হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কি কি হিকমত রয়েছে?

হুদায়বিয়ার ঘটনায় এমনি অনেক হিকমত রয়েছে, যার সঠিক সংখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) নিম্নে কয়েকটি হিকমত উল্লেখ করেছেন-

১) মূলতঃ এটি ছিল মহান বিজয় তথা মক্কা বিজয়ের ভূমিকা স্বরূপ। পৃথিবীর বড় বড় ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে, যে কোন বড় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগে তিনি একটি ভূমিকা পেশ করে থাকেন, যা সেই ঘটনার কারণ হয় এবং ঐ দিকেই ইঙ্গিত করে।

২) হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানদের জন্য একটি বিরাট বিজয় ছিল। কেননা এর মাধ্যমে উভয় পক্ষ পরস্পরকে নিরাপত্তা দিয়েছিল। ফলে লোকেরা পরস্পর মিলে-মিশে বসবাস করার সুযোগ পায়। সেই সুযোগে মুসলিমগণ কাফেরদেরকে কুরআন ও ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পরিবেশ পেলেন। ফলে প্রচুর লোক ইসলামে প্রবেশ করে। যারা ইসলাম গোপন রেখেছিল, তারাও ইসলাম প্রকাশ করে দিল। এই চুক্তির মেয়াদের মধ্যে লোকেরা স্বেচ্ছায় ইসলামে প্রবেশ করল। যেই শর্তগুলো মুশরিকরা নিজেদের অনুকূলে মনে করে আরোপ করেছিল, সেগুলোও মুসলমানদের কল্যাণে এসে গেল। সুতরাং যেখান থেকে তারা সম্মানের আশা করেছিল, সেখান থেকেই তারা অপমানিত হল। মুসলমানেরা যেহেতু আল্লাহর সামনে নত হয়েছিল, তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে সম্মানিত করলেন। বাতিলের মাধ্যমে অর্জিত ইজ্জত হকের মুকাবেলায় অপমানে পরিণত হল।

৩) এই সন্ধিকে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিমদের ঈমান ও ইয়াকীন বৃদ্ধির কারণে পরিণত করেছেন। এর মাধ্যমে পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে রসূল (ﷺ) এর সিদ্বান্ত মেনে নেওয়া, তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা এবং আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় থাকার গুণাবলী অর্জিত হল এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের অন্তরে প্রশান্তি ও স্বসিত্ম নাযিলের মাধ্যমে যেই অনুগ্রহ ও দয়া করেছিলেন, তারা তাও দেখতে পেয়েছে। এ সময় তাদের জন্য এটির বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কারণ তারা এমন অবস্থায় ছিল, যাতে মজবুত পাহাড়ের পক্ষেও স্থির থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং এই মুহূর্তে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের প্রতি এমন প্রশান্তি নাযিল করলেন, যাতে তাদের হৃদয়সমূহ একদম শান্ত হয়ে গেল এবং অন্তরসমূহ শক্ত হয়ে গেল। সেই সাথে তাদের ঈমানও বৃদ্ধি পেল।

৪) হুদায়বিয়ার সন্ধিকে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলের পিছনের গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করা, তাঁর প্রতি আল্লাহর নেয়ামত পূর্ণ করা, সীরাতুল মুস্তাকীমের দিকে তাঁকে হিদায়াত করা ও তাঁর প্রতি সাহায্য প্রেরণ করে তাঁকে বিজয়ী করার মাধ্যম বানিয়েছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলের অন্তরকে খুলে দিয়েছেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির স্থানে যখন মুমিনদের অন্তর কাঁপছিল, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করলেন। এই প্রশান্তি নাযিলের মাধ্যমে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পেল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা রসূল (ﷺ) এর হাতে বায়আতের কথা উল্লেখ করেছেন। এই বায়আতকে এমন জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই বায়আত যেন আল্লাহর হাতেই হচ্ছে। রসূল (ﷺ) এর পবিত্র হাত যখন তাদের হাতের উপর ছিল, তখন আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র হাত তাদের হাতের উপর ছিল। মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর নাবী ও রসূল। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর রসূলের হাতে বায়আত করল, সে যেন আল্লাহর হাতেই বায়আত করল এবং যে ব্যক্তি রসূল (ﷺ) এর সাথে মুসাফাহা করল, সে যেন আল্লাহর সাথেই মুসাফাহা করল। অতঃপর সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, যারা এই বায়আত ও অঙ্গিকার ভঙ্গ করবে, তারাই কেবল এর প্রতিফল ভোগ করবে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত গ্রাম্য লোকদের আলোচনা করেছেন, যারা অঙ্গিকার ভঙ্গ করেছিল এবং আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করেছিল।

