জিহাদের ময়দানে অবতরণের পূর্বে নাবী (সাঃ) এর হিদায়াত

নাবী (ﷺ) দিবসের প্রথমভাগে শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের ময়দানে অবতরণ করা পছন্দ করতেন। সফরে বের হওয়ার সময়ও তিনি দিবসের প্রথম ভাগেই বের হতেন। দিবসের শুরুতে জিহাদ শুরু না করতে পারলে সূর্য ঢলা, বাতাস প্রবাহিত হওয়া এবং মদদে ইলাহী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।

জিহাদের শুরুতে তিনি সাহাবীদের থেকে এই মর্মে বায়আত নিতেন যে, তারা পলায়ন করবেনা। কখনও তিনি মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর রাহে জিহাদ করার এবং ইসলামের উপর অবিচল থাকার বায়আত নিতেন। মক্কা বিজয়ের পূর্বে তিনি হিজরতের বায়আতও নিয়েছেন। ঠিক তেমনি আল্লাহর তাওহীদ এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করার বায়আত নিয়েছেন।

তিনি একদল সাহাবীর সাথে এই মর্মে বায়আত নিলেন যে, তারা কারও কাছে কিছুই চাইবেনা। তাই তাদের কারও হাত থেকে ঘোড়ার চাবুক পড়ে গেলে নিজেই বাহন থেকে নেমে চাবুক উঠিয়ে নিতেন। কাউকে এ কথা বলতেন না যে, আমার চাবুকটি উঠিয়ে দাও।

জিহাদের ময়দানে নামার আগে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণের বিষয়ে তিনি তাঁর সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করতেন এবং উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করতেন। চলার পথে তিনি সবার পিছনে চলতেন এবং দুর্বলদেরকে সাথে নিয়ে চলতেন। কেউ পিছনে পড়ে গেলে তাকে স্বীয় বাহনের পিছনে উঠিয়ে নিতেন। চলার পথে সাহাবীদের সাথে তিনি সর্বাধিক নরম ব্যবহার করতেন।

তিনি কোন জিহাদে বের হওয়ার ইচ্ছা করলে তাওরীয়া করতেন (যেদিকে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন, সেদিকের কথা না বলে অস্পষ্ট করে অন্যদিকে যাওয়ার কথা বলতেন)। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, তিনি হুনাইনের যুদ্ধে বের হওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলেন নজদের রাস্তা কোন দিকে? সেখানকার অবস্থা কেমন? সেখানে কোন সম্প্রদায়ের দুশমনরা বসবাস করে? ইত্যাদি। এভাবে তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে কার্য সম্পাদন করতেন। আর তিনি বলতেন- যুদ্ধ হচ্ছে এক প্রকার ধোঁকা। তিনি গোয়েন্দা পাঠিয়ে শত্রুদের খবরা-খবর এবং তাদের গতিবিধি জানার চেষ্টা করতেন এবং অগ্রগামী সৈনিকদেরকে তা বলে দিতেন। তিনি জিহাদের সময় পাহারাদারও নিযুক্ত করতেন।

আর যখন শত্রুদের সাথে মুকাবেলা শুরু হত, তখন তিনি দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করতেন, তাঁর কাছেই সাহায্য চাইতেন। সে সময় তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ বেশী বেশী আল্লাহর যিকির করতেন এবং তাদের আওয়াজ খুব নীচু রাখতেন।

জিহাদের ময়দানে তিনি সৈনিকদেরকে সুন্দরভাবে সাজাতেন এবং সকল দিকেই খেয়াল রাখতেন। তাঁর আদেশ পেয়েই সৈন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হত। তিনি যুদ্ধের পোশাক পরিধান করতেন। কখনও তিনি দু’টি লৌহ বর্ম পরিধান করে বের হয়েছেন। যুদ্ধের সময় তিনি ছোট ও বড় আকারের পতাকা ধারণ করতেন।

তিনি যখন কোন গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করে জয়লাভ করতেন, তখন তিনি তাদের আঙ্গিনায় তিন দিন অবস্থান করতেন। অতঃপর সেখান থেকে ফেরত আসতেন।

তিনি যখন চূড়ান্ত আক্রমণের ইচ্ছা করতেন তখন আযানের সময় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। সেখান থেকে আযানের শব্দ শুনা গেলে হামলা করা থেকে বিরত থাকতেন। আর আযানের শব্দ না শুনলে আক্রমণ করতেন। কখনও তিনি রাতে শত্রুদের উপর হামলা করতেন। কখনও তিনি দিনের বেলাতেই হঠাৎ আক্রমণ করতেন।

তিনি বৃহস্পতিবার সকাল বেলা বের হওয়া পছন্দ করতেন। রসূল (ﷺ) এর সৈনিকরা যখন ময়দানে অবতরণ করতেন, তখন তাদের একজন অন্যজনের সাথে মিলে এবং সারিবদ্ধ হয়ে এমনভাবে দাঁড়াতেন যে, একটি চাদর তাদের উপর ফেলে দিলে তা সকলকেই আবৃত করে ফেলত।

তিনি সৈন্যদেরকে কাতারবন্দী করতেন এবং নিজ হাতে কাতার সোজা করতেন। তখন তিনি বলতেন- হে অমুক! আগে বাড়। হে অমুক পিছনে সরে এসো। তিনি পছন্দ করতেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ গোত্রের পতাকা তলে থেকেই যুদ্ধ করুক। শত্রুদের সাথে মুকাবেলা করার সময় তিনি বলতেন

