অমুসলিমদের সাথে চুক্তি করা এবং কর গ্রহণ সম্পর্কে রসূল (ﷺ) এর হিদায়াত হচ্ছে, অষ্টম হিজরীতে সূরা তাওবা নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি কোন অমুসলিমের নিকট হতে জিযিয়া তথা কর গ্রহণ করেন নি। অতঃপর যখন জিযিয়া (কর-টেক্স) সম্পর্কিত আয়াত নাযিল হল তখন তিনি অগ্নিপূজক ও আহলে কিতাবদের থেকে তা আদায় করলেন। তবে খায়বারের ইহুদীদের থেকে তা আদায় করেন নি। যারা মনে করে আদায়ের বিষয়টি খায়বারের ইহুদীদের সাথে নির্দিষ্ট তাদের ধারণা ভুল। এই রকম ধারণা সীরাতে নববী সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের কমতির প্রমাণ বহন করে। কেননা তিনি খায়বারের ইহুদীদের সাথে কর আদায় সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বেই চুক্তি করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশে খায়বারের ইহুদীরা শামিল ছিলনা। কেননা তাদের মধ্যে ও রসূল (ﷺ) এর মধ্যে এর পূর্বেই চুক্তি হয়েছিল। নির্দিষ্ট একটি অংশ প্রদানের বিনিময়ে তাদের সাথে যেহেতু চুক্তি হয়েছিল, তাই তাদের কাছে তা ছাড়া অন্য কিছু তলব করা হয়নি। এ ছাড়া যে সমস্ত অমুসলিমদের সাথে চুক্তি ছিলনা, তাদের কাছে তিনি জিযিয়া দাবী করেছেন। অতঃপর যখন উমার (রাঃ) তাদেরকে খায়বার থেকে সিরিয়ায় নির্বাসন দিলেন তখন তাদের সাথে কৃত চুক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। এরপর থেকে তারা অন্যান্য অমুসলিমদের মতই হয়ে গেল।
মুসলিমদের কোন কোন শাসনামলে যখন কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল কমে গিয়েছিল তখন কতক লোক একটি চিঠি বের করল। তাতে লেখা ছিল, রসূল (ﷺ) খায়বারবাসীর উপর থেকে জিযিয়া গ্রহণ বাতিল করেছেন। তাতে আলী বিন আবু তালেব, সা’দ বিন মুআয এবং একদল সাহাবীর সাক্ষ্যও ছিল। পত্রটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে পুরাতন মনে হলেও তা ছিল কুচক্রীদের পক্ষ হতে বানোয়াট একটি চিঠি। সুন্নাত সম্পর্কে যাদের কোন জ্ঞান ছিলনা, তারা এই পত্রটিকে সহীহ মনে করে তার উপর আমল করতে লাগল। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার কাছে যখন পত্রটি প্রেরণ করা হল এবং এর উপর আমল চালু করার জন্য তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া হল তখন তিনি পত্রটির উপর থুথু নিক্ষেপ করলেন এবং তা মিথ্যা ও বানোয়াট হওয়ার উপর দশটি দলীল পেশ করলেন।
১) পত্রটিতে সা'দের সাক্ষ্য লিখা ছিল। অথচ সা’দ বিন মুআয (রাঃ) খায়বারের ঘটনার পূর্বেই মৃত্যু বরণ করেছেন।
২) খায়বারের ঘটনার সময় পর্যন্ত জিযিয়ার বিধান নাযিল হয়নি।
৩) পত্রটিতে লিখা ছিল যে, শক্ত ও পরিত্যক্ত যমীন তিনি তাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ রসূল (ﷺ)-এর যামানায় এ ধরণের যমীনের উপর কোন কিছুই নির্ধারিত ছিলনা। পরবর্তীতে জালেম শাসকরাই এটি তৈরী করেছিল। এর উপরই আমল চলতে থাকে।
৪) সীরাতে নববী, ইলমে হাদীস এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞ কোন আলেমই তাদের লেখনীতে পত্রটি উল্লেখ করেন নি। মিথ্যুক ইহুদীরা সালফে সালেহীনদের যুগে এই পত্রটি বের করেনি। কেননা তারা জানত যে, তখন বের করা হলে সীরাতে নববী সম্পর্কে পারদর্শী আলেমগণ তা মিথ্যা হওয়ার বিষয়টি ধরে ফেলবেন। যখন সুন্নাতের ইলম বিলুপ্ত হতে লাগল তখন তারা পত্রটি বের করল। আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসূলের সাথে খেয়ানতকারী কিছু লোকও ইহুদীদেরকে সহায়তা করেছিল। তবে বিষয়টি বেশী দিন গোপন থাকেনি। আল্লাহ্ তা‘আলা পত্রটির বিষয় পরিষ্কার করে দিলেন এবং খলীফাগণ তা বাতিল বলে ঘোষণা করলেন।
