উহুদ যুদ্ধে যে সমস্ত শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের ১২১ নং আয়াত থেকে শুরু করে ১৬০ নং আয়াতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে মুসলমানদেরকে রসূলের কথা অমান্য করা, মতভেদ করা এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। যাতে তারা ভবিষ্যতে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে সমস্ত বিষয় তাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে তা থেকে বিরত থাকে।
নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ একটি হিকমত ও রীতি হচ্ছে তারা কখনও জয়লাভ করবে আবার কখনও পরাজিত হবে। তবে সর্বশেষে তাদেরই বিজয় হবে। সবসময় তাদেরকে বিজয় দান করলে সত্যিকার মুমিন ও অন্যদের মাঝে পার্থক্য করা সম্ভব হবেনা। আর সবসময় পরাজিত করলে নাবী-রসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সফল হবেনা।
مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَمَا كَانَ اللهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ فَآمِنُوا بِاللهِ وَرُسُلِهِ وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا فَلَكُمْ أَجْرٌ عَظِيمٌ
‘‘তোমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছো, আল্লাহ মুমিনদের কখনও সেই অবস্থায় থাকতে দিবেন না। পাক-পবিত্র লোকদেরকে তিনি নাপাক ও অপবিত্রকে লোকদের থেকে আলাদা করেই ছাড়বেন। কিন্তু তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর রসূলদের মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা বাছাই করে নেন। সুতরাং আল্লাহর উপর এবং তাঁর রসূলগণের উপর তোমরা ঈমান আনয়ন কর। তোমরা যদি বিশ্বাসী হও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্যে রয়েছে বিরাট প্রতিদান।’’[1] অর্থাৎ মুমিন ও মুনাফিকরা যেভাবে একসাথে মিশ্রিত অবস্থায় আছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে সে অবস্থায় রেখে দিবেন না। বরং তিনি প্রকৃত মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করবেন। যেমন তিনি করেছিলেন উহুদ যুদ্ধের দিন। আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে গায়েবের খবর অবগত করেন না। কেননা গায়েবের মাধ্যমেই তিনি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা চেয়েছেন যে, বাহ্যিকভাবেও যেন বিশ্বাসী ও মুনাফেকদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। আর উহুদ যুদ্ধে তাই হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তিনি তাঁর রসূলদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকে গায়েবের খবর অবগত করেন।
সুতরাং হে মুমিনগণ! তোমরা সেই গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমেই সৌভাগ্যবান হবে, যা তিনি তাঁর রসূলগণকে অবগত করেন। তোমরা যদি গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়ন কর এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্য রয়েছে বিরাট পুরস্কার।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের মধ্যে আরেকটি হিকমত এই ছিল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা দেখাতে চান যে, তাঁর খাঁটি বন্ধুরা সুখে-দুঃখে এবং পছন্দে-অপছন্দে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর ইবাদত করে। সুতরাং আল্লাহর প্রকৃত বান্দা তারাই, যারা উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর ইবাদত করে। তারা ঐ সকল লোকদের মত নয়, যারা শুধু সুখে থাকা অবস্থাতেই আল্লাহর পথে থাকে।
আল্লাহ্ যদি সবসময় তাদেরকে বিজয়ী করতেন, তাহলে তাদের অবস্থা ঐ সব লোকদের মতই হতো, যাদেরকে রিযিকের ব্যাপারে প্রশস্ততা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় হিকমত ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সকল মাখলুকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। তিনি মাখলুকের সকল অবস্থা সম্পর্কে জানেন ও তা দেখেন।
