আল্লাহর রসূল (ﷺ) মুসলমানদেরকে মদ্বীনায় হিজরতের অনুমতি দিলেন। মুসলিমগণ দ্রুত মদ্বীনায় হিজরত করতে লাগলেন। আবু সালামা এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামা সর্বপ্রথম মদ্বীনার পথে বের হলেন। কিন্তু আবু সালামার শ্বশুর গোত্রের লোকেরা এসে উম্মে সালামাকে এবং শিশু সন্তান সালামাকে আটকিয়ে দিল। ঐ দিকে আবু সালামার গোত্রের লোকেরা এসে উম্মে সালামার কাছ থেকে নিজেদের গোত্রের সন্তান দাবী করে তারাও সালামাকে ছিনিয়ে নিল। আবু সালামা কঠিন ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং স্ত্রী-সন্তান ফেলে একাই মদ্বীনায় চলে গেলেন। এক বছর পর উম্মে সালামা তার শিশু সন্তান নিয়ে মদ্বীনায় হিজরত করলেন। উছমান বিন আবু তালহা তাকে মদ্বীনায় পৌঁছিয়ে দিলেন।
আবু সালামার পথ ধরে লোকেরা একের পর এক মদ্বীনায় হিজরত করতে থাকল। এক পর্যায়ে মক্কাতে রসূল (ﷺ), আবু বকর এবং আলী (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন মুসলিম অবশিষ্ট রইলনা। আবু বকর ও আলী রসূল (ﷺ)-এর আদেশেই মক্কায় রয়ে গেলেন। এ ছাড়া যে সমস্ত মুসলিমকে কুরাইশরা আটকিয়ে রেখেছিল তারাও রয়ে গেলেন। রসূল (ﷺ) হিজরতের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন। আবু বকরও প্রস্ত্তত ছিলেন।
মুশরিকরা যখন দেখল রসূল (ﷺ) এর সাথীগণ বের হয়ে যাচ্ছেন এবং সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ নিয়ে মদ্বীনায় পাড়ি জমাচ্ছেন তখন তারা নিশ্চিত বিশ্বাস করে নিল, মুসলিমগণ অচিরেই মদ্বীনায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন। তারা জানত যে, মদ্বীনা সুরক্ষিত একটি দেশ এবং তার অধিবাসীরা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী। অচিরেই মদ্বীনায় মুসলিমগণ শক্তিশালী হয়ে যাবে। তাই তারা আশঙ্কা করল যে, রসূল (ﷺ) ও মদ্বীনায় চলে যাবেন। সুতরাং বিষয়টি তাদের কাছে খুব বড় হয়ে দেখা দিল। তারা এ ব্যাপারে সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য দারুন্ নাদওয়ায় একত্রিত হল। তাদের বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোকদের কেউ অনুপস্থিত রইলনা। তাদের বন্ধু ও মুরববী ইবলীসও একজন নজদী শাইখের বেশ ধরে এবং শরীরে লম্বা চাদর জড়িয়ে বৈঠকে যথাসময়ে উপস্থিত হল। তারা রসূল (ﷺ) এর ব্যাপারে পরামর্শ শুরু করল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু ইবলীস কোন রায়কেই পছন্দ করছিলনা। পরিশেষে আবু জাহেল বলল- আমি মনে করি প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে শক্তিশালী যুবককে আমরা বেছে নিব। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ধাঁরালো তলোয়ার থাকবে। তারা সকলে মিলে এক সাথে এক আঘাতেই মুহাম্মাদকে হত্যা করে ফেলবে। এতে সকল গোত্রের মধ্যে তার রক্ত ভাগ হয়ে যাবে। তারপর আব্দে মানাফ গোত্রের (মুহাম্মাদেও গোত্রের) লোকেরা এ ব্যাপারে কোন সিদ্বান্ত নিতে পারবেনা। তাদের পক্ষে সকল গোত্রের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করা ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আর দিয়ত দেয়ার প্রয়োজন হলে আমরা সকলে মিলেই তা পরিশোধ করে দিব।