মূর্তিপূজকদের কাছ থেকে তিনি জিযিয়া গ্রহণ করেন নি। ইমাম শাফেঈ এবং এক বর্ণনায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বলেন- আহলে কিতাব (ইহুদী-খৃষ্টান) এবং অগ্নিপূজক ব্যতীত অন্য কোন অমুসলিম থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা যাবেনা। আর ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন- অনারব মূর্তিপূজকদের থেকে গ্রহণ করা হবে; আরব মূর্তিপূজক থেকে নয়। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন- রসূল (ﷺ) আরবদের থেকে জিযিয়া আদায় করেন নি। কারণ আরবদের ইসলাম গ্রহণের পরই জিযিয়ার আয়াত নাযিল হয়েছে। আরব দেশে তখন কোন মুশরিকই অবশিষ্ট থাকেনি। এই জন্যই তিনি মক্কা বিজয়ের পর তাবুকের যুদ্ধ করেছেন। তখন যদি আরবের ভূমিতে কোন মুশরিক থাকত, তাহলে তাবুক পর্যন্ত না গিয়ে নিকটের কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই উত্তম হত। আর তাবুকের লোকেরা ছিল খৃষ্টান। যে ব্যক্তি সীরাতে নববী ও ইসলামের দিনগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে সহজেই বিষয়টি বুঝতে পারবে।
নাবী (ﷺ) অগ্নিপূজকদের থেকে জিযিয়া আদায় করেছেন। এ কথা সহীহ নয় যে, তাদের কাছে কোন কিতাব ছিল, যা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। অগ্নিপূজক ও মূর্তিপূজকদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং মূর্তিপূজকরা দ্বীনে ইবরাহীমের এমন কিছু বিষয় মেনে চলে, যা অগ্নিপূজকরা মানেনা। অগ্নিপূজকরা ইবরাহীম (আঃ)এর শত্রু। সুতরাং নাবী (ﷺ) এর পবিত্র সুন্নাত প্রমাণ করে যে, মূর্তিপূজক তথা মুশরিকদের থেকেও জিযিয়া গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন- যখন তুমি মুশরিকদের থেকে তোমার কোন শত্রুর মুকাবেলায় অবতীর্ণ হবে তখন তুমি তাদেরকে তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি মেনে নেওয়ার প্রতি আহবান করবে। যে কোন একটি বিষয় মেনে নিলেই তুমি তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করে নিবে এবং তাদের উপর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে। অতঃপর নাবী (ﷺ) বললেন- তাদেরকে ইসলাম কবুল করার প্রতি আহবান জানাবে।
ইসলাম কবুল করতে অস্বীকার করলে তুমি তাদেরকে জিযিয়া প্রদান করার প্রতি আহবান জানাবে। তাও যদি তারা মেনে না নেয়, তাহলে তুমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।[1] মুগীরা বিন শু’বা পারস্যের সম্রাট কেসরার গভর্ণরকে বলেছিলেন- তোমরা যতক্ষণ না আল্লাহর ইবাদত করবে অথবা জিযিয়া প্রদান না করবে ততক্ষণ আমাদের নাবী তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন।[2] নাবী (ﷺ) কুরাইশদেরকে বলেছিলেন- তোমরা কি এমন একটি বাক্য মেনে নিবে? যাতে আরবরা তোমাদের আনুগত্য করবে এবং অনারবরা তোমাদের কাছে জিযিয়া পাঠাবে। তারা বলল- সেটি কী? নাবী (ﷺ) বললেন- তা হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্।[3]