বান্দারা যখন আল্লাহর দরবারেই নিজেদের অক্ষমতা ও অপারগতা তুলে ধরে দু’আ করে তখন তারা বিজয়ের হকদার হয়ে যায়। আর দুর্বলতা ও পরাজয়ের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার পর বিজয়ের পোশাক খুব ভাল লাগে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
‘‘বস্ত্তত আল্লাহ্ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূরা আল-ইমরান-০৩:১২৩)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ ثُمَّ أَنْزَلَ اللهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنْزَلَ جُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَعَذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে এবং হোনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেবও তোমাদের জন্যে সংকুচিত হয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। তারপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূল ও মুমিনদের উপর নাযিল করেন নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এই হল কাফেরদের কর্মফল’’।[2]
আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বানদাদের জন্য বেহেশতের মধ্যে এমন কিছু মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন, যা শুধু আমলের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। বালা-মসিবতে আক্রান্ত হওয়া ব্যতীত তা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য বালা-মসিবত দ্বারা পরীক্ষা করার পর উক্ত মনজিলে পৌঁছায়ে দেন। সেই সাথে তিনি সৎ আমল করারও তাওফীক দান করেন।
সর্বদা সুস্থ থাকা, সবসময় বিজয় অর্জন হতে থাকা এবং প্রচুর নিয়ামাত ও কল্যাণের মধ্যে থাকা মুমিনদেরকে দুনিয়ার মায়া-মমতায় ফেলে দেয় এবং তাদের হৃদয়ের মধ্যে মরিচা পড়ে যায় এবং আল্লাহর পথে এবং আখিরাতের সুন্দর জীবনের দিকে চলতে হৃদয়কে বাধাগ্রস্ত করে।
আর আল্লাহ্ যখন তাঁর কোন বান্দাকে সম্মানিত করতে চান তখন তাকে বালা-মসিবতে ফেলে আখিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনেন। এটিই হচ্ছে তার চিকিৎসা।
উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে আল্লাহর নিকট শাহাদাত হচ্ছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। তাই তিনি স্বীয় বন্ধুদের মধ্য হতে কতিপয়কে শহীদ হিসাবে বেছে নিতে চান।
আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তার দুশমনদেরকে হালাক (ধ্বংস) করতে চান তখন তাদেরকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে নেন, যাতে তারা ধ্বংসের হকদার হয়ে যায়। এ সবের মধ্যে রয়েছে, কুফরীতে বাড়াবাড়ি করা, সীমা লংঘন করা, আল্লাহর অলীদেরকে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দেয়া, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাগণ গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায় এবং দুশমনরা ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ وَلِيُمَحِّصَ اللهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ
‘‘আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ্ জানতে চান, কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। আর এ কারণে আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিতে চান।’’ (সূরা আল-ইমরান-৩:১৩৯-১৪১) এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা‘আলা একই সাথে মুমিনদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং উহুদের যুদ্ধে তাদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার জন্য উত্তমভাবে শান্তনা দিয়েছেন। সেই সাথে যে কারণে উহুদ যুদ্ধে তাদের উপর কাফেরদেরকে বিজয়ী করেছেন তাও বলে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ
‘‘তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৪০) সুতরাং তোমাদের কি হল যে, তোমরা নিরাশ হচ্ছ এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছ। ইতিপূর্বে কাফেররাও আহত হয়েছে। আর তাদের সেই আঘাত ছিল শয়তানের পথে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি দুনিয়ার দিনসমূহ মানুষের মাঝে ঘুরিয়ে থাকেন। কেননা এটি এমন বিষয়, যা দুনিয়াতে তিনি তাঁর বন্ধু ও শত্রু উভয় শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই ভাগ করে থাকেন। তবে আখিরাতের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কেবল আল্লাহর বন্ধুগণই নেয়ামত ভোগ করবে। আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হিকমত উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে খাঁটি মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করা। ইতিপূর্বে মুনাফেকদেরকে মুমিনগণ চিনতেন না। তারা কেবল আল্লাহর ইলমেই ছিল। এবার মুমিনগণ মুনাফেকদেরকে কপালের চোখ দিয়ে দেখে নিলেন এবং গায়েবী বিষয়টি জেনে ফেললেন।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের থেকে কাউকে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَاللهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
‘‘আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না’’। এখানে সুক্ষ্ণ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুনাফেকরা যেহেতু উহুদ যুদ্ধের দিন আল্লাহর নাবীকে ফেলে চলে এসেছিল, তাই তিনি তাদেরকে পছন্দ করেন নি এবং তাদের থেকে কাউকে শহীদ হিসাবেও গ্রহণ করেন নি। উহুদ যুদ্ধে মুমিনদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমত হচ্ছে, তাদেরকে গুনাহ্ থেকে পবিত্র করা এবং মুনাফেকদের থেকে আলাদা করা। উহুদ যুদ্ধের পর থেকে মুমিনগণ মুনাফেকদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।
এতে আরও হিকমত রয়েছে যে, প্রথমে কাফেরদেরকে সীমালংঘনের সুযোগ দেয়া এবং সেই কারণে তাদেরকে ধ্বংস করা। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত মুমিনদের ধারণা খন্ডন করেছেন, যারা মনে করত যে, বিনা জিহাদেই জান্নাতে যাওয়া যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ
‘‘তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ্ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?’’ (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪২) অর্থাৎ তোমাদের থেকে এখন পর্যন্ত উহা লক্ষ্য করা যায়নি। যাতে করে তার পুরুস্কার দেয়া যায়। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুমিনদেরকে এই বলে ধমক দিয়েছেন যে, তোমরা যেহেতু জিহাদের কামনা করেছিলে এবং শত্রুদের সাথে মুকাবেলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে, তাই এখন পলায়ন করলে কেন? আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَلَقَدْ كُنْتُمْ تَمَنَّوْنَ الْمَوْتَ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَلْقَوْهُ فَقَدْ رَأَيْتُمُوهُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ
‘‘আর তোমরা তো মৃত্যু আসার আগেই মরণ কামনা করতে, কাজেই এখন তো তোমরা তা চোখের সামনে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪৩) আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন- আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তাঁর নাবীর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বদরের যুদ্ধের শহীদদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করলেন তখন ঐ সমস্ত মুসলমান নতুন কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে শাহাদাতের তামান্না (আকাঙ্খা) প্রকাশ করলেন, যারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য উহুদ যুদ্ধে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। সেখানে গিয়ে কতিপয় লোক ব্যতীত যখন তারা পলায়ন করল তখন আল্লাহ্ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন।
উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের আরেকটি কারণ ছিল এই যে, নাবী (ﷺ) জীবিত থাকতেই এমন একটি ভূমিকা পেশ করা যাতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকবে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) অচিরেই মৃত্যু বরণ করবেন। নিয়ামতের প্রকৃত শোকর আদায়কারী তারাই হতে পারবে, যারা তাদের মাঝে রসূল (ﷺ) জীবিত থাকার নিয়ামতের কদর বুঝতে সক্ষম হবে তাঁর সাথে দৃঢ় থাকবে এবং পশ্চাৎমুখী হবেনা। যারা এ রকম হবার তাওফীক প্রাপ্ত হবে তারাই পুরস্কৃত হবে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন যে, প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবে। মুহাম্মাদ (ﷺ)ও মৃত্যু বরণ করবেন। কারণ তাঁর পূর্বেও অনেক নাবী-রসূল মৃত্যু বরণ করেছেন। তাদের সাথেও অনেক অনুসারী নিহত হয়েছেন। আর যারা বেঁচে ছিলেন, তারা দূর্বল হয়ে যান নি কিংবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিরাশ হয়ে যান নি। তারা শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাত অর্জনের স্পৃহা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। মুহাম্মাদ (ﷺ) অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্য প্রেরিত হন নি। সুতরাং তিনি মারা গেলে বা নিহত হলে মুসলমানদের পিছপা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদেরকে তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীন ও তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে এবং মৃত্যু বা নিহত হওয়া পর্যন্ত এর উপরই অবিচল থাকতে হবে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত বিষয়ের আলোচনা করেছেন, যার মাধ্যমে নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীগণ তাদের জাতির উপর জয়লাভ করেছিলেন। আর তা হচ্ছে নিজেদের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করা, তাওবা করা, সত্যের উপর অটুট রাখার জন্য তাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করা এবং শত্রুর উপর জয়লাভ করার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ فَآَتَاهُمُ اللهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآَخِرَةِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
‘‘তারা আর কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে, হে আমাদের প্রতিপালক! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর। অতঃপর আল্লাহ্ তাদেরকে দুনিয়ার সওয়াব দান করেছেন এবং যথার্থ আখিরাতের সওয়াব। আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ্ তাদেরকে ভালবাসেন’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪৭-১৪৮) সুতরাং তারা আল্লাহর কাছে তাদের গুনাহ্ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন, যুদ্ধের সময় তাদের পদসমূহকে দৃঢ় রাখার দু’আ করেছেন এবং আল্লাহর সাহায্য চেয়েছেন। কেননা তারা জেনেছিল যে, মুসলমানদের গুনাহের কারণেই তাদের উপর দুশমনরা জয়লাভ করে থাকে এবং শয়তান তাদের গোমরাহ করে ও এর মাধ্যমেই তাদেরকে পরাজিত করে। গুনাহ্সমূহ দুই প্রকার। (১) হকসমূহ আদায়ের ক্ষেত্রে ত্রুটি করা এবং (২) কিছু গুনাহ হয়ে থাকে সীমালংঘনের কারণে। আর আনুগত্য করার মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সাহায্য এসে থাকে। তারা বলেছিলেন- হে আমাদের প্রতিপালক! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর। তারা জেনেছিল যে, আল্লাহ্ যদি তাদেরকে দৃঢ়পদ না রাখেন এবং সাহায্য না করেন, তাহলে কখনই তারা জয়লাভ করতে পারবেন না। তারা আল্লাহর কাছে ঐ বিষয় চেয়েছিলেন, যা আল্লাহর হাতে রয়েছে। তারা উভয় দিকের প্রতিই খেয়াল রেখেছিলেন। তাওহীদের বাস্তবায়ন এবং উহার হকসমূহ পরিপূর্ণরূপে আদায় করে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। সেই সাথে বিজয় আসার পথে যে সমস্ত বাধা থাকতে পারে তা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে পাপাচারিতা ও জুলুম। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুনাফেক ও মুশরিক শত্রুদের তাবেদারী করতে নিষেধ করেছেন। তারা যদি শত্রুদের আনুগত্য করে তাহলে তারা উভয় জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে ঐ সমস্ত মুনাফেকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর কাফেরদের পূর্ণ তাবেদারী করা শুরু করে দিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- তিনিই মুমিনদের অভিভাবক এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি মুহাববাত রাখবে সেই বিজয়ী হবে। তিনি শত্রুদের অন্তরে ভয় ঢেলে দিবেন। যেই ভয় তাদেরকে মুসলমানদের উপর হামলা করতে বাধা দিবে। শিরক ও কুফরীর কারণেই এমন ভীতি তাদের অন্তরে প্রবেশ করবে। যেই মুমিন ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে নি, তার জন্যই রয়েছে হিদায়াত ও নিরাপত্তা।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুমিনদেরকে সাহায্য করার সত্য ওয়াদা করেছেন এবং বলেছেন যে, তারা যদি বরাবরই আনুগত্য করতে থাকে, তাহলে তারা সদা বিজয় অর্জন করতে থাকবে। তবে সমস্যা হচ্ছে মুসলিমরা আনুগত্যের পথ ছেড়ে দেয়ার কারণে বিজয় ও সাহায্য তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সুতরাং গুনাহ ও পাপ কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার জন্য ও ভাল কাজের শুভ পরিণাম সম্পর্কে অবগত করে দেয়ার জন্য এবং পরীক্ষা করার জন্য তাদের থেকে বিজয়কে সরিয়ে নিয়েছেন।
এত কিছুর পরও তিনি মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হাসান বসরী (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল- শত্রুকে মুসলমানদের উপর শক্তিশালী করে দেয়ার পর ক্ষমা করে দেয়া হল কিভাবে? উত্তরে তিনি বললেন- আল্লাহর ক্ষমা না হলে শত্রুরা তাদের মূলোৎপাটন করে ফেলত। তারা মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং তাঁর ক্ষমার কারণেই এইবার তিনি শত্রুদেরকে প্রতিহত করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলমানদের ঐ দৃশ্য ও অবস্থার আলোচনা করেছেন, যখন তারা পাহাড়ের উপর আরোহন করে পলায়ন করছিল। তারা আল্লাহর রসূল ও সাহাবীদের প্রতি ফিরেও তাকাচ্ছিলেন না। অথচ রসূল (ﷺ) পিছন দিক থেকে এই বলে ডাকছিলেন যে, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আমার দিকে ফিরে এসো। আমি আল্লাহর রসূল! সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এই পলায়নের কারণে দুশ্চিন্তার পর দুশ্চিন্তায় ফেলার মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন। (এক) পলায়নের কারণে নেমে আসা বিষিণ্ণতা। (দুই) শয়তানের এই বলে চিৎকারের বিষণ্ণতা যে, সে বলেছিল মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন- পলায়নের মাধ্যমে যেহেতু তারা রসূল (ﷺ) কে পেরেশানীর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, তাই আল্লাহ্ তা‘আলাও তাদেরকে দুশ্চিন্তায় ফেলে পরীক্ষায় ফেলেছেন। তবে নিম্নলিখিত কারণে প্রথম কথাটিই অধিক সুস্পষ্ট: ১. আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
لِكَيْلَا تَحْزَنُوا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا مَا أَصَابَكُمْ وَاللهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
‘‘যাতে তোমরা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বস্ত্তর জন্য দুঃখ না কর এবং যার সম্মুখীন হচ্ছ সে জন্য বিষণ্ণ না হও। আর আল্লাহ্ তোমাদের কাজের ব্যাপারে অবহিত রয়েছেন’’।[3] এখানে মুসলমানদেরকে বিষণ্ণগ্রস্ত করার পর পুনরায় বিষণ্ণ করা হিকমত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যাতে তারা বিজয় হাত ছাড়া হওয়ার কারণে এবং পরাজিত হওয়ার কারণে আপতিত দুশ্চিন্তা ভুলে যায়। আর এটি ঐ রকম একটি পেরেশানী ঢেলে দেয়ার মাধ্যমেই সম্ভব, যার পরে আরেকটি পেরেশানী আগমন করেছিল।
২. প্রথম ব্যাখ্যাটিই বাস্তব সম্মত। তারা একাধিক পেরেশানীতে পড়েছিল। সেদিন গণীমতের মাল অর্জন না করতে পারার বিষণ্ণতা, পরাজিত হওয়ার বিষণ্ণতা, আহত ও নিহত হওয়ার বিষণ্ণতা, নাবী (ﷺ) নিহত হওয়ার গুজব এবং শত্রুদের পাহাড়ের উপর উঠে পড়া। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এখানে শুধু দু’টি পেরেশানী ছিলনা; বরং পেরেশানীর পর পেরেশানী আসতেই ছিল। যাতে করে তাদের ঈমানের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা হয়ে যায়।