এই প্রস্তাব শুনে শয়তান বলল- আল্লাহর শপথ! এটিই হচেছ সঠিক প্রস্তাব। সুতরাং তারা সকলে এই প্রস্তাবের উপরেই একমত হয়ে মজলিস ত্যাগ করল। ঐ দিকে জিবরীল ফিরিস্তা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট থেকে অহীর মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের কথা রসূল (ﷺ) কে জানিয়ে দিলেন এবং সেই রাত্রে তাকে নিজ বিছানায় শয়ন করতে নিষেধ করলেন।
পরের দিন রসূল (ﷺ) স্বীয় চেহারা মুবারক আবৃত করে দিবসের মধ্যভাগে আবু বকরের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। অথচ তিনি এ রকম সময়ে ইতিপূর্বে কখনই আবু বকরের বাড়িতে আসতেন না। তিনি সেখানে গিয়ে বললেন- তোমার কাছে যারা আছে তাদের সকলকে বের করে দাও। আবু বকর (রাঃ) বললেন- হে আল্লাহর রসূল! এরা তো আপনারই পরিবার। তিনি তখন বললেন- আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে মদ্বীনায় হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন। আবু বকর তখন বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আমিও আপনার সাথে যেতে চাই। তিনি বললেন- হ্যাঁ, তাই হবে। আবু বকর বললেন- আমার মা-বাপ আপনার জন্য কুরবান হোক! এই দু’টি বাহনের যে কোন একটি আপনি গ্রহণ করুন। রসূল (ﷺ) বললেন- হ্যাঁ, তবে মূল্য পরিশোধ করেই তা গ্রহণ করব। আলী (রাঃ) কে সেই রাত্রে তাঁর বিছানায় ঘুমাতে বললেন।
ঐ দিকে সন্ধ্যা নেমে আসতেই কুরাইশদের নির্বাচিত যুবকেরা একত্রিত হল। তারা রসূল (ﷺ) এর ঘরের দরজায় পাহারা দিতে লাগল এবং তিনি কখন ঘরে প্রবেশ করে নিদ্রা যাবেন সেই সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল। তারা পরস্পর পরামর্শ করতে লাগল যে, কোন্ বদ নসীব যুবকটি সর্বাগ্রে আক্রমণ করার ঘৃণিত কাজটি সম্পন্ন করবে।
রসূল (ﷺ) ঘর থেকে বের হয়ে এক মুষ্ঠি মাটি হাতে নিয়ে কাফেরদের মাথায় নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তারা তাঁকে দেখতেই পায় নি। তিনি মাটি নিক্ষেপ করছিলেন আর কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করছিলেনঃ
وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ
‘‘এবং আমি তাদের সামনে ও পিছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতঃপর তাদেরকে আবৃত করে দিয়েছি, ফলে তারা দেখেনা’’। (সূরা ইয়াসীন-৩৬:৯) তিনি আবু বকরের বাড়ির দিকে গেলেন। তারা উভয়েই রাতের অন্ধকারে ঘরের জানালা দিয়ে বের হয়ে পড়লেন।
তারা উভয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর এক লোক এসে দেখল- রসূল (ﷺ) এর ঘরের দরজায় লোকেরা অপেক্ষা করছে। সে জিজ্ঞেস করল- তোমরা কিসের অপেক্ষা করছ? তারা বলল- আমরা মুহাম্মাদের অপেক্ষা করছি। সে বলল- তোমরা ব্যর্থ হয়েছ ও তোমাদের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার নয়। আল্লাহর শপথ! সে তোমাদের পাশ দিয়েই বের হয়ে গেছে। সে তোমাদের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে চলে গেছে। তারা দাঁড়িয়ে নিজেদের মাথা হতে মাটি ঝেড়ে ফেলতে লাগল। সকাল হলে আলী (রাঃ) ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। তারা তাঁকে নাবী (ﷺ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা।
