের গাছ কর্তন করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কথাটি খুবই সুস্পষ্ট। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তা ভাঙ্গাও যাবেনা। এ সব বর্ণনা থেকে বুঝা যাচ্ছে, কাঁটাযুক্ত এবং আওসাজ গাছ কর্তন করা হারাম। তবে আলেমগণ হারামের শুকনো গাছ-পালা কাটার অনুমতি দিয়েছেন। কেননা তা মৃতের মতই। অন্য বর্ণনায় আছে, হারাম এলাকার গাছের পাতাও ছিড়া যাবেনা।
নাবী (ﷺ) এর বাণী, হারাম এলাকার ঘাস কাটা যাবেনা। এই কথার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, এখানে ঐ সকল গাছ ও ঘাস উদ্দেশ্য যা নিজেই উৎপন্ন হয়। মানুষেরা যা রোপন করে, তা কাটতে কোন বাধা নেই। আর ঘাস বলতে তাজা ঘাস উদ্দেশ্য। তবে ‘ইযখির’ ঘাস কাটার অনুমতি আছে। এ ছাড়া অন্য কোন ঘাস কাটা জায়েয নেই। ছত্রাক কিংবা যে সমস্ত উদ্ভিদ মাটির নীচে থাকে, তা কর্তন করা নিষিদ্ধ নয়। কারণ তা ফলের মতই।
নাবী (ﷺ) বলেন, হারাম অঞ্চলের শিকারকে তাড়ানো যাবেনা। এ কথার মধ্যে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে যে, শিকার হত্যা করা বা পাকড়াও করার কোন মাধ্যমই অবলম্বন করা যাবেনা। এমন কি শিকারকে তার স্থান থেকে বিতাড়িতও করা যাবেনা। কেননা এটি একটি সম্মানিত প্রাণী। সে একটি সম্মানিত স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। সুতরাং সেই উক্ত স্থানটির অধিক হকদার। মোটকথা, হারাম অঞ্চলের কোন প্রাণী যদি কোন স্থানে আশ্রয় নেয়, তাহলে তাকে উত্যক্ত করে ঐ স্থান থেকে বিতাড়িত করা জায়েয নয়।
[2]. সূরা বাকারা-২: ২৬৪