৩. এখানে গাম্ম (পেরেশানী) দ্বারা সাজা ও শাস্তিকে পরিপূর্ণ করা হয়েছে। সাজা অর্জনের কারণ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়নি। সার কথা হচ্ছে নাবী (ﷺ) কে বর্জন করা, যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা, রসূলের ডাকে সাড়া না দেয়া, তাঁর কথা অমান্য করে তীরন্দাজদের স্থান ত্যাগ করা, পরস্পর মতবিরোধ করা এবং মনোবল হারা হয়ে যাওয়া- এগুলো এমন বিষয় যার প্রত্যেকটিই একটি করে পেরেশানী ডেকে আনে। সুতরাং পেরেশানীতে পড়ার একাধিক কারণ পাওয়া গিয়েছিল বলেই একের পর এক পেরেশানী এসেছিল। মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও দয়ার কারণেই তাদের থেকে এমন কিছু স্বভাবগত মন্দ আচরণ প্রকাশ হয়েছিল, যা স্থায়ী বিজয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এগুলো থেকে তাদেরকে পরিষ্কার করার জন্য এমন কিছু কারণ তৈরী করেছেন, যার ফলাফল বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ মনে হচ্ছিল। তখন তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, কৃত অপরাধ থেকে তাওবা করা, উপরোক্ত অপরাধগুলো জরুরী ভিত্তিতে পরিহার করা। আর পাপ কাজ ছেড়ে দিয়ে তার স্থলে নেক কাজ করা অত্যন্ত জরুরী। এ ছাড়া স্থায়ী সাহায্য ও বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের পর তারা সতর্ক হয়ে গেল এবং যেই দরজা দিয়ে পরাজয়ের কারণগুলো প্রবেশ করেছিল, তা সম্পর্কে অবগত হয়ে গেল। কেননা কখনও অসুস্থতার মাধ্যমেও শরীর সুস্থ হয়ে থাকে। অর্থাৎ পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার পর বান্দা যখন তাওবা করে তখন সে গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়। তার শরীর ও মন পূর্বের তুলনায় অধিক সুস্থতা অনুভব করে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিমদের উপর দয়া ও রহমত বশতঃ তাদের উপর নিদ্রা ঢেলে দিয়ে পেরেশানীকে দূর করে দিয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নিদ্রা হচ্ছে বিজয়ের আলামত। বদরের যুদ্ধেও আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে তন্দ্রা ও নিদ্রা দিয়ে আচ্ছাদিত করেছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- যার উপর নিদ্রা আগমণ করেনি, সে ঐ সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা নিজেদের নফস্ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তার কাছে দ্বীন, নাবী বা সঙ্গী-সাথীর কোন মূল্য ছিলনা। আর তারা আল্লাহ্ সম্পর্কে জাহেলী যামানার লোকদের ধারণা পোষণ করেছিল।
আল্লাহর রসূল সম্পর্কে তাদের ধারণা কেমন ছিল- এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, তারা ধারণা করত যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে সাহায্য করবেন না। অচিরেই মুহাম্মাদের কর্ম-কান্ড ও প্রচেষ্টার অবসান ঘটবে। তারা আরও ধারণা করেছিল যে, তাদের যে বিপর্যয় হয়েছিল, তা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী হয়নি। এতে আল্লাহর বিশেষ কোন হিকমতও ছিলনা। সুতরাং তারা কাদ্র (তাকদীর), হিকমতে ইলাহী এবং দ্বীনে ইলাহীর বিজয় হওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল। এটিই ছিল তাদের মন্দ ধারণা। যেই ধারণা করেছিল মক্কার মুশরিক এবং মদ্বীনার মুনাফেকরা। সূরা ফাতাহ্-এর মধ্যে এ সবের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এই ধারণা ছিল একটি মন্দ ধারণা। কারণ এটি এমন একটি ধারণা, যা আল্লাহর যাতে পাক, তাঁর সুমহান নাম, গুণাবলী, তাঁর হিকমতের ক্ষেত্রে মোটেই ঠিক নয়। তেমনি এমন ধারণা আল্লাহর একচছত্র রুবুবীয়াত ও উলুহীয়াতের শানেও প্রযোজ্য নয়। কারণ আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং যে ধারণা করবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রিসালাতকে পূর্ণতা দান করবেন না, সত্যের উপর বাতিলকে সবসময় বিজয়ী রাখবেন, সত্য বাতিলের সামনে দুর্বল হয়ে থাকবে এবং এরপর সত্য কখনই মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবেনা, সে অবশ্যই আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণা করল। সে আল্লাহর সাথে এমন বিষয়কে সম্পৃক্ত করল, যা আল্লাহর সিফাতে কামালিয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে ব্যক্তি ঐ প্রকারের কোন কর্মে তাকদীরে ইলাহীকে অস্বীকার করল সে আল্লাহর ক্ষমতা ও রাজত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর যে সমস্ত লোক আল্লাহর সেই হিকমতকে অস্বীকার করল, যার কারণে তিনি প্রশংসার হকদার এবং এই ধারণা পোষণ করল যে, উহুদের যুদ্ধে আল্লাহ্ মুমিনদেরকে পরাজিত করতে চেয়েছেন বলেই তা করেছেন, এর পিছনে অন্য কোন হিকমত নিহিত নেই, তারা কাফেরদের ন্যায়ই ধারণা করল। আর কাফেরদের জন্যই রয়েছে ধ্বংস ও জাহান্নাম।
অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। বিশেষ করে ঐ সমস্ত বিষয়ে, যা তাদের তাকদীরের সাথে সম্পৃক্ত। যারা আল্লাহর যাতে পাক, তাঁর পবিত্র নামসমূহ, তাঁর ত্রুটিমূক্ত সিফাতসমূহ এবং হিকমতসমূহ ও তিনিই যে যথাযথ প্রশংসার হকদার এ সম্পর্কে যারা অবগত, তারাই কেবল আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারনা করা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। যে মুমিন আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হল, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস পোষণ করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৎ বান্দাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং তাঁর বন্ধু ও শত্রুদের সাথে একই আচরণ করবেন, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
যে ব্যক্তি মনে করল যে, আল্লাহর বান্দারা তাঁর আদেশ-নিষেধের আওতাভুক্ত নয়, সেও আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি অসৎ ধারণা করল। এমনি কল্পনা করল যে, তিনি ভাল কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব ও খারাপ কাজের বিনিময়ে শাস্তি দিবেন না এবং যে বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করছে, তাতে তিনি কিয়ামতের দিন ফয়সালা প্রদান করবেন না সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বিনা কারণেই বান্দার সৎকাজকে নষ্ট করে দিবেন এবং যেই কর্মে বান্দার কোন দোষ নেই, তার জন্যও তিনি বান্দাকে শাস্তি দিবেন অথবা আল্লাহ্ তা‘আলা সেই সমস্ত মুজেযা দ্বারা তাঁর শত্রুদেরকে শক্তিশালী করবেন, যেগুলো দ্বারা তিনি তাঁর রসূলদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং যে মনে করবে যে, আল্লাহ্ থেকে যা আসবে তার সবই একই রকম ভাল, এমন কি যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়েছে, তাকে চিরকালের জন্য জাহান্নামে পাঠানো এবং যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর নাফরমানীতে শেষ করেছে, তাকে জান্নাতে পাঠানোও আল্লাহর জন্য একই রকম উত্তম এবং উভয়টি একই রকম সুন্দর, যে ব্যক্তি ধারণা করল, ভাল-মন্দ- এ দু’টির মাঝে অহীর মাধ্যম ছাড়া পার্থক্য করা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের বিবেক কোনটিকে মন্দ ও কোনটিকে সুন্দর সাব্যস্ত করতে সক্ষম নয়, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের সত্ত্বা, গুণাবলী এবং তাঁর কর্মসমূহ সম্পর্কে যেই সংবাদ দিয়েছেন, তার প্রকাশ্য অর্থ বাতিল এবং তা উপমা স্বরূপ। এখানে মূল সত্যকে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ না করে ছেড়ে দিয়ে দূর থেকে তার দিকে ইশারা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মনে করবে যে, কুরআন মজীদে সর্বদা অর্থহীন শব্দ ও উপমা পেশ করা হয়েছে, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করল, আল্লাহ্ চেয়েছেন যে, তাঁর বান্দারা স্বীয় কালামের অর্থ পরিবর্তন করুক এবং সেই অর্থ দ্বারা তাদের মসিত্মস্ককে পরিপূর্ণ করুক এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীর পরিচয় জানার জন্য তিনি তাদেরকে বিবেকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন; তাঁর