অতঃপর তিনি এবং আবু বকর (রাঃ) গারে ছাওরের কাছে গিয়ে তাতে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করার পর গুহার মুখে মাকড়শা জাল বুনিয়ে ফেলল।[1]
রসূল (ﷺ) এবং আবু বকর (রাঃ) মদ্বীনার রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ব হতেই আব্দুল্লাহ্ ইবনে উরাইকীত লাইছীকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। সে মদ্বীনার রাস্তা সম্পর্কে খুব পারদর্শী ছিল এবং সে তার গোত্রের ধর্মের উপরই ছিল। সে ছিল একজন বিশ্বস্ত লোক। তাই তার কাছে তাদের বাহন দু’টি সোপর্দ করলেন এবং তিন দিন পর গারে ছাওরের নিকট আসতে বললেন।
ঐদিকে কুরাইশরা তাদের সন্ধানে কোন প্রকার অলসতা করলনা। ‘কাফা’ তথা পদচিহ্ন দেখে যারা পথচারীর পরিচয় ও গতিপথ জানতে পারে তারা এমন লোককে সাথে নিয়েও অনুসন্ধান চালালো। অনুসন্ধান করতে করতে তারা একদম গুহার দরজায় এসে দাঁড়াল।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, আবু বকর (রাঃ) বললেন- হে আল্লাহর রসূল! তাদের কেউ যদি তার দৃষ্টি একটু নীচু করে তাহলেই আমাদেরকে দেখে ফেলবে। এ কথা শুনে নাবী (ﷺ) বললেন- হে আবু বকর! চুপ থাক। সেই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা কি? যাদের তৃতীয়জন হচ্ছেন আল্লাহ। তুমি চিন্তা করনা। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। আবু বকর এবং রসূল (ﷺ) তাদের মাথার উপরে কাফেরদের কথা শুনছিলেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে অন্ধ করে দিলেন। আমের বিন ফুহায়রা আবু বকরের ছাগল চরাত। আবু বকর ও রসূল (ﷺ) সম্পর্কে মক্কায় যা বলা হত সে তা শ্রবণ করত এবং গুহায় এসে তাদের কাছে সেই খবর পৌঁছে দিত। কিন্তু শেষ রাতে সে মক্কায় গিয়ে মক্কাবাসীদের সাথেই রাত্রি যাপন করত এবং সকালে তাদের সাথেই ঘর থেকে বের হত।
তারা গুহায় তিন দিন অবস্থান করলেন। কুরাইশদের অনুসন্ধানের আগুন যখন নিভে গেল তখন আব্দুল্লাহ্ ইবনে উরাইকীত বাহন দু’টি নিয়ে গুহার নিকট এসে উপস্থিত হল। তারা মদ্বীনার পথে যাত্রা শুরু করলেন। আমের ইবনে ফুহায়রা আবু বকরের পিছনে আরোহন করলেন। পথপ্রদর্শক ছিল তাদের সামনে। আল্লাহর চোখ তাদেরকে পাহারা দিচ্ছিল, তাঁর সাহায্য তাদের সঙ্গী ছিল এবং আল্লাহর রহমত ও দয়ার ছায়ায় নাবীর কাফেলা মদ্বীনার পথে অগ্রসর হতে লাগল।
মক্কার মুশরিকরা যখন নিরাশ হল তখন তারা আবু বকর ও রসূল (ﷺ) কে গ্রেপ্তারের বিনিময়ে বিরাট পুরস্কারের ঘোষণা দিল। লোকেরা পুরস্কারের আশায় তাদের অনুসন্ধানে কঠোর পরিশ্রম করল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই বিজয়ী হবে। আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর কাফেলা যখন কুদাইদের উপর দিয়ে বনী মুদলাজ গোত্রের বস্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন বস্তির একজন লোক তাদেরকে দেখে ফেলে। সে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল- আমি এই মাত্র সাগরের তীর বেয়ে একটি কাফেলাকে অতিক্রম করতে দেখেছি। আমার মনে হয় মুহাম্মাদ এবং তাঁর সাথীরা এই কাফেলায় রয়েছে। কথাটি শুনেই সুরাকা বিন মালেক বুঝে ফেলল এবং নিজেই সেই পুরস্কারটি অর্জন করতে চাইল। অতীতে এ রকম অনেক পুরস্কারই সে পেয়েছে। সে অন্যদের থেকে বিষয়টি গোপন রাখার মানসে বলতে লাগল- তোমার এই