অতঃপর রসূল (ﷺ) এর হাতে বায়আত করার কারণে মুমিনদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা বলেছেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের সময় মুমিনদের অন্তরের প্রকৃত অবস্থা আল্লাহ্ তা‘আলা অবগত ছিলেন। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে প্রচুর বিজয় ও গণীমত দান করলেন। খায়বার বিজয়ের মাধ্যমেই এই বিজয়ের সূচনা হয়েছিল। এরপর থেকেই বিজয় অব্যাহত থাকে।

এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদের উপর কাফেরদের হাত উঠানোকে (আক্রমণকে) প্রতিহত করার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে কোন শ্রেণীর কাফের উদ্দেশ্য- তার ব্যাখ্যা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন- মক্কার কাফেরদেরকে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করা থেকে ফিরিয়ে রেখেছিলেন এবং তাদের ক্ষতি থেকে মুসলমানদেরকে হেফাজত করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন- এরা হচ্ছে ইহুদী। সাহাবীগণ যখন মদ্বীনা হতে বের হলেন, তখন তারা মদ্বীনায় অবস্থানকারী মুসলিমদের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের থেকে মদ্বীনার মুসলিমদেরকে হেফাজত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন- এরা হচ্ছে খায়বারে বসবাসকারী ইহুদী এবং তাদের দুই বন্ধু গোত্র আসাদ ও গাতফান। তবে এই ক্ষেত্রে সঠিক কথা হচ্ছে, ইসলাম ও মুসলমানদের সকল শত্রুই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

وَعَدَكُمُ اللهُ مَغَانِمَ كَثِيرَةً تَأْخُذُونَهَا فَعَجَّلَ لَكُمْ هَذِهِ وَكَفَّ أَيْدِيَ النَّاسِ عَنْكُمْ وَلِتَكُونَ آَيَةً لِلْمُؤْمِنِينَ وَيَهْدِيَكُمْ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا

‘‘আল্লাহ্ তোমাদেরকে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ওয়াদা দিয়েছেন, যা তোমরা লাভ করবে। তিনি তা তোমাদের জন্যে ত্বরান্বিত করবেন। তিনি তোমাদের থেকে শত্রুদের স্তব্ধ করে দিয়েছেন- যাতে এটা মুমিনদের জন্যে এক নিদর্শন হয় এবং তোমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’’। (সূরা ফাতাহ-৪৮:২০) মুসলমানদের উপর থেকে শত্রুদের হাত প্রতিহত করাকে একটি আয়াত (নিদর্শন) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ মুসলমানদের সংখ্যা অল্প হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে বরাবরই বিজয় দান করেছেন এবং শত্রুদের অনিষ্ট হতে তাদেরকে রক্ষা করেছেন। এটি অবশ্যই একটি নিদর্শন ও বিরাট নিয়ামাত। কেউ কেউ বলেছেন- এখানে আয়াত (নিদর্শন) বলতে খায়বার বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। উপরের আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে হিদায়াতের নিয়ামাত দেয়ার কথাও বলেছেন। এটি হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামাত।

এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে এমন অনেক গণীমত ও বিজয় দান করার ওয়াদা করেছেন, যা তারা সেই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারেনি। এই বিজয়গুলো সম্পর্কে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন- এখানে মক্কা বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। কেউ বলেছেন- পারস্য ও রোম উদ্দেশ্য। আবার কেউ বলেছেন- খায়বার বিজয়ের পর পূর্ব ও পশ্চিমের দেশসমূহের বিজয় উদ্দেশ্য।

অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন- কাফেররা যদি আল্লাহর অলীদের সাথে যুদ্ধ করে, তাহলে তারা অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার এই সুন্নাতই (রীতিই) চলে আসছে। আর আল্লাহর এই সুন্নাতের মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই।

এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, উপরোক্ত সুন্নাত অনুযায়ী উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সাহায্য আসল না কেন? এই প্রশ্নের জবাব এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলার সাহায্য আসার জন্য তাকওয়া ও সবরের শর্ত ছিল। উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিমগণ সবুর করতে পারে নি বলে এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন না করে রসূলের হুকুম অমান্য করেছিল বলে ওয়াদা পূর্ণ হয়নি। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা অসহায় নারী-পুরুষদেরকে রক্ষা করার জন্য কাফেরদের উপর থেকে তাদের হাতকে (হামলাকে) প্রতিহত করেছেন। সুতরাং এই দুর্বল ও অসহায় লোকদের কারণেই কাফেরদের উপর হতে শাস্তিকে প্রতিহত করেছেন। কেননা তখনও বেশ কিছু দুর্বল মুসলিম কাফেরদের কাতারে ছিল এবং তাদের ঈমান কাফেরদের নিকট গোপন ছিল। তারা বাধ্য হয়ে কাফেরদের পক্ষ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিল। সুতরাং এই অবস্থায় যদি আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে কাফেরদের উপর সক্ষম করে দিতেন, তাহলে এই দুর্বল মুসলিমরাও মারা যেত। যেমন রসূল (ﷺ) মুসলমানদের মাঝে অবস্থান করার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে আযাব থেকে রক্ষা করেছেন।

অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা কাফেরদের অন্তরের মূর্খতাযুগের জেদ পোষণ করার কথা আলোচনা করেছেন। মূর্খতা ও জুলুমের কারণেই তাদের অন্তরে এই জেদ তৈরী হয়েছিল। এই জেদ ও হিংসার মুকাবেলায় আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বন্ধুদের অন্তরে প্রশান্তি ও স্বসিত্ম অবতরণ করেছেন এবং তাদের জন্যে তাকওয়ার (সংযমের) বাক্য অপরিহার্য করে দিলেন। তাকওয়ার বাক্য দ্বারা সেই সমস্ত বাক্য উদ্দেশ্য, যার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ট হচ্ছে কালিমাতুল ইখলাস তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ

‘‘তিনিই তাঁর রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। যদিও এতে মুশরিকরা অসন্তুষ্ট হয়’’।[1] সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা এই দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার অঙ্গিকার করেছেন এবং ইহাকে পৃথিবীর সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে মুমিনদের অন্তরকে শক্তিশালী করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে তাদেরকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এই সুসংবাদের মাধ্যমে তাদের এই দৃঢ় বিশ্বাস অর্জিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা অবশ্যই এই দ্বীনকে পরিপূর্ণ করবেন। হুদায়বিয়ার দিন বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের যে পরাজয় হয়েছে, তা দেখে এমনটি বুঝার সুযোগ নেই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা রসূলের দুশমনদেরকে সাহায্য করেছেন এবং তাঁর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এটি কিভাবে সম্ভব? অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে দ্বীনে হকসহ প্রেরণ করেছেন এবং ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাঁর দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করবেন।

পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূল এবং রসূলের পবিত্র জামআতের খুব প্রশংসা করেছেন। অথচ রাফেযীরা (শিয়ারা) এর বিপরীত করে অর্থাৎ রসূলের সাহাবীদের কুৎসা বর্ণনা করে থাকে।

[1]. সূরা ফাতাহ-৪৮:২৮