اللّٰهُمَّ مُنْزِلَ الكِتَاب ومُجْرىَ السَّحَاب وهَازِمَ الأَحْزَابِ اهْزِمْهُمْ وانصُرْنَا عَلَيْهم

‘‘হে আল্লাহ্! কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণকারী, মেঘমালা পরিচালনাকারী এবং শত্রু সৈন্যদেরকে পরাজিতকারী। তাদেরকে পরাজিত কর এবং আমাদেরকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’’। কখনও তিনি বলতেন-

سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُرَ بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ والسَّاعَةُ أَدْهَى وَأمَرُّ

‘‘এ দল তো অচিরেই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। বরং কেয়ামত তাদের প্রতিশ্রম্নত সময় এবং কেয়ামত ঘোরতর বিপদ ও তিক্ততর। (সূরা কমার-৫৪:৪৫-৪৬) তিনি আরও বলতেন- হে আল্লাহ্! আমাদের উপর তোমার সাহায্য নাযিল কর’’।

তিনি আরও বলতেন-

اللّٰهُمَّ أَنْتَ عَضُدِى وأَنتَ نَصِيرِى وَبِكَ أُقَاتِلُ

‘‘হে আল্লাহ্! তুমি আমার বাহু (শক্তি)। তুমি আমার মদদগার। তোমার পথেই এবং তোমার জন্যেই আমি যুদ্ধ করি’’।[1]

যুদ্ধ যখন প্রকট ও কঠোর আকার ধারণ করত এবং শত্রুরা তাঁর নিকটবর্তী হত, তখন তিনি নিজের বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রকাশ করে বলতেন- ‘‘আমি সত্য নাবী, মিথ্যুক নই’’, আমি আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র’’। যুদ্ধ কঠিন আকার ধারণ করলে লোকেরা রসূল (ﷺ) এর কাছে এসে আশ্রয় নিত। যুদ্ধের সময় রসূল (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের জন্য এমন কিছু সংকেত নির্ধারণ করতেন, যার মাধ্যমে তাদেরকে চিনা যেত। কোন এক যুদ্ধে তাদের সংকেত ছিল, ‘আমিত’, ‘আমিত’, কোন এক যুদ্ধে ছিল ‘ইয়া মানসুর আমিত’ আবার অন্য এক যুদ্ধে তাদের সংকেত ছিল حَم لا يُنْصَرُونَ

যুদ্ধের সময় তিনি লৌহ বর্ম ও হিলমেট পরিধান করতেন, গলায় তরবারী ঝুলাতেন, হাতে বর্শা ও আরবী কামান বহন করতেন এবং আত্মরক্ষার জন্য ঢাল ব্যবহার করতেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে অহংকার করা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন- আল্লাহ্ তা‘আলা কিছু কিছু অহংকার পছন্দ করেন আর কিছু কিছু অহংকার পছন্দ করেন না। তিনি যুদ্ধের ময়দানে বীরত্ব ও অহংকার প্রদর্শন করা পছন্দ করেন এবং সাদকাহ করার সময় অহংকার করাকে ভালবাসেন। কিন্তু পাপ ও সীমা লংঘনের কাজে অহংকার করাকে অপছন্দ করতেন।

তিনি একবার তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় মিনজানিক তথা কয়েকজন মিলে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র সদৃশ এক প্রকার অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। যুদ্ধের সময় তিনি নারী ও শিশু হত্যা করতে নিষেধ করতেন। আর যুদ্ধের মাঠে অল্প বয়স্ক কোন লড়াইকারী দেখলে তিনি তাকে পরীক্ষা করতেন। তার মধ্যে বালেগ হওয়ার আলামত পরিলক্ষিত হলে তাকে হত্যা করতেন। আর তা না হলে ছেড়ে দিতেন।

কোন বাহিনীকে প্রেরণের সময় তিনি তাদেরকে তাকওয়া তথা আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিতেন। তিনি তখন বলতেন- তোমরা আল্লাহর নামে চল, আল্লাহর পথে চল, যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, মুছলা তথা কাফেরদেরকে হত্যা করার সময় অঙ্গহানী করোনা, গাদ্দারী করোনা, বাড়াবাড়ি করোনা এবং কোন শিশুকে হত্যা করোনা।

তিনি শত্রুদের দেশে কুরআন নিয়ে ভ্রমণ করতে নিষেধ করতেন। তিনি যুদ্ধের আমীরকে যুদ্ধ শুরু করার আগে শত্রুদের কাছে তিনটি প্রস্তাব করার আদেশ দিতেন। (১) ইসলাম কবুল করার এবং কাফেরদের ভূমি ত্যাগ করে হিজরত করে মুসলমানদের দেশে চলে আসার প্রতি আহবান জানাতে বলতেন। (২) হিজরত ব্যতীত শুধু ইসলাম কবুলের দিকে আহবান জানানোর আদেশ দিতেন। এটি গ্রহণ করলে তাদেরকে অন্যন্যা বেদুঈন (গ্রাম্য লোক) মুসলিমদের মতই গণ্য করা হবে। গণীমতের সম্পদে তাদের কোন হিস্সা (অংশ) থাকবেনা। (৩) জিযয়া তথা কর প্রদান করে নিজেদের ধর্মের উপরই অবশিষ্ট থাকবে।

তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি মেনে নিলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার আদেশ দিতেন। আর উপরোক্ত প্রস্তাবের কোনটিই না মানলে আল্লাহর উপর ভরসা এবং তাঁর সাহায্য কামনা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দিতেন।

[1] . সহীহ আত-তিরমিযী, মাপ্র. হা/৩৫৮৪, মুসনাদে আহমাদ, মাশা. হা/১২৯৩২