কিতাবের উপর নির্ভর করতে বলেন নি, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করে, আল্লাহ্ তাদেরকে স্বীয় কালামের সেই বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে বলেন নি, যার প্রতি আরবী ভাষা সুস্পষ্ট নিদের্শনা প্রদান করে (অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা খোলাখুলিভাবে হক প্রকাশ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম এবং ঐ সমস্ত শব্দ দূর করতে সক্ষম, যেগুলো মানুষকে বাতিল আকীদার দিকে নিয়ে যায়) তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল।
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূল ব্যতীত সে এবং তার উস্তাদরাই সত্য বলেছেন এবং তাদের কথাতেই রয়েছে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও আল্লাহর কালামের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের মধ্যে গোমরাহী ছাড়া অন্য কিছু নেই, তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি খুবই মন্দ। এদের সকলেই আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী এবং আল্লাহর ব্যাপারে অন্যায় ও জাহেলিয়াতের ন্যায় ধারণা পোষণকারী।
এমনি যে ধারণা করল যে, আল্লাহর রাজ্যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও অন্য কিছু সংঘটিত হয়ে থাকে এবং এমন কিছু হয়ে থাকে, যা তিনি সৃষ্টি করতে ও গঠন করতে সক্ষম নন সেও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা বিশ্বাস করল আল্লাহ্ তা‘আলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কর্মহীন ছিলেন, কোন কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষমও ছিলেন না, অতঃপর তিনি কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছেন, সেও আল্লাহর প্রতি খুব খারাপ বিশ্বাস পোষণ করল। যারা বিশ্বাস করল, আল্লাহ্ শুনেন না, দেখেনও না এবং সৃষ্টি সম্পর্কে অবগতও নন সেও আল্লাহর প্রতি খুব খারাপ ধারণা পোষণ করল। আর যারা মনে করে আল্লাহর কোন ইচ্ছা নেই, কথা বলাও তাঁর গুণের অন্তর্ভুক্ত নয়, তিনি কারও সাথে কথা বলেন নি, বলবেনও না, কোন আদেশ বা নিষেধও করেন নি, তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা ধারণা করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আসমানসমূহের উপর আরশে সমুন্নত নন, সকল স্থানই তাঁর জন্য সমান এবং যারা সুবহানা রাববীয়াল আ-লা আর সুবহানা রাববীয়াল আসফাল বলাকে একই রকম মনে করে তাদের আকীদাহ্ খুবই খারাপ। যারা মনে করে আল্লাহ্ তা‘আলা কুফরী পাপাচারিতা এবং অবাধ্যতাকে আনুগত্যের ন্যায়ই ভালবাসেন ও পছন্দ করেন তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ্ কাউকে ভালবাসেন না, কারও প্রতি সন্তুষ্টও হন না, ক্রোধান্বিতও হন না, কাউকে বন্ধু হিসাবেও গ্রহণ করেন না, কাউকে দুশমন হিসাবেও গ্রহণ করেন না, তিনি কারও নিকটবর্তী হন না এবং অন্য কেউ তাঁর নিকটবর্তী হয়না, তারাও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী।
এমনিভাবে যে ব্যক্তি মনে করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা পরস্পর বিরোধী দু’টি বিষয়কে একইভাবে মূল্যায়ন করেন এবং সকল দিক থেকে সমান দু’টি বস্ত্তর মধ্যে পার্থক্য করেন (অর্থাৎ ন্যায় বিচার বর্জন করেন) কিংবা একটি মাত্র কবীরা গুনাহ্এর কারণে সারা জীবনের সৎ আমল বরবাদ করে দেন এবং জাহান্নামে চিরস্থায়ী করেন, সেও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
সার কথা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের জন্য যেই গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন অথবা আল্লাহর রসূল (ﷺ) আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সত্তার জন্য যে সমস্ত গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, কেউ যদি তার খেলাফ ধারণা পোষণ করে অথবা আল্লাহর গুণাবলীকে বাতিল বলে বিশ্বাস করে সেও আল্লাহর প্রতি খুব মন্দ ধারণা পোষণ করল।
চলমান.........
[2]. সূরা তাওবা-৯:২৫-২৬
[3]. সূরা আল-ইমরান-৩: ১৫৩