কুরাইশদের নির্যাতন কঠোর হলে আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের হিজরত

মুসলিমদের উপর যখন কুরাইশদের নির্যাতন কঠোর থেকে কঠোরতর হতে লাগল এবং তাদেরকে যখন বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি দেয়া শুরু করল তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের উপর দয়া করলেন এবং মুশরিকদের নির্যাতন হতে মুক্তি দান কল্পে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি দিলেন। আবিসিনিয়ার বাদশাহ্ নাজাশী ছিলেন একজন ন্যায় পরায়ণ ও দয়ালু বাদশাহ। তাদের দলনেতা ছিলেন উসমান বিন আফ্ফান (রাঃ)। তাঁর সাথে ছিলেন নাবী নন্দিনী রুকাইয়্যা (রাঃ)। তারা ছিলেন সংখ্যায় ১২জন পুরুষ ও ৪জন মহিলা। তারা গোপনে মক্কা থেকে বের হলেন। লোহিত সাগরের তীরে গিয়ে আল্লাহর তাওফীক মোতাবেক তারা দু’টি নৌকা পেয়ে গেলেন। নৌকার মাঝিরা তাদেরকে উঠিয়ে নিলেন।

এটি ছিল নবুওয়াতের ৫ম সনের রজব মাসের ঘটনা। কুরাইশরা তাদের সন্ধানে বের হয়ে সাগরের তীর পর্যন্ত পৌঁছল। কিন্তু তারা তাদের সন্ধান পেলনা। তারা আবিসিনিয়ায় পৌঁছে উত্তমভাবে অবস্থান করতে শুরু করলেন। এদিকে আবিসিনিয়ায় মুহাজিরদের নিকট এই মর্মে খবর পৌছে যায় যে, কুরাইশরা মুসলিমদের উপর নির্যাতন বন্ধ করেছে এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। সুতরাং তারা ঐ বছরের শাওয়াল মাসে প্রত্যাবর্তন করেন। যখন তারা মক্কায় এসে পৌঁছেন তখনই আসল তথ্য অবগত হতে সক্ষম হন। তারা জানতে পারেন যে, কুরাইশরা আগের চেয়ে আরও বেশী নির্যাতন চালাচ্ছে। তখন তাদের কেউ কেউ পুনরায় আবিসিনিয়া ফেরত চলে যায় আবার কেউ কেউ গোপনে অথবা কুরাইশদের কারো নিরাপত্তায় মক্কায় প্রবেশ করেন।

তখনই আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) আবিসিনিয়া থেকে ফেরত আসার পর নাবী (ﷺ) এর নিকট প্রবেশ করে সালাম দেন। তিনি তখন সলাতে ছিলেন। তাই উত্তর দেন নি। ইবনে মাসউদ (রাঃ) এতে খুব কষ্ট পেলেন। পরে নাবী (ﷺ) তাঁকে বললেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা অহীর মাধ্যমে আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা সলাতরত অবস্থায় কথা বলোনা। এটিই সঠিক কথা। যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইবনে ইসহাক। ইবনে সা’দ এবং অন্য একটি দল মনে করেন আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ মক্কায় প্রবেশ করেন নি; বরং তিনি হাবশায় ফিরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি অন্য সাহাবীদের সাথে মদ্বীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

এই বর্ণনা ঠিক নয়। কারণ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বদরের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। তিনিই আবু জাহেলকে কাবু করেছিলেন। আর যারা আবিসিনিয়া থেকে মদ্বীনায় হিজরত করেছিলেন তারা জা’ফর বিন আবু তালেবের সাথে বদরের যুদ্ধের চার বা পাঁচ বছর পর মদ্বীনায় আগমন করেছিলেন।

যদি বলা হয় ইবনে সা'দের বর্ণনা তো যায়েদ বিন আরকামের উক্তিকে সমর্থন করে। যায়েদ বিন আরকাম বলেন- আমরা সলাতরত অবস্থায় কথা বলতাম। সলাত অবস্থায় যে কেউ তার পাশের লোকের সাথে কথা বলত। অতঃপর কুরআনের এই আয়াত নাযিল হলেঃ وَقُوْمُوْا لله قَانِتِيْنَ ‘‘আর আল্লাহর সামনে একান্ত আনুগত্যের (নিরবতার) সাথে দাঁড়াও’’। (সূরা বাকারা-২:২৩৮) তখন আমাদেরকে চুপ থাকার আদেশ দেয়া হল এবং আমাদেরকে সলাতরত অবস্থায় কথা বলতে নিষেধ করা হল। যায়েদ বিন আরকাম ছিলেন আনসারী সাহাবী। আর সূরাটি হচ্ছে মাদানী। সুতরাং ইবনে মাসউদ এই ঘটনার পর নাবী (ﷺ) এর কাছে আবিসিনিয়া থেকে মদ্বীনায় এসে সলাতরত অবস্থায় সালাম দিলে তিনি তার উত্তর দেননি। সলাতের সালাম ফিরিয়ে তিনি তার সালামের উত্তর দিলেন এবং সলাত অবস্থায় কথা বলা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দিলেন। সুতরাং ইবনে সা'দের বর্ণনা যায়েদ বিন আরকামের বর্ণনার অনুরূপ হয়েছে।

উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। আবিসিনিয়া থেকে দ্বিতীয়বার যারা এসেছিলেন তারা কেবল খায়বার যুদ্ধের বছর জা’ফর বিন আবু তালেব ও তাঁর সাথীদের সাথেই আগমন করেছিলেন। তিনি যদি বদরের যুদ্ধের পূর্বে আবিসিনিয়া হতে মদ্বীনায় আগমণ করতেন তাহলে অবশ্যই এ ব্যাপারে আলোচনা হত।

অথচ আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের মাত্র দুইবার আগমনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোন আগমনের কথা কেউ বর্ণনা করেননি। একবার তাদের একদল মক্কায় আগমন করেছেন। আরেকদল জা’ফরের সাথে খায়বারের বছর মদ্বীনায় আগমন করেছেন। সুতরাং এই দুইবারের বাইরে ইবনে মাসউদ কখন ও কার সাথে আগমন করলেন?

সুতরাং আমরা যা উল্লেখ করেছি ইবনে ইসহাকের বর্ণনাও অনুরূপ। ইবনে ইসহাক বলেন- আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী সাহাবীদের কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, মক্কাবাসীরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এই খবর পেয়ে তারা চলে আসল। মক্কার কাছে এসে তারা জানতে পারলেন যে, খবরটি বানোয়াট। সুতরাং তাদের কেউ কারও আশ্রয় নিয়ে আবার কেউ অতি সংগোপনে মক্কায় প্রবেশ করলেন। যারা মক্কায় ফেরত আসলেন তারা এখানেই বসবাস করতে থাকলেন। পরে তারা রসূল (ﷺ) এর আদেশে মদ্বীনায় হিজরত করেছেন এবং বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ছিলেন এই দলের অন্তর্ভুক্ত।

যদি বলা হয় যায়েদ বিন আরকামের হাদীছের জবাব কী হবে? সেখানে তো বলা হয়েছে যে, মদ্বীনাতেই সলাত অবস্থায় কথা বলার নিষিদ্ধতা এসেছে।

এর উত্তর দুইভাবে দেয়া যেতে পারে। (১) প্রথমে মক্কায় নিষিদ্ধতা এসেছে। অতঃপর মদ্বীনায় আসার পর সলাত অবস্থায় কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন। পরে আবার নিষেধ করেছেন। (২) যায়েদ বিন আরকাম কম বয়সের সাহাবী ছিলেন। ছোট হিসেবে তিনি এবং তার মতই অন্য একদল লোক অভ্যাস মোতাবেক সলাত অবস্থায় কথা বলত। নিষিদ্ধতার বিষয়টি তাদের জানা ছিলনা। যখন তারা বিষয়টি জানতে পারলেন তখন সলাত অবস্থায় কথা বলা থেকে বিরত থাকলেন।

অতঃপর যারা হাবশা থেকে ফেরত আসলেন তাদের উপর এবং অন্যান্য মুসলিমদের উপর কুরাইশদের পক্ষ হতে নতুনভাবে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেল। তারা কুরাইশদের হাতে কঠোর শাস্তি ভোগ করলেন। নাবী (ﷺ) তাদেরকে দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দিলেন। দ্বিতীয়বার বের হওয়া তাদের জন্য আরও কঠিন ছিল। আর বিশেষ করে কুরাইশরা যখন মুসলমানদের প্রতি নাজ্জাশীর সদ্ব্যবহারের কথা জনতে পারল, তখন তাদের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দিল।

এবার যারা হিজরত করল তাদের সংখ্যা ছিল ৮৩ জন। আম্মার বিন ইয়াসিরকেও তাদের মধ্যে গণনা করা হয়। আর তাদের সাথে ১৯ জন মহিলাও ছিল।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন- আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী দ্বিতীয় দলের মধ্যে উছমান বিন আফ্ফান এবং একদল বদরী সাহাবীর নামও উল্লেখ করা হয়। এটি একটি ধারণা মাত্র। অথবা এও হতে পারে যে, আবিসিনিয়া হতে সাহাবীদের একটি দল বদরের যুদ্ধের পূর্বেও একবার ফেরত এসেছেন। তাদের মধ্যে উছমান বিন আফ্ফান (রাঃ) ও ছিলেন। তাহলে মোট তিনবার ফেরত আসা হল। একবার হিজরতের পূর্বে, আরেকবার হিজরতের পর এবং বদরের যুদ্ধের পূর্বে এবং অন্যবার ৭ম হিজরিতে খায়বারের যুদ্ধের বছর। এই জন্যই ইবনে সা’দ এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেন- তারা যখন নাবী (ﷺ) এর হিজরতের কথা জানতে পারলেন তখন ৩৩ জন পুরুষ ও ৮ জন মহিলা আবিসিনিয়া হতে ফেরত আসলেন। তাদের দুই জন মক্কায় মারা গেলেন। ৭ জনকে মক্কায় আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। আর ১৪ জন বদরের যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন।