নাবী (ﷺ) নাজরানের খৃষ্টানদের সাথে এই শর্তে চুক্তি করলেন যে, তারা প্রত্যেক বছর মুসলমানদেরকে দুই হাজার জোড়া কাপড় দিবে এবং ত্রিশটি বর্ম, ত্রিশটি ঘোড়া, ত্রিশটি উট ও প্রত্যেক প্রকার যুদ্ধাস্ত্র থেকে ত্রিশটি করে অস্ত্র মুসলমানদেরকে এই শর্তে দিবে যে, তারা এগুলো দিয়ে জিহাদ করবে। পরে সেগুলো তাদের কাছে ফেরত দেয়া হবে। যত দিন এগুলো মুসলিমদের হাতে থাকবে তত দিন মুসলমানেরাই এগুলোর যিম্মাদার হবে। এর বিনিময়ে তাদের কোন ইবাদতখানা ভাঙ্গা হবেনা, তাদের পাদ্রীদেরকে গীর্জা থেকে বের করা হবেনা এবং তাদেরকে তাদের দ্বীন ছাড়তে বাধ্য করা যাবেনা। তবে শর্ত হচ্ছে তারা কোন অপকর্ম করতে পারবেনা এবং সুদের ব্যবসা করতে পারবেনা। সুতরাং এতে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, তাদের সাথে সুদ না খাওয়ার এবং অপকর্ম না করার শর্ত করা হলে তারা যদি তা করে তাহলে তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে গণ্য হবে।
নাবী (ﷺ) যখন মুআয বিন জাবালকে ইয়ামানে পাঠালেন তখন তাকে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের নিকট হতে এক দ্বীনার করে অথবা তার সমমূল্যের ইয়ামানে তৈরী মুআফেরী নামক কাপড় জিযিয়া (কর) হিসাবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, জিযিয়াতে পরিমাণ ও শ্রেণী নির্ধারিত নয়। বরং মুসলমানদের প্রয়োজন অনুসারে স্বর্ণ-রেŠপ্য, কাপড়-চোপড় এবং অন্য যে কোন বস্ত্ত থেকে নেওয়া যেতে পারে। যাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা হবে, তাদের অবস্থাও বর্ণনা করেন নি। এ ব্যাপারে রসূল (ﷺ) এবং তাঁর খলীফাগণও আরব এবং অনারবদের মাঝে পার্থক্য করেন নি। তিনি হাজার নামক স্থানের অগ্নিপূজকদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ করেছেন। তারা ছিল আরব। কেননা আরবদের প্রত্যেক গোত্রই তাদের পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহের দ্বীন পালন করে চলত। বাহরাইনের আরবরা ছিল অগ্নিপূজক। কারণ তারা ছিল পারস্যের অগ্নিপূজকদের প্রতিবেশী। তানুখ, বহরা এবং বনী তাগলিবের খৃষ্টানদের থেকেও তিনি জিযিয়া গ্রহণ করেছেন। কারণ তারা ছিল খৃষ্টান। ইয়ামানের কিছু কিছু আরব গোত্র ইহুদীদের পাশে বসবাস করার কারণে আহলে কিতাবদের দ্বীনের অনুসরণ করত। নাবী (ﷺ) তাদের উপর জিযিয়ার বিধান জারি করেছেন। তাদের বাপ-দাদাদের দ্বীন কি ছিল এবং তারা কখন আহলে কিতাবদের দ্বীনে প্রবেশ করল? এ বিষয়ের কোন মূল্যায়ন করেন নি।
সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, মুসা (আঃ) এর শরীয়ত মানসুখ হয়ে যাওয়ার পর আনসারদের কিছু কিছু সন্তান ইহুদী হয়ে গিয়েছিল।
তাদের পিতাগণ পরে তাদেরকে ইসলামের উপর বাধ্য করতে চাইলে কুরআনের এই আয়াত নাযিল হয়ঃ
لا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ
‘‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদসিত্ম বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হিদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে’’। (সূরা বাকারা-২:২৫৬) নাবী (ﷺ) বলেন- প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ থেকে এক দ্বীনার করে আদায় কর। এই হাদীস প্রমাণ করে যে, শিশু এবং নারীদের থেকে জিযিয়া আদায় করা হবেনা। আর যেই হাদীছে বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ থেকে এক দিরহাম করে আদায় কর, তা মুত্তাসেল সনদে সহীহ নয়। হাদীসটির সনদের ধারাবাহিকতা (চেইন) বিচ্ছিন্ন। এই বাড়তি শব্দটি (নারী শব্দটি) অন্যান্য সীরাত গ্রন্থকারগণ উল্লেখ করেন নি। সম্ভবত কোন কোন রাবীর পক্ষ হতে এটি ব্যাখ্যা স্বরূপ।
[2]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জিহাদ।
[3]. মুসনাদে আহমাদ, (১/২২৭)