কথা বাদ দাও তো, তারা হচ্ছে উমুক এবং উমুক। তারা তাদের প্রয়োজনে বের হয়েছে। এই বলে সে সামান্য সময় অবস্থান করল। অতঃপর সে তার তাঁবুতে প্রবেশ করে খাদেমকে বলল- তাঁবুর পিছন দিয়ে ঘোড়াটি নিয়ে বের হও। টিলার পিছনে একটু পরেই আমি তোমার সাথে মিলিত হব। অতঃপর সে বর্শা হাতে নিয়ে বর্শার উপরের অংশ মাটির সাথে লাগিয়ে তা দিয়ে দাগ টানতে টানতে অগ্রসর হতে লাগল। ঘোড়ার নিকট পৌঁছে তাতে লাফ দিয়ে আরোহন করল এবং দ্রুত গতিতে চলতে লাগল। দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে সে একদম তাদের কাছে চলে গেল এবং রসূল (ﷺ) এর কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেল। তিনি ডানে বামে তাকাচ্ছিলেন না। আর আবু বকর (রাঃ) খুব বেশী এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। আবু বকর তখন রসূল (ﷺ) কে বললেন- হে আল্লাহর রসূল! এই তো সুরাকা আমাদের কাছে এসে গেছে। আল্লাহর রসূল (ﷺ) তার বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন। তার ঘোড়ার সামনে পা দু’টি মাটিতে দেবে গেল। সুরাকা বলল- আমি অবশ্যই জানি, তোমাদের বদ দু’আর কারণেই এমনটি হয়েছে। আল্লাহর নিকট আমার জন্য দু’আ কর। আমি অঙ্গিকার করছি যে, যারা তোমাদের সন্ধানে বের হয়েছে আমি তাদেরকে ফিরিয়ে দিব।
রসূল (ﷺ) তার জন্য দু’আ করলেন। ঘোড়ার পা উঠে গেল। এবার সুরাকা রসূল (ﷺ) এর কাছে একটি পত্র লিখে দেয়ার আবেদন করল। রসূল (ﷺ) এর আদেশে আবু বকর (রাঃ) এক খন্ড চামড়ার উপর (নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কে) কিছু লিখে দিলেন। পত্রটি মক্কা বিজয়ের দিন পর্যন্ত তার সাথেই ছিল। মক্কা বিজয়ের দিন সুরাকা পত্রটি নিয়ে আসলে রসূল (ﷺ) তার সাথে কৃত অঙ্গিকার পূর্ণ করলেন এবং বললেন- আজ ওয়াদা-অঙ্গিকার পূর্ণ করার দিন, আজ উত্তম আচরণের দিন। সুরাকা রসূল (ﷺ) এবং আবু বকরের জন্য পাথেয় এবং বাহন পেশ করলে তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তারা বললেন- আমাদের তালাশে যারা বের হয়েছে তুমি শুধু তাদেরকে দূরে রাখ এবং তাদের কাছে আমাদের খবর গোপন রাখ। সে বলল- অবশ্যই তা করব। সে ফেরত গিয়ে দেখল- অনেকেই তাদের সন্ধান করছে। সুরাকা তাদেরকে বলতে লাগল-। আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট খবর নিয়ে এসেছি। তারা এই দিকে নয়। সুরাকা দিনের প্রথমভাগে রসূলের শত্রু ছিল। আর দিবসের শেষভাগে তাঁর বন্ধু এবং রক্ষকে পরিণত হল।
তারা চলতে লাগলেন। চলার পথে উম্মে মা’বাদের তাঁবুর পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। উম্মে মা’বাদ ছিল একজন সদাচরণকারী মহিলা। তাঁবুর পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী লোকদেরকে সে পানাহার করাত। রসূল (ﷺ) এবং আবু বকর (রাঃ) তার কাছে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কাছে খাবার কিছু আছে কি? সে বলল- আল্লাহর শপথ! আমার কাছে খাবার কিছু থাকলে আমি আপনাদের মেহমানদারী করতে মোটেই কার্পণ্য করতামনা। সেটি ছিল অভাবের বছর। খাদ্যাভাবে উম্মে মা’বাদের বকরীগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল। রসূল (ﷺ) তাঁবুর এক পার্শ্বে একটি বকরী দেখতে পেলেন। তিনি বললেন- ওহে উম্মে মা’বাদ! এই বকরীটি