চতুর্থ হিজরীর সফর মাসেই বি’রে মাউনার ঘটনা সংঘটিত হয়। এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, নজদ অঞ্চল থেকে আবু বারা নামক একজন মুশরিক নাবী (ﷺ) এর নিকট আগমণ করলে তিনি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণও করে নি, প্রত্যাখ্যানও করে নি। বরং সে বলল- আপনি যদি নজদ এলাকার লোকদের কাছে আপনার কয়েকজন সাহাবী পাঠাতেন এবং তারা লোকদেরকে আপনার দ্বীনের প্রতি আহবান করত, তাহলে আমার ধারণা তারা তাদের আহবানে সাড়া দিবে।

রসূল (ﷺ) বললেন- আমার আশঙ্কা, নজদবাসীরা তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। আবু বারা তখন বলল- আমি তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছি। ইবনে ইসহাক (রহঃ) বলেন- রসূল (ﷺ) তার সাথে ৪০ জন লোক পাঠিয়ে দিলেন। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় ৭০ জনের কথা এসেছে। এক্ষেত্রে সহীহ বুখারীর বর্ণনাই সঠিক। এই ৭০ জনের আমীর ছিলেন, মুনযির বিন আমর। এই ৭০ জন ছিল মুসলমানদের খুব সম্মানী, নেতৃস্থানীয় এবং কুরআন পাঠ ও পাঠদানে পারদর্শী। ‘বিরে মাউনা’ নামক স্থানে পৌঁছে উম্মে সুলাইমের ভাই হারাম বিন মিলহানকে তারা নজদ অঞ্চলের আমের বিন তুফাইলের কাছে রসূল (ﷺ)-এর চিঠিসহ প্রেরণ করলেন। আল্লাহর এই দুশমন চিঠির প্রতি তাকিয়েই দেখেনি। বরং সে হারাম বিন মিলহানের উপর আক্রমণের আদেশ দিলে এক ব্যক্তি পিছন দিক থেকে বর্শা দিয়ে আঘাত করল। হারাম স্বীয় শরীর থেকে রক্ত বের হতে দেখে বললেন- কাবার প্রভুর শপথ! আমি সফল হয়েছি (শাহাদাত বরণ করেছি)। অতঃপর আল্লাহর শত্রু তৎক্ষণাৎ অন্যান্য সাহাবীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বনী আমেরের লোকদেরকে আহবান জানাল। কিন্তু আবু বারা নিরাপত্তা দেয়ার কারণে বনী আমেরের লোকেরা তার ডাকে সাড়া দেয়নি। তারপর সে বনী সুলাইমের লোকদেরকে ডাকল। এরা তার আহবানে সাড়া দিল এবং সাহবীদেরকে ঘেরাও করে সকলকেই হত্যা করে ফেলল। এই ছিল বিরে মাউনার সংক্ষিপ্ত ঘটনা।

এরপর চতুর্থ হিজরীর রবীউল আওয়াল মাসে বনী নযীরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইমাম যুহরীর ধারণা হচ্ছে, বদরের যুদ্ধের ছয়মাস পর বনী নযীরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ধারণা সঠিক নয়। সঠিক কথা হচ্ছে উহুদ যুদ্ধের পর এটি সংঘটিত হয়। বনু কায়নুকার যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদরের পরে। আর বনী কুরায়যার যুদ্ধ সংঘটিত হয় খন্দকের যুদ্ধের পরে এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির পর সংঘটিত হয় খায়বারের যুদ্ধ। তিনি ইহুদীদের সাথে মোট চারটি যুদ্ধ করেন।

অতঃপর জুমাদাল আওয়াল মাসে যাতুর রিকা-এর যুদ্ধ করেন। এতে রসূল (ﷺ) স্বশরীরে অংশ গ্রহণ করেন। এটি ছিল নজদ অঞ্চলের যুদ্ধ। গাতাফান গোত্রকে আক্রমণ করার জন্য তিনি বের হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি সাহাবীদেরকে নিয়ে সালাতুল খাওফ আদায় করেন। ইবনে ইসহাক এবং একদল ঐতিহাসিক যাতুর রিকা-এর যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এ রকমই বলেছেন। এই তথ্যটি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সুস্পষ্ট কথা হচ্ছে, নাবী (ﷺ) উসফান নামক স্থানে সর্বপ্রথম ভয়ের সলাত পড়েছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন। আর এতে কোন মতভেদ নেই যে, গাযওয়ায়ে উসফান খন্দকের যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছে। আবু হুরায়রা এবং আবু মুসা (রাঃ) উসফানের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) খয়বারের যুদ্ধের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন নি। সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, রসূল (ﷺ) উসফানের যুদ্ধেই সর্বপ্রথম সালাতুল খাওফ আদায় করেছেন। অতঃপর যখন চতুর্থ হিজরী সালের শাবান মাস অথবা যুল-কাদ মাস উপস্থিত হল তখন আবু সুফিয়ানের সাথে কৃত ওয়াদা অনুযায়ী রসূল (ﷺ) বদর প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তিনি মুশরিকদের অপেক্ষা করতে থাকলেন। আবু সুফিয়ানও মক্কা হতে বের হল। মক্কা হতে বের হয়ে যখন এক মঞ্জিল পর্যন্ত আসল তখন লোকেরা বলতে লাগল- এটি হচ্ছে অনাবৃষ্টি এবং দূর্ভিক্ষের বছর। সুতরাং এ বছর ফেরত যাওয়া উচিৎ।

এরই মধ্যে হিজরী পঞ্চম সাল এসে গেল। এই বছরের রবীউল আওয়াল মাসে তিনি দুওমাতুল জান্দালের উদ্দেশ্যে বের হলেন। তিনি সেখানকার লোকদের পশুপালের উপর আক্রমণ করলেন দুওমাতুল জান্দালের লোকেরা রসূল (ﷺ) এর আক্রমণের খবর শুনে পলায়ন করল।

অতঃপর এই বছরের শাবান মাসে বুরায়দা আল-আসলামীকে বনী মুসতালেকের উদ্দেশ্যে পাঠালেন। এখানে যেই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তাকে গাযওয়াতুল মুরাইছী বলা হয়। যুদ্ধের কারণ এই ছিল যে, রসূল (ﷺ)-এর কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, বনী মুসতালেকের নেতা হারেছ বিন আবী যিরার নিজ গোত্র এবং পার্শ্বস্ত আরব গোত্রসমূহকে রসূল (ﷺ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ত্তত করছে। মদ্বীনায় এই খবর পৌঁছলে রসূল (ﷺ) বুরায়দাহ আল-আসলামী (রাঃ) কে পাঠালেন। অতঃপর একদল সাহাবীকে নিয়ে রসূল (ﷺ) মুরাইসী নামক একটি জলাশয়ের নিকট পৌঁছালেন। মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে সেখানে কিছুক্ষণ তীর বিনিময় হল। অতঃপর রসূল (ﷺ) তাঁর সাহাবীদেরকে সম্মিলিত হামলা করার আদেশ দিলে তারা সকলেই কাফেরদের উপর আক্রমণ করলে শত্রুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে গেল। রসূল (ﷺ) এখানে তাদের নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করে নিয়ে আসলেন এবং কিছু গণীমতের মাল অর্জন করলেন।