৭ম হিজরীর শাওয়াল মাসে নাবী (ﷺ) একটি চিঠি লিখে আমর বিন উমাইয়ার মাধ্যমে নাজ্জাশীর বরাবর পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে এর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। নাজ্জাশী ইসলাম কবুল করলেন এবং তিনি জানিয়ে দিলেন যে, আমি যদি আপনার কাছে আসতে সক্ষম হতাম তাহলে অবশ্যই চলে আসতাম। নাবী (ﷺ) নাজ্জাশীকে এও লিখেছিলেন যে, তিনি যেন উম্মে হাবীবাকে তাঁর কাছে বিয়ে দেন। উম্মে হাবীবা তাঁর স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরত করেছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ সেখানে গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্টান হয়ে যায় এবং খৃষ্টান থাকা অবস্থাতেই সে হাবাশায় মারা যায়।

সুতরাং নাজ্জাশী তাঁকে রসূল (ﷺ) এর কাছে বিয়ে দিলেন এবং তাঁর নিজের পক্ষ হতে চারশ দ্বীনার মোহারানা পরিশোধ করলেন। খালেদ বিন সাঈদ বিন আস এই বিয়েতে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নাজ্জাশীর কাছে আরও লিখেছিলেন যে, তিনি যেন সেখানে অবস্থানকারী সকল মুসলিমকে মদ্বীনায় পাঠিয়ে দেন এবং যাতায়াতের খরচাদিও বহন করেন। তাই নাজ্জাশী আমর বিন উমাইয়ার সাথে দু’টি নৌকায় করে তাদেরকে পাঠিয়ে দেন। অতঃপর তারা খায়বারে এসে নাবী (ﷺ) এর সাথে মিলিত হলেন। তারা এসে দেখলেন যে, তিনি খায়বার জয় করে ফেলেছেন।

এর মাধ্যমে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ এবং যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) এর হাদীছের মধ্যকার সমস্যা দূর হয়ে গেল এবং জানা গেল যে, মদ্বীনায় হিজরতের পর সলাতরত অবস্থায় কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যদি বলা হয় যে, এই সমাধান খুবই সুন্দর। তবে ইবনে ইসহাকের ঐ বর্ণনার জবাব কী হবে, যেখানে তিনি বলেছেন যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ মক্কাতেই ছিলেন? জবাব হল ইবনে সা’দ উল্লেখ করেছেন যে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ মক্কাতে অল্প কয়েক দিন অবস্থান করার পর হাবশায় চলে যান। এটিই সুস্পষ্ট কথা। কেননা মক্কাতে তাঁর কোন সাহায্যকারী ছিলনা। এই বিষয়টি ইবনে ইসহাকের কাছে অস্পষ্ট ছিল। ইবনে ইসহাক তাঁর বর্ণনার সূত্র উল্লেখ করেন নি। আর ইবনে সা’দ মুত্তালিব ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হানতাবের সনদে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং কোন সমস্যা অবশিষ্ট রইলনা।

ইবনে ইসহাক আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী দলের মধ্যে আবু মুসা আশআরীকেও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ওয়াকেদী এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ তাঁর প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলেন এ বিষয়টি ইবনে ইসহাকের মত পন্ডিতের নিকট কিভাবে অস্পষ্ট রয়ে গেল?

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন- আমার কথা হচ্ছে এই বিষয়টি ইবনে ইসহাকের চেয়ে কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকের কাছেও অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু উপরোক্ত সন্দেহের কারণ হচ্ছে, আবু মুসা আশআরী (রাঃ) ইয়ামান থেকে হিজরত করে প্রথমে আবিসিনিয়ায় জা’ফর ও তাঁর সাথীদের সাথে মিলিত হন। সেখান থেকে তারা মদ্বীনায় ফেরত আসেন। সহীহ বুখারীতে এটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এটিকে ইবনে ইসহাক আবু মুসার জন্য হিজরত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ কথা বলেন নি যে, তিনি মক্কা হতে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় গিয়েছিলেন, যাতে তার প্রতিবাদ করা হয়।