এখানে কেন? উম্মে মা’বাদ বলল- দুর্বলতার কারণে এটি অন্যান্য বকরীর সাথে চলতে পারেনা। তাই এটি পিছনে রয়ে গেছে। নাবী (ﷺ) বললেন- বকরীটি কি দুধ দেয়? উম্মে মা’বাদ বলল- এটি দুর্বলতার কারণে চলতেই পারছেনা। দুধ আসবে কোথা হতে? তিনি বললেন- তুমি কি আমাকে এটি দোহন করার অনুমতি দিবে? সে বলল- আমার মা-বাপ আপনার জন্য কুরবান হোক! আপনি যদি তাতে কোন দুধ দেখেন তাহলে দোহন করতে পারেন। রসূল (ﷺ) বকরীর স্তনে হাত লাগালেন, বিসমিল্লাহ্ পাঠ করলেন এবং বরকতের দু’আ করলেন। দুধে বকরীর স্তন ভর্তি হয়ে গেল। তিনি পাত্র আনয়ন করতে বললেন। পাত্র আনয়ন করা হলে তাতে দুধ দোহন করলেন। পাত্র ভর্তি হয়ে দুধের ফেনা উপরে উঠতে লাগল। রসূল (ﷺ) তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করলেন এবং তাঁর সাহাবীগণও পান করলেন। তিনি পুনরায় পান করলেন। দ্বিতীয়বারও তিনি পাত্র ভর্তি করে দুধ দোহন করে উম্মে মা’বাদের তাঁবু ত্যাগ করলেন।
কিছুক্ষণ পর উম্মে মা’বাদের স্বামী আবু মা’বাদ বকরীগুলো চালিয়ে নিয়ে ফেরত আসল। তাঁবুতে দুধ দেখে আবু মা’বাদ আশ্চার্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল- তুমি দুধ কোথায় পেলে? বকরীগুলো খাদ্যাভাবে শুকিয়ে রয়েছে। বাড়ীতে কোন দুধেল ছাগলও নেই। সে বলল- আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছ দিয়ে একজন বরকতময় লোক অতিক্রম করেছেন। তার ঘটনা ছিল এই এই। তার অবস্থা ছিল এ রকম এ রকম। আবু মা’বাদ বলল- আল্লাহর শপথ! আমার ধারণা এই লোকটিকেই কুরাইশরা খুঁজছে। হে উম্মে মা’বাদ আমার কাছে তার গুণাগুণ বর্ণনা কর। সুতরাং উম্মে মাবাদ আবু মাবাদের কাছে অত্যন্ত চমৎকার ও সুন্দরভাবে এবং হৃদয়গ্রাহী করে রসূলের গুণাগুণ ও পরিচয় তুলে ধরল। সে বলল- উজ্জল রং, জ্বলজ্বলে মুখ, সুমধুর আচরণ এভাবে শেষ পর্যন্ত। উম্মে মা’বাদের কাছে রসূল (ﷺ) এর প্রশংসা ও গুণাবলী শুনে আবু মা’বাদ বলল- আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই এই ব্যক্তিই হচ্ছেন তিনি যার সম্পর্কে কুরাইশরা বলাবলি করছে এবং যাকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার ইচ্ছা ছিল যে, আমি তাঁর সাথী হয়ে যাব। আমি যদি সুযোগ পাই তাহলে অবশ্যই তার সঙ্গী হব।
ঐদিকে মক্কায় উঁচু কণ্ঠে একটি কবিতা আবৃত্তির আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল, কিন্তু কে তা আবৃত্তি করছে, তাকে দেখা যাচ্ছিল না, যার প্রথম লাইন হচ্ছে,
جزى الله رب العرش خير جزائه + رفيقين حلا خيمتي أم معبد
‘‘আরশের প্রভু আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ দুইজন বন্ধুকে সর্বোত্তম বিনিময় দান করুন, যারা উভয়েই উম্মে মাবাদের তাঁবুতে অবতরণ করেছেন। এভাবে শেষ পর্যন্ত। আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) বলেন- আমরা জানতাম না যে রসূল (ﷺ) কোন দিকে গিয়েছেন। কিন্তু মক্কার নীচু ভূমিতে একটি জিন এসে কবিতার এই লাইনগুলো আবৃত্তি করতে লাগল। লোকেরা সেই আওয়াজ শুনে পিছে পিছে চলা শুরু করল। তবে তারা সেই জিনকে দেখতে পাচ্ছিলনা। পরিশেষে জিন মক্কার উঁচু ভূমি দিয়ে বের হয়ে গেল। আসমা বলেন- এই কবিতা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) মদ্বীনার দিকে চলে গেছেন।